ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্টের আসামির সঙ্গে এএসপি-ওসির রুদ্ধদ্বার বৈঠক

‘ওয়ারেন্ট থাকলে গ্রেপ্তার করা হবে’

তানভীর হোসেন, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১০
‘ওয়ারেন্ট থাকলে গ্রেপ্তার করা হবে’

নারায়ণগঞ্জ: নূর হোসেন ওরফে হোসেন চেয়ারম্যান। ২০০৭ সালে পলাতক থাকাকালে তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল রেড অ্যালার্ট জারি করেছিল।



অথচ পিস্তলসহ ধরা পড়া এক আসামিকে ছাড়িয়ে নিতে বৃহস্পতিবার রাতে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় এএসপি জিয়াউল হাসান ও ওসি বদরুল আলমের সঙ্গে দিব্যি রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন তিনি।

ইন্টারপোলের ওয়েবপেজ ঘেঁটে শুক্রবার দুপুর আড়াইটায় নূর হোসেন সম্পর্কে  জানা গেল, সশস্ত্র অপরাধ, হত্যা এবং অঙ্গহানিসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব অপরাধ কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টারপোল তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।

ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, ‘যদি তার ব্যাপারে কোনও তথ্য আপনার জানা থাকে, তবে নিকটস্থ থানায় অথবা ইন্টারপোল মহাসচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। ’

বিষয়টি জানিয়ে নারায়ণগঞ্জ পুলিশের এএসপি (ক অঞ্চল) জিয়াউল হাসানকে প্রশ্ন করা হলে শুক্রবার দুপুরে তিনি বাংলানিউজকে জানান, ইন্টারপোলের ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিকে অবশ্যই গ্রেপ্তার করা হবে।

তাদের কাছে এ ধরনের নির্দেশ রয়েছে বলেও স্বীকার করলেন তিনি।
    
তবে এরপরই এ প্রতিবেদক এএসপি জিয়াউল হাসানকে যখন জানালেন যে, গত বৃহস্পতিবার রাত ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় অস্ত্রসহ এক আসামি গ্রেপ্তারের ঘটনায় ইন্টারপোলের রেড ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি নূর হোসেনের সঙ্গে তিনি (জিয়াউল) নিজেই তো একটানা ৩ঘণ্টা বৈঠক করেছেন- তখন অস্বস্তিতে পড়ে যান এই পুলিশ কর্মকর্তা।

তবে পরক্ষণেই তিনি দাবি করেন, তিনি ওই আসামিকে চেনেন না। আর নূর হোসেন সম্পর্কে তিনি কিছু জানেনও না।

তিনি জানান, বৃহস্পতিবার রাতে একটি অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় তিনি  থানায় ছুটে যান। পরে তিনি আসামি ও অভিযোগকারীর সঙ্গে আলোচনা করেন। এসময় থানায় কিছু লোকজন ছিল। কিন্তু তাদের কাউকেই তিনি চিনতেন না বা তাদের সম্পর্কে জানতেন না।

আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি নূর হোসেনের পুরো বিষয়টি সিদ্ধিরগঞ্জ থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম বদরুল আলম জানেন বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

তবে শেষ পর্যন্ত জিয়াউল হাসান বলেন, ওয়ারেন্ট থাকলে পুলিশ অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে। এ ব্যাপারে তিনি ওসির সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন বলেও অঙ্গীকার করেন।

সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি এস এম বদরুল আলমের সঙ্গে একই দুপুরে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘নূর হোসেন সবক’টি মামলায় জামিনে রয়েছেন। সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় তার বিরুদ্ধে কোনও ওয়ারেন্ট নেই। ’

এছাড়া নূর হোসনের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্ট সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন। ওসি আরও জানান, নূর হোসেন ছাড়াও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা বৃহস্পতিবার রাতের ওই বৈঠকে  ছিলেন।

এ ব্যাপারে ওই বৈঠকে উপস্থিত সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইয়াছিন মিয়া বাংলানিউজকে জানান, জেলা জাতীয় পার্টি নেতা মোহাম্মদ আলী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান ও তাকেসহ অন্যান্যদের থানায় ডেকে নিয়ে যান।

তিনি আরও জানান, তারা তিন ঘন্টা থানায় অবস্থান করেন। ওই সময়ে তিনি নূর হোসেনকে দেখতে পান। এর বেশি কিছু বলতে তিনি রাজি হননি।

উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার রাতে নারায়ণগঞ্জ জেলা জাতীয় পার্টির (এরশাদ) সহ-সভাপতি ও জাপার সহযোগী সংগঠন শ্রমিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি মোহাম্মদ আলীর পুত্র রনিকে একটি বিদেশি পিস্তলসহ আটক করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানায়, আটক করার পরপরই রনিকে ছাড়িয়ে নিতে দলবল নিয়ে নূর হোসেন উপস্থিত হন সিদ্ধিরগঞ্জ থানায়। ছিলেন রাত ৮টা হতে ছিলেন ১১ টা পর্যন্ত।

