ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

যে আগুনে শুধু চোখে জল আসে

মুরসালিন হক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১০
যে আগুনে শুধু চোখে জল আসে

ঢাকা:গত এক বছরে সারাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে ঘটে গেছে ভয়াবহ কিছু অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। এসব ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা যেমন ছিল বিপুল, তেমনি ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও ছিল ব্যাপক।

বরাবরে মত গঠিত হয়েছে তদন্ত কমিটি। কমিটিগুলো তাদের প্রতিবেদনও পেশ করেছে। কিন্তু এ পর্যন্তই। তারপর সবকিছুই চলছে আগের মত। অগ্নিকাণ্ডের কারণ খুঁজে পাওয়া গেলেও বছর শেষে এ সমস্যা থেকে উত্তরণের কোনো পথ পাওয়া যায়নি।

ঘটনা ১
বছরের (২৫ ফেব্রুয়ারি) শুরুর দিকে গাজীপুরের গরীব অ্যান্ড গরীব নামের সোয়েটার ফ্যাক্টরির সাততলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় রাত সাড়ে নয়টায় বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে কেউ মারা না গেলেও ধোয়া নির্গমনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় দমবন্ধ হয়েই নিভে যায় ২১ তরতাজা শ্রমিকের প্রাণ। এ ঘটনায় আহত হয় প্রায় অর্ধশতাধিক।

গাজীপুর জেলা প্রশাসন অগ্নিকাণ্ডের কারণ উদঘাটনে তিন সদস্যের এবং বিজিএমইএ সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত প্রতিবেদনে শ্রমিকদের মৃত্যুর জন্য চারটি কারণ উল্লেখ করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। উভয় তদন্ত কমিটিই মৃত্যুর কারণ হিসেবে কারখানা ভবনের অননুমোদিত ও অপরিকল্পিত নির্মাণশৈলীকে দায়ী করেন।

ঘটনার প্রায় দেড় মাস পর ১৩ এপ্রিল দুপুর সোয়া একটার দিকে একই গার্মেন্টসের চতুর্থ তলায় আবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তবে এবার আর কোনো প্রাণনাশের ঘটনা না ঘটলেও কারখানাটির নির্মানশৈলীতে কোনো পরিবর্তনও আনা হয়নি।

ঘটনা ২
স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে পুরান ঢাকার নবাব কাটারার নিমতলী এলাকায়। ৩ জুন বৃহস্পতিবার রাত নয়টায় শুরু হয় আগুনের তাণ্ডব।

বিয়ে বাড়ির রান্নার আগুনের তাপ থেকে একটি রাসায়নিক গুদামে বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের প্রায় পঞ্চাশটি বসতভিটায়। এ ঘটনায় একই পরিবারের ৩৫ জনসহ বিয়েবাড়িতে আসা প্রায় ৯০ জন মানুষ ঘটনাস্থলেই মারা যান। পরদিন শুক্রবার সকাল নাগাদ উদ্ধার করা হয় ১১০টি লাশ। নভেম্বর মাস পর্যন্ত ওই ঘটনায় মৃতের সংখ্যা দাড়ায় ১২৫-এ। এ ঘটনায় আহত হয় প্রায় দুই শতাধিক মানুষ।

সরকারের তরফ থেকে একদিন শোক দিবস পালন করা হয়। ঘটনা তদন্তে গঠিত হয় মোট তিনটি তদন্ত কমিটি। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের কারখানা আর গুদাম উচ্ছেদ করার অভিযানও শুরু হয়। তারপর এক সময় উচ্ছেদ অভিযানও থমকে যায়।

নিমতলীর অগ্নিকাণ্ড আরেকটি ঘটনার জন্ম দেয় যা দেশের মানুষ মনে রাখবে দীর্ঘদিন। ঘটনার পরদিন ৪ জুন নিমতলী এলাকায় দু’টি পরিবারের বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছিল। অগ্নিকাণ্ডে পরিবার পরিজন হারিয়ে এতিম হয়ে যায় দুই বোন রুনা ও রতœা এবং আসমা।

ঘটনা জানার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের তিনজনকে নিজের মেয়ে বলে দেশবাসীর কাছে পরিচিত করেন এবং নিজেই অভিভাবক হিসেবে তাদের বিয়ে দেন। গণভবনে আয়োজিত বিয়ের অনুষ্ঠানে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অনেক ব্যক্তিরা উপস্থিত থেকে প্রধানমন্ত্রীর তিন কন্যা ও তাদের বরদের আশির্বাদ করেন।

