ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

হাসিনার বাড়িতে কাজ করে খেতে চান মুক্তিযোদ্ধা ভানুনেছা

জাকিয়া আহমেদ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১০
হাসিনার বাড়িতে কাজ করে খেতে চান মুক্তিযোদ্ধা ভানুনেছা

ঢাকা: জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাড়িতে কাজ করে খেতে চান মুক্তিযোদ্ধা ভানুনেছা।

গত ৬ নভেম্বর বাংলানিউজকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ভানুনেছা নিজের এ সুপ্ত আকাক্সার কথা জানান।



কান্না জড়ানো কণ্ঠে এ প্রতিবেদকের দু’হাত চেপে ধরে বলেন, ‘আমার হাসিনার কাছে একটু বইলো সে আমার বোন। আমি তার সাথে দেহা করতে চাই। আমি তার বাসায় কাইজ কইরা খাইতে চাই। ’

বয়স ৭০ পেরিয়েছে তাও প্রায় ৫ বছর হলো। বয়সের ভারে ন্যুব্জ ভানুনেছা এখন ঠিকমতো কথাও বলতে পারেন না। অন্যের সাহায্য ছাড়া চলাফেরার শক্তিও হারিয়েছেন। অথচ এই ভানুনেছাই পাবনা জেলার একমাত্র নারী, যিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে প্রবল বিক্রমে লড়াই করেছেন।

যুদ্ধের সময় ৩৫ বছরের ভানু ছিলেন এক পুত্র আর এক কন্যা সন্তানের জননী।

স্বামী-সন্তান-সংসার ফেলে কেন যুদ্ধে গেলেন-এমন প্রশ্নে ভানুনেছার জবাব, ‘নিজের সন্তানের জন্য মায়া কইরছিলাম না, দেশের সন্তানের জন্য মায়া কইরছিলাম। ’

যুদ্ধের কথা মনে আছে কি-না জানতে চাইলে কিছুটা চুপ থাকেন ভানু। তবে বেশিক্ষণ না, ‘যুদ্ধের কথা মনি নাই? যুদ্ধের জন্য মাথার রক্ত দিছি, আর বলো যুদ্ধের কতা মনি থাকবি না?’

এরপর একে একে বলে গেলেন রণাঙ্গনের নাম। পাবনা শহরের ধুলাউড়ি, ধোপাদহ, রাজাই প্রামাণিকের বাড়ি। যুদ্ধের সময় এসব অঞ্চল অস্ত্র হাতে চষে বেরিয়েছেন তিনি। সম্মুখ সমরে ঘায়েল করেছেন শত্রু সেনাদের। প্রয়োজনের সময় জানবাজি রেখে সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে হাসিমুখে এগিয়ে গেছেন।

এসব বলতে বলতে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন ভানুনেছা।

তিনি বলেন, যুদ্ধের শেষের দিক হবে। তারিকটা মনে হয় ৭ তারিখ (ডিসেম্বর)। ওইদিন মুক্তিযোদ্ধারা সাঁথিয়া থানা দখল কইরা নেয়। থানা থিক্যা প্রায় দেড় মাইল পশ্চিমে কোনাবাড়িয়া সেতুর কাছে হানাদার বাহিনীরে আমরা (মুক্তিযোদ্ধা) আক্রমণ করে। টিকপার না পাইরা হানাদার বাহিনী তাগো ২ টা গাড়ি রাইখ্যা থানা ছাইড়ে পালায়ে যায়।

এর এক দিন পরই হানাদার বাহিনী আবার থানা দখল করার জন্য হামলা চালায়। এটা ছিল ৯ ডিসেম্বর।

পাক সেনাদের থানা অভিমুখে এগিয়ে আসার খবরে মাধবপুর বেড়া সড়কের জোড়াগাছা ও নন্দনপুরের মাঝে একটি ব্রিজের কাছে অবস্থান নেন মুক্তিযোদ্ধারা।