এর মধ্যে কথা বলেছেন থানার ওসি এস এম বদরুল আলমসহ অন্যদের সঙ্গে। রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে। চেষ্টা করেছিলেন চাপ প্রয়োগ করে রনিকে ছাড়িয়ে নিতে ও পুরো ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে।

সূত্র আরও জানায়, বৈঠকের মাঝখানে নূর হোসেন একাধিকবার ওসির ক থেকে বের হয়ে বাইরে অপোমাণ অনুগত লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। ধূমপান করেছেন।

তবে সাংবাদিকরা থানায় উপস্থিত এ খবর জানার পর নিজেকে বারবার আড়ালে রাখার চেষ্টা করেন হোসেন চেয়ারম্যান। একপর্যায়ে থানায় সংবাদকর্মীদের অনড় অবস্থানের কারণে রনিকে ছড়িয়ে নেওয়ার উদ্যোগ ভেস্তে যায় তাদের।

থানায় নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত উপস্থিতি নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। তবে সিদ্ধিরগঞ্জ পুলিশ মুখ রাখার জন্য বলছে, কোনও ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিগত চারদলীয় জোট সরকার ও পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নারায়ণগঞ্জ জেলাপুলিশ ও র‌্যাবের তালিকার শীর্ষে ছিল নূর হোসেনের নাম। কিন্তু মহাজোট সরকার মতায় আসার পর সেই নাম বিয়োজন হলেও এখনো তিনি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের অঘোষিত নিয়ন্ত্রক বলে এলাকাবাসীর মন্তব্য।

নূর হোসেনের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায়। কিন্তু এখন তিনি থাকেন ঢাকাতে।

প্রসঙ্গত, নূর হোসেনের বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লা থানায় বিভিন্ন অপরাধে ১৩টি মামলা রয়েছে। তবে  সবগুলো মামলায়ই বর্তমানে তিনি জামিনপ্রাপ্ত।

২০০৭ সালের ১২ এপ্রিল আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল নূর হোসেনের বিরুদ্ধে রেড অ্যালার্ট জারি করে।


কে এই নূর হোসেন

সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল টেকপাড়া এলাকার মৃত হাজী বদরউদ্দিনের ছেলে নূর হোসেন। ট্রাকের হেলপার থেকে এক সময় ট্রাকচালক হন। ১৯৯২ সালের ১৮ জুন শিমরাইলে ট্রাক শ্রমিকদের একটি সংঘর্ষের ঘটনায় নূর হোসেন নিজে বিপুল পরিমাণ বিষ্ফোরকের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আলোচনায় আসেন।

সেসময়ে কৃষকলীগ নেতা গিয়াস উদ্দিনের (বর্তমানে বিএনপি নেতা ও সাবেক এমপি) সহযোগিতায় সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ মতায় আসার পর রিকশাচালক আলী হোসেন ও যুবলীগ নেতা আব্দুল মতিনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেন বলে অভিযোগ আছে তার নামে।  

পুলিশ, এলাকাবাসী ও মামলাসূত্রে জানান যায়, এরপর থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্র, পরিবহন সেক্টর, আন্তঃজেলা ট্রাক টার্মিনাল, নারায়ণগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের শিমরাইল অফিস, সিদ্ধিরগঞ্জ ইউপি পরিষদের সব ঠিকাদার জিম্মি হয়ে পড়েন নূর হোসেন ও তার বাহিনীর সদস্য শাহজালাল বাদল, আমান, মেম্বার বাতেন, নূরউদ্দিন, সেলিম, মিজান, সিরাজ, চঞ্চল, বাবুল, শিপন, বাদল, জজ মিয়া, মামুনদের কাছে।

অভিযোগ রয়েছে, এরপর থেকে বেপরোয়া টেন্ডার বাণিজ্য, নৌপথে চাঁদাবাজি, শিমরাইলের সওজ অফিসে হামলা করে নির্বাহী প্রকৌশলীর রুম দখল, ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ডাকাত লাইমুদ্দিনকে হত্যার ঘটনার মধ্য দিয়ে নূর হোসেন বাহিনী এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করে।

নূর হোসেনের ছোট ভাই নুরুজ্জামান জজ সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় পরিচিত ‘ছোট মিয়া’ নামে। তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে কাঁচপুরের ওয়াপদা কলোনি থেকে শুকরসী পর্যন্ত প্রায় ১০ একর এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদী দখল করে পাথর ও বালুর ব্যবসা। এখান থেকে মাসে ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা আয় করছে জজ সিন্ডিকেট।

ইন্টারপোলের বিবরণ:
আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল তাদের ওয়েবসাইটে নূর হোসেনের বিরুদ্ধে যে রেড অ্যালার্ট জারি করে তাতে তার সম্পর্কে কিছু বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, তার জন্ম ১ মার্চ ১৯৭৫।   উচ্চতা লেখা হয়েছে, ৩২ বছর, উচ্চতা ১.৬৫ মিটার বা ৫৬ ইঞ্চি, ওজন ১৫৪ পাউন্ড বা ৭০ কেজি উল্লেখ করা হয়।

বাংলাদশে সময়: ১৭০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।