ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

সংবাদ সম্মেলনে ইউনূস

যা হয়েছে হয়েছে..

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১০
যা হয়েছে হয়েছে..

ঢাকা: দারিদ্র বিমোচন তহবিলের টাকা চুক্তির বরখেলাপ করে গ্রামীণকল্যাণ নামের একটি লাভজনক খাতে সরিয়ে নেওয়ার তথ্য ফাঁস হওয়ার ১২ দিন পর মুখ খুললেন গ্রামীণব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ‘ কারো সাথে লড়াইয়ে যেতে চাচ্ছি না।

যা হয়েছে হয়েছে , এখন সামনের দিকে এগোতে হবে’--একথা  বলে আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা এড়িয়ে গেলেন। গ্রামীণব্যাংকের বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ বেমালুম অস্বীকার করলেন। তবে সাংবাদিক সম্মেলন করে দুষলেন বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমকে।

রাজধানীতে গ্রামীণব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে কাঁটায় কাঁটায় বেলা ১২টার সময় ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী ড.ইউনূস সংবাদ সম্মেলন করে সাংবাদিকদের সঙ্গে বসেন।

ড. ইউনূস তহবিল স্থানান্তরে অনিয়মের ব্যাপারটি সরাসরি স্বীকার না করে বলেন,‘নোরাডের টাকা নিয়ে যা হয়েছে গ্রামীণব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক হয়েছে এবং এতে নোরাড ছাড়া অন্য কারো আপত্তি ছিল না। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকও আপত্তি করেনি। যে কাজে এই অর্থ এসেছে সেই কাজেই ব্যবহৃত হয়েছে। ’

তিনি বলেন, ‘ এ নিয়ে আমরা বিতর্কে যেতে পারতাম কিন্তু তা করিনি। এ অভিযোগ কেন উঠেছে তাও বলতে পারবো না। এখন সবার সহযোগিতা চাচ্ছি। কারো সাথে লড়াইয়ে যেতে চাচ্ছি না। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দারিদ্র্য, স্বাস্থ্যসহ দেশের অনেক সমস্যা রয়েছে এগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। যা হয়েছে হয়েছে , এখন সামনের দিকে এগোতে হবে। ’

নোরাডের দেওয়া অর্থ স্থানান্তর সংক্রান্ত ঘটনাটি নোবেল পুরস্কারের মানদণ্ডের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ কিনা- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই সঙ্গতিপূর্ণ। ’

তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তহবিল স্থানান্তরের সঙ্গে কর ফাঁকির কোনো বিষয় সম্পৃক্ত কিনা?

জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ‘কর ফাঁকির কোনো বিষয় ছিল না। যেকোনো ব্যবসায় খরচ কমানোর জন্য কতগুলো পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আমিও সেই বিষয়টি মাথায় রেখে আমার প্রতিষ্ঠানের খরচ কমানোর ও আয় বাড়ানোর জন্য যা করা প্রয়োজন তাই করেছি। ’

নরওয়ের তহবিল নিয়ে অভিযোগ ওঠার পর দেশের গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে বারবার যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য না পাওয়া সম্পর্কে বলেন, ‘এক্ষেত্রে আমার যোগাযোগের কিছুটা ঘাটতি ছিল। তবে এ সংক্রান্ত কাগজপত্র আমি সংবাদ মাধ্যমে দিয়েছি। ’

এজন সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেন, ডেনমার্কের যে সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রনির্মাতা গ্রামীণব্যাংকের তহবিল স্থানান্তর ও ুদ্রঋণের নেতিবাচক দিক  নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছেন বারবার যোগাযোগ করার পরও আপনি কেন তার সঙ্গে কথা বলেননি?

জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ‘দেশের বাইরে ছিলাম, ব্যস্ততাও ছিল। ’

তিনি বলেন, ‘নরওয়ের মন্ত্রী বলেছেন- গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে তাদের কোনো দায়দেনা নেই। বিষয়টি অনেক আগেই মীমাংসা করা হয়েছে। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে দ্বিমত হয়েছিল। আমার মতে বেস্ট প্র্যাকটিসটাই করেছি। নোরাড কেন সিডাসহ সবার টাকাই ফেরত দেবো। ’  

বর্তমান অভিযোগ সম্পর্কে টেলিনর কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের কোনো প্রতিশোধ রয়েছে কিনা এ ধরনের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সেরকম মনে করি না। ’

ড. ইউনূস জানান, গ্রামীণ ব্যাংকের সরাসরি চারটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাকিগুলোর সঙ্গে গ্রামীণব্যাংকের কোনো সম্পর্ক নেই এবং ওইসব প্রতিষ্ঠান অলাভজনক।

তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ভিত্তিতে সরকারের ব্যবস্থা নেওয়াকে তিনি আবারো স্বাগত জানান।

সংবাদপত্রের বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশের পর পত্রিকা প্রকাশের ইচ্ছা আছে কিনা- জানতে চাওয়া হলে ইউনূস বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এ ধরনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। আমি জড়াইনি। তবে গণমাধ্যমের ব্যবসাটি সামাজিক ব্যবসা হওয়া উচিত। ’

তিনি দাবি করেন,ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে গরিব মানুষের উপকার করাই তার লক্ষ্য, মুনাফা করা নয়। তার মতে, ‘ুদ্রঋণ গরীব মানুষের মঙ্গলের জন্য নিবেদিত একটি কর্মসূচি। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে যারাই লাভের চিন্তা করেছেন তারাই বিচ্যুৎ হয়েছেন। ’