মুক্তিযোদ্ধারা বোমা মেরে ব্রিজটি উড়িয়ে দেন। পাক সেনারা অবিরাম গুলি চালাতে থাকে। পিছিয়ে থাকে না মুক্তিযোদ্ধারাও। পাল্টা গুলি চালায়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সেদিন খুব বেশি গোলা বারুদ ছিল না। খুব তাড়াতাড়িই তাদের গুলি ফুরিয়ে যেতে থাকে।

বিষয়টি টের পেয়ে পাক হানাদার বাহিনী সামনে এগুতে থাকে। গোলাবারুদহীন মুক্তিযোদ্ধারা অসহায় হয়ে পড়েন। সমূহ বিপদের আশঙ্কায় তারা দিশেহারা।

এ সময় ত্রাণকর্তার ভূমিকায় দেখা দেন ভানুনেছা। সহযোদ্ধা এক মুক্তিযোদ্ধার নির্দেশে ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরের সাঁথিয়া থানায় গিয়ে গুলি ফুরিয়ে যাওয়ার খবর দেন মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে।

থানা থেকে গুলি ও অস্ত্রের বোঝা নিয়ে আবার ছুট দেন ব্রিজের দিকে। কোমরে এবং মাথায় অস্ত্রের বোঝা নিয়ে ক্রলিং করে পৌঁছে যান যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে।

এ সময় হঠাৎ করেই পাক সেনাদের ছোঁড়া একটি গুলি এসে লাগে ভানুনেছার কপালে। এখনও সে গুলির দাগ যুদ্ধের স্মৃতি চিহ্ন হিসাবে রয়ে গেছে।
 
মুক্তিযুদ্ধের ৩৯ বছর পেরিয়ে গেছে। একাত্তরের দামাল তরুণী ভানুনেছা এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ।
 
দেশ স্বাধীন করেছেন, দেশ আপনাকে কী দিয়েছে-এমন প্রশ্নে সহসা খেই হারিয়ে ফেলেন তিনি। তবে বেশিক্ষণ সে অবস্থা থাকে না। নিজেকে সামলে বলেন, ‘আমি তো দেশ থিক্যা কিছু চাই নাই। দেশ স্বাধীন হইছে, এতেই আমাগো শান্তি। ’
 
আরও বলেন, এতো দিন তো মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। কাজ কইরা খাইতাম, দিন মজুরি করতাম। কিন্তু এহানকার সাম্বাদিকরা আমারে খুঁইজা বাইর করলো। তারা আামারে ভিজিএফ কার্ড কইরা দিলো।

হাসিনা সরকার এর আগের বার ৩০০ টাকা কইরা দিতো। এহন টুকু মন্ত্রী (স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু ) মাসে ২ হাজার কইরা টাকা দেয়। এহন আগের চাইয়ে একটু ভালো আছি।
 
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ভূমিহীন হিসেবে ভানুনেসাকে এক খণ্ড জমি দিলেও চার দলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসলে জমিটা বেদখল হয়ে যায়। তবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এলে দখলবাজরা নিজে থেকেই জমি ছেড়ে দেয়।

ভানুনেছা বলেন, ‘পাবনার ডাক্তাররা আমারে মায়ের মতো জানে। আমার কিছু হইলে তারা পাগল হয়ি যায়। আমারে বলে মা, আপনি কোনও চিন্তা কইরবেন না, আমরা আপনেরে ভালো কইরা তুইলবাম। ’
 
ভানু নেছা বলেন, শুধু অস্ত্র না, হ্যাগো লেইগগা খাওনও লইয়া গেছি মাটিতে ভর দিয়া দিয়া।

 ভানুনেছা বলেন, ‘সেই সময় এহানে সাত্তার রাজাকার খালি আমাগো লোকজনরে ধরাইয়া দিতো। ’
 
১২ বছর আগে ভানুনেছার স্বামী মারা গেছে। ২ ছেলে ২ মেয়ে, সবার বিয়ে হয়েছে। এখন ভানুনেছার দিন কাটে একাকী, নিঃসঙ্গ।

বাংলাদেশ সময়: ১৯২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।