মৌলভীবাজার: এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম হাওর হাকালুকি ও শ্রীমঙ্গলের বাইক্কাবিলে শীতের শুরুতে আসা পরিযায়ী পাখি নিধনে তৎপর হয়ে উঠেছে হাওর তীরের ৬টি সংঘবদ্ধ চক্র। প্রতি বছরই ওই সংঘবদ্ধ চক্রের হাতে মারা যায় শত শত পাখি।
হাকালুকি হাওর তীরের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ঘিলাছড়া, জুড়ী উপজেলার বেলাগাঁও, বড়লেখা উপজেলার তালিমপুর ও সুজানগর এবং কুলাউড়া উপজেলার সাদিপুর এলাকায় সক্রিয় রয়েছে এসব পাখি শিকারি চক্র।
এদিকে, পরিবেশ অধিদপ্তর গত কয়েক বছরে হাকালুকি হাওরে পাখি নিধনের ঘটনায় ৮-৯টি মামলা করলেও পাখি শিকার বন্ধ থাকেনি। বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার বন্ধ থাকলেও হাওরের বিভিন্ন বিলে বিষটোপ দিয়ে পরিযায়ী পাখি নিধন অব্যাহত রয়েছে।
প্রশাসন এ ব্যাপারে কেবল পাখি শিকারিদের ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছে। বাস্তবে এতে কোনো সুফল মেলেনি। মাঝে মধ্যে দু’একজন শিকারি ধরা পড়লেও আইনের ফাঁকফোকরে তারা জামিনে মুক্তি পেয়ে ফের নামছে পাখি শিকারে।
হাকালুকি হাওরের পরিযায়ী পাখি নিধন বন্ধে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে মৌলভীবাজারের তৎকালীন জেলা প্রশাসক পাখি শিকারি ধরিয়ে দিলে আর্থিক পুরস্কার দেওয়া হবে মর্মে ঘোষণা দেন।
গত কয়েক বছর ধরে পরিবেশ অধিদপ্তরের অধীনে কোস্টাল অ্যান্ড ওয়েটল্যান্ড বায়োডাইভারসিটি ম্যানেজমেন্ট (সিডব্লিউবিএম) প্রকল্পের কাজ চলায় শিকারিরা অনেকটা লুকিয়ে বিষটোপে পাখি শিকার করতো। কিন্তু চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে শেষ যাচ্ছে এ প্রকল্পের মেয়াদ। এর আগেই হাওর অঞ্চলে উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেছে পরিযায়ী পাখি শিকার।
প্রকল্প কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, এ প্রকল্পের মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের অধীনে সিডব্লিউবিএম প্রকল্পের কার্যক্রম চলায় গত কয়েক বছরে পাখি শিকার কমে গিয়েছিল। এ সময় শিকারিরা বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার করতে পারতো না। অনেকটা লুকিয়ে বিষটোপে পাখি শিকার করতো তারা। কিন্তু ডিসেম্বরে মাসে এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে পাখি শিকার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা।
হাকালুকি হাওরে সিডব্লিউবিএম প্রজেক্টের বিদায়ী কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও হাওর রণাবেণের জন্য তাদের গঠিত ২৮টি ভিসিজি (ভিলেজ কনজারভেটিভ গ্র“প) কমিটি রয়েছে। এই ২৮টি কমিটিতে মোট ৯৫৩জন সদস্য রয়েছেন যারা নিজ উদ্যোগে হাওরের বিষয়গুলো দেখবেন। শুধু পাখি শিকার বন্ধ নয়, তারা হাওরের পরিবেশ রায়ও সচেতন থাকবেন।
সিডব্লিউইবএম প্রজেক্টের পাখি বিশেষজ্ঞ বশির আহমদ বাংলানিউজকে জানান, প্রকল্প মেয়াদ চলাকালে পাখি শিকারের অভিযোগে বন্য এবং পরিবেশ আইনে ৮-৯টি মামলা হয়েছে। যেসব আসামি ধরা পড়েছে তাদের পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজন হাতেনাতে আটক করে থানায় সোপর্দ করেছে।
তবে আসামিরা আদালত থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে এসে আবার পাখি শিকার শুরু করার বিষয়টি স্বীকার করেন তিনি।
তিনি বলেন, প্রশাসন কঠোর হলে পাখি শিকার রোধ করা খুব কঠিন বিষয় নয়।
মৌলভীবাজার বায়োভারসিটি কনজারভেশন গ্রুপের কো-চেয়ারম্যান হাসানাত কামাল গত বুধবার বাংলানিউজকে জানান, জাতিসংঘ ২০১০ সালকে ‘বায়োডায়ভারসিটি ইয়ার’ ঘোষণা করেছে।
তিনি জানান, জীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। আর সারা দেশের মধ্যে মৌলভীবাজার জেলা সবচেয়ে জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। পাহাড়ঘেরা অরণ্যের পাশাপাশি এখানে আছে হাওর, নদী, খাল ও অসংখ্য বিল।
হাসানাত কামাল জানান, মৌলভীবাজারের হাকালুকি ও বাইক্কাবিলে প্রতি বছর লাখ লাখ পাখি আসে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পাখি শিকারিরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা বিষটোপ দিয়ে নিয়মিত পাখি শিকার করছে।
তিনি অভিযোগ করেন, প্রশাসন পাখি শিকার বন্ধে পুরস্কার ঘোষণাসহ নানা উদ্যোগ নিলেও সে সব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আর এ কারণে পাখি শিকারিরা দেদারসে পাখি শিকার করছে।
তিনি বলেন, ‘পাখি শিকার বন্ধে প্রশাসনকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। ’
এ প্রসঙ্গে মৌলভীবাজার বায়োডাইভারসিটি কনজারভেশন গ্রুপের চেয়ারম্যান সেলিম আহমদ বাংলানিউজকে জানান, সর্বশেষ গত শুক্রবার তার সংগঠনের হস্তক্ষেপে পুলিশের সহায়তায় মৌলভীবাজার শহরে পাখি শিকারিদের খাঁচা থেকে ছয়টি পাখি উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারের পরে খাখিগুলো অবমুক্ত করা হয়।
তিনি বলেন, ‘এভাবে পাখি শিকার চলতে থাকলে এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে। ’
প্রশাসনের তৎপরতার মুখে পাখি শিকার অনেকটাই এখন কমে এসেছে দাবি করে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পুরোপুরি বন্ধ করতে সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। ’
বাংলাদেশ সময়: ২৩৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৫, ২০১০