জাতীয় স্মৃতিসৌধ থেকে: জাতীয় স্মৃতিসৌধের মূলবেদীতে যাবার পথেই মাঝ বরাবর একটি ফলকে আটকে যায় দৃষ্টি।
‘বীরের রক্তস্রোত, মাতার অশ্র“ধারা সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা/ স্বর্গ কি হবে না কেনা...’- বিজয়ের ৪০ বছরে স্মৃতিসৌধে লাখো মানুষের ঢল বিনম্র শ্রদ্ধা, আর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের নিরবে অশ্র“ বিসর্জন আর স্মৃতির বেদী ফুলে ফুলে ভরে ওঠার দৃশ্য বলে দিচ্ছিলো জাতি ভোলেনি তাঁর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের।
পৌষের তীব্র শীত আর ঘন কুয়াশা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। হৃদয়ের সব পথ মিশে গেছে একপথে। জাতীয় স্মৃতিসৌধে। ভোরের আলো ফোটেনি তখনো। তবে মানুষের সমারোহে যেন আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে ওঠে প্রকৃতি।
স্মৃতিসৌধের ভেতরে তখন চলছে রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা। আর কনকনে সেই শীতে স্মৃতিসৌধে প্রবেশের অপোয় তখন লাখো মানুষ। বিভিন্ন ব্যানার আর প্লাকার্ড হাতে নিয়ে দাড়িঁয়ে থাকা এসব মানুষের মুখে তখন ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই’, ‘বিজয় দিবস অমর হোক’, ‘রাজাকারমুক্ত দেশ চাই’ প্রভৃতি স্লোগান। দৃষ্টিতে তাদের বিজয়ের উল্লাস। সেই উল্লাসে যেন পরিণত হয় উচ্ছ্বাসে, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সাকা চৌধুরীর গ্রেপ্তারের খবরে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিসৌধ থেকে বের হবার পরপরই সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় স্মৃতিসৌধ। তারপর জোয়ারের মতো লাখো মানুষের ঢেউ আছড়ে পড়ে স্মৃতিসৌধে। নারী, পুরুষ, তরুণ, কিশোর শিশু সবার মিছিল তখন স্মৃতিসৌধে মূল বেদীর দিকে।
হাতে ব্যান্যার, মাথায় বাঁধা লাল-সবুজের পতাকা। শিশু, কিশোর আর তরুণদের গালে পতাকা আঁকা।
সবকিছ্রু সম্মিলনে গোটা স্মৃতিসৌধে ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের আমেজ।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বীরেন শিকদার বললেন, ‘স্মৃতিসৌধে প্রাণের উচ্ছ্বাস দেখে ভালো লাগছে। তরুণ প্রজন্মের উপস্থিতি, উন্মাদনা একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশেরই পথ দেখায়। ’
ডেমরা থেকে এসেছেন বর্ষীয়ান মন্তাজ উদ্দিন। অনেক কষ্টে ভিড়ে ঠেলা ধাক্কা খেয়ে পৌঁছেছেন মূলবেদীর কাছে। তাতে-ও যেন বিন্দুমাত্র কান্তি নেই এই প্রবীণের চোখেমুখে। বললেন, যে কটা দিন বেঁেচ আছি তার মাঝে যেন বছরের এই দিনটির জন্যে মন ছটফট করে।
মুক্তিযুদ্ধে অল্পের জন্যে বেঁেচ যাবার স্মৃতিচারণ করে বললেন, আমিও তো মারা যেতে পারতাম। তাই যাদের জীবনের বিনিময়ে এখনো বাংলার মাটিতে বেঁেচ আছি সেই নাম না জানা অসংখ্য শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বছরের এই দিনটির জন্যে এক রকম ব্যাকুলতা থাকে।
তবে কিছুটা থেমে হতাশা ছড়ালেন এই প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা। বললেন, ‘যেমন দেশ চেয়েছিলাম তা পাইনি। চল্লিশ বছর তো চলে গেলো আর কতো অপো করতে হবে সেই স্বপ্নের দেশের জন্যে। ’
গাজীপুরের মাওনা থেকে এসেছেন কলেজছাত্র শফিক আহমেদ। বললেন, ‘বন্ধুদের নিয়ে ভোরে রওনা হয়েছিলাম তবে বাস পেয়ে এখানে আসতে সাড়ে ১০ টা বেজে গেছে। ’ জানান, ভোরের সিগ্ধ আলোয় শ্রদ্ধা জানাতে না পেরে খারাপ লাগছে। দাবি তুললেন, ‘অনেক কথা হয়েছে এবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হোক। ’
সাভারের একটি বেসরকারি কলেজের শিকিা সেহরিন আরিফ বেদিতে টকটকে একটি গোলাপ দিয়ে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকলেন নিরবে । পেছনের ঠেলা ধাক্কা যেন ভাঙ্গাতে পারেনি তার মৌনতা।
বাংলানিউজকে তিনি বললেন, ‘জন্মের পর বাবাকে দেখিনি। এই দেশের জন্যে আজ আমি বাবা হারিয়েছি, তাতে কষ্ট না বরং গর্ব হয়। তবে লজ্জিত হই যুদ্ধাপরাধীদের আস্ফালন দেখে। ’
সাড়ে পাঁচ বছরের ছোট্র ফারহানা তাসনিম পড়ে ঢাকার একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। কপালে লাল সবুজের ব্যান্ড আর হাতে একগুচ্ছ গোলাপ।
বাবার কোলে থেকেই বললো, ‘ফুল দিতে এসেছি, আমি ওদের ভালোবাসি। ’
লাখো মানুষের এই উচ্ছ্বসে চোখে পড়লো বেশ কিছু ভিনদেশিকেও।
কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ক্যাটরিন ওলে সহপাঠি এক বন্ধুকে নিয়ে এসেছিলেন জাতীয় স্মৃতিসৌধে।
বললেন, ‘তোমাদের এত দেশপ্রেম, তোমাদের তো আরো এগিয়ে যাবার কথা। ’
মুক্তিযোদ্ধা কায়কোবাদ শরিফ বললেন, ‘আমরা দেশকে শক্রমুক্ত করেছিলাম, দেখবেন আগামী প্রজন্ম ঠিকই এদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে অনেক দূর। সেই স্বপ্নের দেশ দেখার অপোয় বেঁচে আছি এখনো। ’
বাংলাদেশ সময় ১৫০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১০