ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

একাত্তরের এ দিনে: দেড় শতাধিক রাজাকারের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিলো কপিলমুনিতে

শেখ হেদায়েতুল্লাহ, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০১০

খুলনা: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর খুলনার পাইকগাছা উপজেলায় রাজাকারদের হেডকোয়ার্টার খ্যাত কপিলমুনিতে জনতার রায়ে দেড় শতাধিক রাজাকারের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক গৌরাঙ্গ নন্দী বাংলানিউজকে জানান,  ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার গাজী রহমাতুল্লাহ দাদু, সম বাবর আলী, ইউনুস আলী ইনু, শেখ কামরুজ্জামান টুকু, শেখ আব্দুল কাইয়ূমসহ বেশ কয়েকজন কমান্ডার রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণের ল্েয এক সভায় মিলিত হন।



প্রথমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ৬ ডিসেম্বর রাতে কপিলমুনি ক্যাম্প আক্রমণ করা হবে। কিন্তু ৬ ডিসেম্বর স্থানীয় হাটের দিন থাকায় লোকজনের সঙ্গে পথে দেখা হতে পারে ও শত্র“ ঘাঁটিতে খবর পৌঁছে গেলে পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে আশঙ্কায় তা পিছিয়ে দেওয়া হয়।

পরদিন  ৭ ডিসেম্বর কপিলমুনি রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ করার জন্য মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা নিজ নিজ ঘাঁটি থেকে একযোগে রওনা হন।

৭ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে ৯ ডিসেম্বর সকাল ১১টা পর্যন্ত চলে। এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে রাজাকার ঘাঁটিতে অবস্থানরত ১৫৫ জন রাজাকার।

আত্মসমর্পণকারী রাজাকারদের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে তা নিয়ে ইউনুচ আলী ইনু, ইঞ্জিনিয়ার মুজিবুর রহমান, সাইদুর রহমান কুটু, গাজী রহমাতুল্লাহ দাদু প্রমুখ বৈঠকে বসেন।

ইতিমধ্যে গ্রামবাসীদের মধ্যে খবর পৌঁছে যায় রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করেছে। গ্রামবাসী ক্যাম্পে ছুটে এসে রাজাকারদের মৃত্যুদণ্ড দাবি করে।
 
এ প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুল কাইয়ুম বাংলানিউজকে বলেন, ‘জনতার ােভের বহিঃপ্রকাশ আমরা এড়াতে পারিনি। রাজাকাররা ওই এলাকায় কি পরিমাণ যে অত্যাচার নির্যাতন করেছে তা তাদের ােভ চিৎকার ধিক্কারের মধ্যেই অনুমান করা যায়। তারা চিৎকার করে বলতে থাকে-ওদের বাঁচিয়ে রাখবেন না। ওদের বাঁচিয়ে রাখলে আমাদের গুলি করে মেরে ফেলুন। ’

ুব্ধ জনগণের সামনে শেখ কামরুজ্জামান টুকু রায় জানতে চান। এ সময়ে জনগণ বলে, ‘তাদের মা নেই, আমরা ওদের মৃত্যুদণ্ড চাই। ’

আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘গণআদালতের রায়ে সেখানে দেড় শ’র মত রাজাকারকে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ’

তিনি বলেন, ‘বাংলার ইতিহাসে গণআদালতের রায়ে এটাই প্রথম মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘটনা। খুলনায় কপিলমুনির যুদ্ধই ছিল সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। ’

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই কপিলমুনিতে আরেক ইতিহাস সৃষ্টি হয়। কপিলমুনির ওই যুদ্ধে গাজী আনছার আলী ও শেখ আনোয়ার হোসেন শহীদ হন। আহত হন বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। তাদের মধ্যে খান মোহাম্মদ আলী, তোরাব আলী সানা, আব্দুল খালেক, আবু জাফর ও বড় খোকা অন্যতম।

জানা যায়, কপিলমুনির এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ করেন। বিভিন্ন অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করেন আব্দুল সালাম মোড়ল, সম আলাউদ্দীন, সম বাবর আলী, শেখ আব্দুল কাইয়ুম, নৌ কমান্ডার বজলুর রহমান, লে. আরেফিন প্রমুখ।

ওই যুদ্ধে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন নৌ কমান্ডার গাজী রহমাতুল্লাহ দাদু। ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন শেখ ইউনুচ আলী ইনু।

একটানা দু’দিন দু’রাত বন্দুক যুদ্ধের পর তৃতীয় দিনে প্রতিপ রাজাকারদের প থেকে গুলির আওয়াজ কমতে থাকে। যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে মুক্তিযোদ্ধারা মাইকে রাজাকারদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। প্রতুত্তরে রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদেরকেই আত্মসমর্পণ করতে বলে। একপর্যায়ে রাজাকাররাই তৃতীয় দিনে ৯ ডিসেম্বর সকালে ক্যাম্পের দোতলায় একটি সাদা পতাকা উড়িয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
 
বিভিন্ন দিকের আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন কপোতা নদের অপরপ্রান্তে তৌফিক, বড় খোকা জাফরসহ অন্যরা আরসি চালায়। আরশনগর এলাকায় ঘাঁটি করেন ইঞ্জিনিয়ার মুজিবুর রহমান। উদ্দেশ্য ছিলো খুলনা থেকে পাক বাহিনী যাতে আসতে না পারে। কপিলমুনি বালিকা বিদ্যালয়ে অবস্থান নেন সম বাবর আলীর নেতৃত্বে একটি দল। রাজাকার ঘাঁটির সন্নিকটে অবস্থান নেন মোড়ল মো. আব্দুস সালাম ও তার সহযোদ্ধারা। চারিদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে শেষ পর্যন্ত রাজাকার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে।

বাংলাদেশ সময়: ২২৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।