ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

মৌলভীবাজার: আইনের প্রতি মানুষের অনীহা

মুনজের আহমদ চৌধুরী, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১০

মৌলভীবাজার: বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে নানা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নানা সময়ে বড় ধরনের সংঘাত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। এমনকি শতাধিক লোকজনের আহত হওয়ার নজিরও আছে।

তবে এসব ঘটনার বেশিরভাগই সমাধান হচ্ছে সালিশে। আইনে আশ্রয় নেওয়ার ব্যাপারটা কেউই আর ভাবছে না।

সংঘর্ষের জের ধরে চলে হামলা, পাল্টা-হামলা, দোকানপাটে লুটপাট এমনকি প্রতিপক্ষের বসতবাড়ীতেও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। মহাসড়ক অবরোধ করা হয়। এসব পাল্টা-পাল্টি হামলায় আহত অনেকে শারীরিকভাবে পঙ্গু হন, এমনকি মৃত্যু হয়।

কিন্তু দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে ব্যতিক্রম হলো সিলেট অঞ্চলে বড় রকমের এসব সংঘাত সংঘর্ষের ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে থানা বা আদালতে মামলা হয় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে মামলা হলেও সালিশে নিস্পত্তির পর বাদীপক্ষ মামলা প্রত্যাহার করে নেন। সামাজিক বিচারে নিস্পত্তি হয় এসব ঘটনা। আদায় হয় ক্ষতিপূরণ ও জরিমানাও। এসব সালিশী বৈঠকে পুলিশ প্রশাসনসহ আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতের নেতারাও সম্মিলিতভাবে বিচারের রায় দেন।

এসব বড় বড় সংঘাত ও সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা না করে সালিশী বৈঠকে নিস্পত্তি প্রসংগে মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ শনিবার বিকেলে বাংলানিউজকে বলেন, এ অঞ্চলে অনেক বড় মারামারি বা সংঘাত সংর্ষের ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রে মামলা দায়ের হয় না। আবার মামলা দায়ের হলেও সালিশী বৈঠকে নিস্পত্তির পর মামলা তুলে নেয় বাদী পক্ষ। আসলে সামাজিক সম্প্রীতির  কারণে বড় ঘটনাও সামাজিকভাবে নিস্পত্তি হচ্ছে।

মৌলভীবাজার-৩ (সদর-রাজনগর) আসনের এমপি, মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসীন আলী বাংলানিউজকে বলেন, এলাকায় থাকলে প্রতিদিনই অন্তত দু-তিনটি সালিশ বৈঠকে উপস্থিত থাকতে হয়। সাধারণ মানুষ মনে করে, আমরা সালিশী বৈঠকে বিচার করে দিলে ন্যায় বিচার পাবে। আমরাও আমাদের বিবেকের কাছে স্বচ্ছ থেকে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে সালিশে অনেক বড় ঘটনাও বাদী বিবাদীর মতের ভিত্তিতে মিমাংসা করে দেই। এতে যেমন সামাজিক অনুশাসন ও পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় থাকে আবার মানুষও সহজে কম সময়ে ন্যায় বিচার পায়। অনেক ক্ষেত্রে কোনো বিষয়ে এক বৈঠকে শেষ না হলে তা মীমাংসার লক্ষে পরবর্তীতে এক বা একাধিক তারিখ দেয়া হয়। ধার্য্য তারিখে বাদী-বিবাদী সহ সবাই উপস্থিত থেকে বিরোধ মিমাংসা করার লক্ষে আপ্রাণ চেষ্টা করেন।

মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নেছার আহমদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে সংঘর্ষে মানুষ মারা গেছে এমন ঘটনাও আমরা সামাজিক বিচারে বাদী ও বিবাদী উভয়পক্ষের ঐক্যবদ্ধ সিদ্বান্তের ভিত্তিতে মীমাংসা করে দিয়েছি। আমাদের এ অঞ্চলে সামাজিকতা ও পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সামাজিক বিচারের প্রতি মানুষের আস্থাশীলতার কারনে সেটি সম্ভব হয়েছে। সংঘাত সংঘর্ষে প্রতিপক্ষের হামলায় মানুষ মারা গেলে তো আর সেটার কোনো ক্ষতিপুরণ হয় না। তারপরও সান্তনা হিসেবে আসামীপক্ষের কাছ থেকে সালিশে জরিমানা আদায় করে তা ক্ষতিগ্রস্তদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তিনি আরও জানান, গত ত্রিশ বছরে মৌলভীবাজার জেলার সাত উপজেলায় পারিবারিক, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, এলাকার বিরোধ, গ্রামবাসীর রাস্তা নিয়ে বিরোধসহ নানা বিষয়ে প্রায় হাজারখানেক সালিশী বৈঠকে বিচারক হিসেবে উপস্থিত থেকে বিরোধ মিমাংসা করে দিয়েছি, এখনো দিচ্ছি। আর আমরা সালিশে মুরব্বিদের নিয়ে বিরোধ মিমাংসা করে দিলে সংশ্লিষ্ট কোন পক্ষই আর আদালতে বা থানায় যায় না। আমরা ন্যায় ও অন্যায় বিচার করে আমাদের বিবেকের বিচার বিবেচনায় রায় দেই।

মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও মৌলভীবাজর পৌরসভার বর্তমান মেয়র ফয়জুল করিম ময়ুন বাংলানিউজকে জানান, সালিশী বৈঠকে বিচার ব্যাবস্থায় সমাজের অসচ্ছল ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ন্যায় বিচার পাচ্ছে। আমরা বিচারে গেলে বাদী বা বিবাদী কোনো পক্ষের বাহনে ঘটনাস্থলে যাই না, যানবাহন নিজেরাই ব্যাবস্থা করি। আর বিরোধ নিস্পত্তির আগে সচ্ছতার স্বার্থে বাদী বা বিবাদী কোন পক্ষের বাড়ীতে এককাপ চা ও খাই না।

মৌলভীবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজিজুর রহমান শনিবার বিকেল সাড়ে তিনটায় বাংলানিউজকে জানান, সালিশী বৈঠকে বিরোধ মীমাংসার রীতিতে এ অঞ্চলের মানুষ বিশ্বাসী। আর মীমাংসার মানসিকতা থাকায় দেশের যেকোনো স্থানের চেয়ে মৌলভীবাজারে আইন শৃংখলার পরিস্থিতি ভাল। অন্যান্য জেলার চেয়ে এ অঞ্চলে মামলা দায়েরের হারও অনেক কম।

বাংলাদেশ সময়: ০৭০৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।