ঢাকা: কারবালায় ইমাম হোসেনের শহীদত্বকে স্মরণ করে আশুরা পালনের জন্য শুক্রবার রাজধানীর পুরান ঢাকা, মোহাম্মদপুর, জিগাতলাসহ বিভিন্ন এলাকায় নেমেছিলো শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের ঢল। কয়েক দিন ধরেই মাতমের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো মানুষ।
পুরান ঢাকার নাজিরাবাজার, ১ নম্বর হোসেনী দালান রোড ও ফরাশগঞ্জ এলাকায় বসেছিলো বাহারী মেলা। হোসেনী দালান রোডের শুরুতে মীর ইয়াকুব ইমামবাড়ার সামনে থেকে রাস্তার দু’পাশে চুড়ি-ফিতা, মন্ডা-মিঠাই, খেলার সামগ্রী, গৃহস্থালি তৈজসপত্র, বড় বড় গলদা চিংড়ির বেসনে ভাজা মাথাসহ বিভিন্নরকম খাদ্যদ্রব্যের অস্থায়ী দোকান দেখা গেছে। একই রকম মেলা বসেছিলো সদরঘাট সংলগ্ন এলাকা বিকে দাশ রোডেও। ইতিহাস অনুযায়ী, সেই মুঘল শাসনামল থেকেই আশুরা উপলক্ষে এরকম মেলা বসছে ঢাকা নগরীতে।
ভ্যানগাড়িতে করে মন্ডা-মিঠাই বিক্রি করছিলেন মোনেম শাহ (৩৯)।
তিনি জানালেন, সারাদিন প্রায় দুই হাজার টাকা বেচা-কেনা করেছেন। সাধারণত ৭ থেকে ১০ দিন সময়ে তার যে পরিমাণ বিক্রি হয়, আজ একদিনেই তা ছাড়িয়ে গেছে। আলাপচারিতার এ পর্যায়ে তার ‘আরো হাজারখানেক টাকার মিঠাই বিক্রির ইচ্ছে আছে’ জানিয়েই ঝুঁকে পড়লেন অপর এক ক্রেতার দিকে।
১০/১ বিকে দাশ রোডের বিবিকা রওজা’র আশপাশে মানুষের ভিড় জমা শুরু হয় জুম্মার নামাজ শেষ হওয়ার পর থেকেই। আড়াইটা নাগাদ লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে বিবিকা রওজা এলাকা। এ সময় রওজা’র মূল প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর শুরু হয় দরজার ভেতরে সাজিয়ে রাখা তাজিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ডুলি’র উদ্দেশে ধর্মভীরু জনতার ভেট গ্রহণ।
বিকেল সাড়ে চারটায় এখান থেকে ২০ ফুট উঁচু ডুলি বের হয়। রঙিন কাপড় আর জরি দিয়ে সাজানো ছোট্ট ঘরসদৃশ এ জিনিসটিকে কেন্দ্র করেই তাজিয়া মিছিল এগিয়ে চলে। মিছিলের প্রথমভাগে ছিলো অল্পবয়সীদের হৈ-হুল্লোড়। এরপরে চলছিলো অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সী কিশোরদের মুখে আগুন নিয়ে খেলা দেখানোর মহরত। এরপরে মূলত মুসল্লিরা নিজের বুক চাপড়াতে চাপড়াতে এবং ‘ইয়া হোসেন-ইয়া হোসেন’ বলে মাতম করতে করতে ধীরলয়ে হাঁটছিলেন। ডুলি টেনে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো এরপর।
মিছিলের সঙ্গী কাজল আহমেদ জয় (২৪) বাংলানিউজকে জানান, কারবালা ময়দানের নিষ্ঠুরতার সঙ্গে পৃথিবীর আর কোনো নৃশংসতার তুলনা চলে না। আল্লাহ নিজে সেই নিষ্ঠুরতার বিচার করেছেন। মুয়াবিয়াপুত্র ইয়াজিদকে বরণ করে নিতে হয়েছিলো করুণ মৃত্যু।
এ মাতম-মিছিল চাুস করতে আশপাশের রাস্তা ও বাড়ির ছাদে অগণিত মানুষকে ভিড় করতে দেখা গেছে। মিছিল পার হওয়ার সময় ভেজা চোখ মুছতে মুছতে ‘ইয়া হোসেন’ রবের সঙ্গে গলা মেলাতে শোনা যায় অনেক সুন্নী মুসলিমকেও।
শ্যমবাজার থেকে শুরু হওয়া এ মিছিল নর্থব্রুক হল রোড, জুবিলী সুপার মার্কেট হয়ে হোসেনী দালান রোডের ভেতর দিয়ে আজিমপুর হয়ে জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডে এসে শেষ হয়। এখানে ধানমণ্ডি লেক সংলগ্ন কারবালা জায়গাটিতে এসে ডুলি মাটিতে নামিয়ে রাখা হয়। এ সময় উপস্থিত সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ৬১ হিজরির এই দিনে ইরাকের ফোরাত নদী তীর সংলগ্ন কারবালা ময়দানে শহীদ ইমাম হোসেনের (রা.) কথা স্মরণ করে বুক চাপড়ে মাতম শুরু করেন।
ইমাম হোসেন ছিলেন মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র। কারবালার যুদ্ধে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন তিনি।
ইসলামের বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, হিজরি সনের প্রথম মাস মহররমের দশম দিনটি পালন করা হয় আশুরা হিসেবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৫, ডিসেম্বর ১৭, ২০১০