গণমাধ্যমের রিপোর্টে তার প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে কিনা- এর জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ‘একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লিখতে হলে চিন্তাভাবনা করে লেখা ভালো। এক্ষেত্রে রয়ে সয়ে লেখা উচিত। বিশেষ করে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লিখতে গেলে বিদেশে নিষেধ করা হয়। এতে করে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায়।

‘এক্ষেত্রে আমার ভাগ্য ভালো যে, গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আতঙ্ক ছড়ায়নি। ’    

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজের ভাবমূর্তি বাড়াতে ও বিদেশ ভ্রমণে কত টাকা ব্যয় করেছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এজন্য আমার কোনো টাকা খরচ করতে হয় না। বিভিন্ন দেশ ও তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আমার একটু সময়ের জন্য দেনদরবার করে। আমি একটু সময় দিলে তারা খুশি হয়। ’

তবে সাম্প্রতিক বিভিন্ন রিপোর্ট নিয়ে দেশের অনেক মানুষ কষ্ট পেয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।  

গ্রামীণ টেলিকম এ পর্যন্ত কত অর্থ বিনিয়োগ করেছে উপস্থিত সাংবাদিকদের একজন এ সংক্রান্ত তথ্য জানতে চাইলে ড. ইউনূস বলেন, ‘শুরুতে ১১ মিলিয়ন ডলার ও পরে ‘ওপেন সোসাইটি অর্গানাইজেশন’র কাছ আরো ৩৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা এই খাতে বিনিয়োগ করেছি। ’

পল্লীফোন প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, ‘পল্লীফোনের ব্যবসা আগের মতো না হলেও পরে ইন্টারনেট সার্ভিস দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। সরকার ব্রডব্যান্ড অনুমোদন দিলে গ্রামীণ টেলিকমের আরেক পর্যায়ের কাজ শুরু হবে। ’

‘গ্রামীণফোন পুরোপুরি নিজের করে নেবেন কিনা’ এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আইনগতভাবে জোর করার ব্যাপার না। বিভিন্নভাবে টেলিনরকে অনুরোধ করেছি। ’

ড. ইউনূস বলেন, ‘ক্ষুদ্রঋণের ভূমিকা কখনোই কমবে না। এটাকে অবজ্ঞা করার কিছু নেই। আমরাই গ্রাহকদের কাছে ঋণগ্রহীতা। আর এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই যে যারাই ঋণ নিয়েছেন তাদের সবাই খুবই গরীব। ’

তিনি জানান, গ্রামীণব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে এ পর্যন্ত চারটি শাখা খুলেছে। এসব শাখার ঋণগ্রহীতা সব সদস্যই মহিলা।   যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও দেড় হাজার ডলার ঋণ নেওয়ার জন্য মানুষের আগ্রহের কমতি নেই।

ইউনূস দাবি করেন, ‘গ্রামীণব্যাংকের আড়াই হাজার শাখার প্রতিটিতে কম করে হলেও সাড়ে ৫ হাজার সদস্য রয়েছে। এক লাখ ভিক্ষুককে ঋণ দিয়েছি। তাদের বলেছি মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভিক্ষা না করে ঋণের টাকা দিয়ে খেলনা, বিস্কুটসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বিক্রি করেন। তবে সব ক্ষেত্রে যে আমরা কাজে সফল হচ্ছি তা দাবি করছি না। ’  

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক সবই জানে। সব টাকাই ফেরত দিয়ে দেব। বাংলাদেশ ব্যাংক সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে তদন্ত করেনি। তবে তাদের মনিটরিং সব সময় চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যখনই প্রয়োজন মনে করে গ্রামীণব্যাংকের বিভিন্ন শাখার কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে থাকে। ’

দারিদ্রকে জাদুঘরে পাঠানোর স্বপ্নের বিষয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘এ স্বপ্ন আমার থাকবেই। ২০৩০ সালে যদি দেশের অর্ধেক মানুষকেও দারিদ্রমুক্ত হয় তবে সেটা অনেক বড় অগ্রগতি। এই সফলতা অর্জন করলেই পরবর্তী ১৫ বছরে দারিদ্রকে জাদুঘরে পাঠানো খুবই সম্ভব। ’

নোরাডের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেবেন কিনা জানতে চাওয়া হলে জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ‘কি ধরনের পদক্ষেপ নিলে ভালো হয় ভেবে দেখতে হবে, হঠাৎ করে কিছু করা যাবে না। চিন্তা-ভাবনা করে নিতে হবে। তারা রিপোর্ট করছে তারা করুক। গণমাধ্যমের রিপোর্ট শেষ হওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো। ’

প্রেস ব্রিফিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে তিনি বারবার সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করার আহবান জানান।

তিনি বলেন, ‘ঝগড়া বিবাদ করে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আসুন সবাই কাজ করি। ’

গ্রামীণব্যাংকের কর মওকুফ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কর মওকুফ হলে আমি পাবো না। গরিব মানুষ পাবে। কর দেবো না তা বলিনি। কিন্তু কর দিলে এর চাপ যে গরীব মানুষের ওপর গিয়ে পড়বে। ’  

তার অবর্তমানে কিভাবে এই প্রতিষ্ঠান চালানো হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এতদিনেও আমাকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। আমাকে সন্দেহ করার সুযোগ নেই। আমি এটিকে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবো না। বরং এটা ছেড়ে দিলে আরো বেশি টাকা আয় করতে পারবো। ’  

রাজনীতিতে আবার ফেরার চিন্তা করছেন কিনা এ জবাবে তিনি বলেন, ‘ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়। আমার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা খুব খারাপ। ’

সব শেষে তিনি পুরো বিষয়টাকে পেছনে ফেলে দেশের কাজে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সবার প্রতি আহবান জানান বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্ব ড.মুহাম্মদ ইউনূস।

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।