ঘটনা ৩
নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতার কারণ রাসায়নিক বিস্ফোরণ বলে প্রমাণ পাওয়ার পরও অননুমোদিত এসব কেমিক্যাল কারখানার ব্যাপারে সরকারের উদাসীনতায় ঘটে আরেকটি দুর্ঘটনা।

রাজধানীর ধোলাইপাড় এলাকায় বেবি সলিউশান নামক একটি কেমিক্যাল কারখানায় ৬ অক্টোবর বিকেলে আগুনে নিভে যায় সাত শ্রমিকের স্বপ্ন। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় আরো দুই জন।

যথারীতি এ ঘটনায়ও গঠিত হয় তদন্ত কমিটি, কারখানটি অননুমোদিতভাবে পরিচালিত করা হয় এ মর্মে প্রতিবেদনও দেয় কমিটি। কিন্তু কারখানাটি অপসারণ করা হয়নি আজও।

ঘটনা ৪
আবারো রাজধানীর বাইরে পোশাক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। ১৪ ডিসেম্বর দুপুরে শ্রমিকদের খাওয়ার সময় আশুলিয়ার নরসিংহপুরে হা-মীম গ্রুপের দ্যাটস ইট নামের পোশাক কারখানার ১১ তলা বিশিষ্ট ভবনের ৯, ১০, ও ১১ তলায় আগুন লাগে।

বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে সূত্রপাত হওয়া ওই আগুনের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ২৫। আহত হয় প্রায় অর্ধশতাধিক। অগ্নিকাণ্ডের সময় ভবনের নির্গমন পথ তালবন্ধ করে রাখা হয়। ফলে লাফিয়ে পড়ে বাঁচার চেষ্টা করতে গিয়ে মারা পড়েন অনেকে।

এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ফায়ার সার্ভিস এবং বিজিএমইএ এর পক্ষ থেকে পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

ঘটনা ৫
নিমতলী ও ধোলইপারের পর এবার কেমিক্যাল বিস্ফোরণে একটি কয়েল তৈরির কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ২৪ ডিসেম্বর রাত সাড়ে নয়টায় রাজধানীর খিলক্ষেতের নামাপাড়া এলাকায় গুডনাইট মশার কয়েল তৈরির ওই কারখানাটিতে রাসায়নিক বিস্ফোরণে আগুনের সূত্রপাত হয়। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় ছয় শ্রমিক এবং তিনদিনে মারা যায় আরো চারজন।

চলতি বছর উল্লেখযোগ্য এসব ঘটনা ছাড়াও ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের আরো বেশকিছু ঘটনা ছিল। এসব অগ্নিকাণ্ডের কোনোটি অসাবধানতাবশত ফেলে দেওয়া আগুনের টুকরো থেকে সূত্রপাত হয়েছে, কোনোটি হয়েছে গ্যাসের চুলা থেকে আবার কোনোটি বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকেও সূত্রপাত। আবার এমন কিছু অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছিল যেগুলোকে নাশকতামূলক বলে ধারণা করা হয়েছে।

১৭ মার্চ বুধবার রাতে মোহাম্মদপুরের চানমিয়া হাউজিং সংলগ্ন বাঁশবাড়ী বস্তিতে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দুই শতাধিক কাঁচাঘর পুড়ে যায়। ঘটনাটি নাশকতামূলক সন্দেহে পুলিশ এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে।

১২ ডিসেম্বর রোববার রাতে রাজধানীর ডেমরায় লতিফ বাওয়ানী জুট মিলে আগুনে তিনটি গুদাম ঘর পুড়ে যায়। এ ঘটনায় ষড়যন্ত্র করে অগ্নিকান্ড ঘটানো হয়েছে ধারনা করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সহ দুইজনকে আটক করে পুলিশ।

২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে মিরপুর ১১ নং সেকশনের তালতলা বস্তিতে আগুনের ঘটনায় শতাধিক ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। মার্চের ১২ তারিখ শুক্রবার ভোরে রাজধানীর শাহআলী থানার উত্তর বিশিল এলাকায় অগ্নিকাণ্ডে কমপক্ষে দুইশ কাঁচাঘর পুড়ে যায়। এ ঘটনায় এক যুবক মারা যায়।

৬ এপ্রিল বিকেলে পল্লবী থানার রূপনগর বস্তিতে আগুন লেগে দেড় শতাধিক বস্তির কাঁচাঘর পুড়ে যায়। ৪ সেপ্টেম্বর রাতে হাজারীবাগ এলাকার চরঘাটা লেনের বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডে কমপক্ষে চঞ্চাশটি ঘর পুড়ে যায়।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।