ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

৩ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও মুক্ত দিবস: পালন করেনি কেউ!

ফিরোজ আমিন সরকার, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০১০
৩ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও মুক্ত দিবস: পালন করেনি কেউ!

ঠাকুরগাঁও: ৩ ডিসেম্বর। এ দিনে ঠাকুরগাঁও পাকহানাদার বাহিনীর কবল মুক্ত হয়।

কিন্তু, নিরবে-নিভৃতে পার হয়ে গেল দিনটি! দিনটি পালন উপলক্ষে প্রশাসন কিংবা কোনো রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করেনি।

শুধুমাত্র ঠাকুরগাঁও প্রেসকাবের উদ্যোগে একটি র‌্যালি বের করা হয় সকাল সাড়ে ১১টায়।

এদিকে আজও অরতি ও অযত্মে পড়ে আছে জেলার বিভিন্নস্থানের গণকবরগুলো। সদর উপজেলার জাঠিভাঙ্গা এলাকায় একসাথে দেড় সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করে পাকবাহিনী। তাদের স্মরণে সেখানে গড়ে উঠেছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ।   কিন্তু সেটিও রয়েছে অরতি। ইতোমধ্যে চুরি হয়ে গেছে এর লোহার গেটটি। ভেঙে গেছে পিলার ও তারগুলো।

অন্যদিকে, রানীশংকৈল উপজেলার খুনিয়া দিঘিতেও একসাথে হত্যা করা হয় ৩ সহস্রাধিক মানুষকে। ওই পুকুর পাড় থেকে এখনো মানুষের কঙ্কাল ও হাড় খুঁজে পাওয়া যায়। সেই পুকুর পাড়টিও আজও অযত্মে-অবহেলায়!

এছাড়া শহরের জেলা শিল্পকলা একাডেমীর পেছনে রয়েছে আরো একটি গণকবর। সেখানে হত্যা করা হয় ৭ জনকে। সেটিও জঙ্গলে ছেয়ে গেছে! ভূল্লির গণকবরটিও রয়েছে অরতি অবস্থায়! এগুলো সংস্কার ও রণাবেণের উদ্যোগ না নেওয়ায় ুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধারা।

মুক্তিযুদ্ধের ডিফেন্স কমিটির সাধারণ সম্পাদক ডা. শেখ ফরিদ সে কারণে ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন, ‘আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। এখন রা করার দায়িত্ব সবার। কিন্তু কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই! আজও অবহেলিত ও অযত্মে পড়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ণ!’

শুধু তাই-ই নয়, ঠাকুরগাঁও মুক্ত দিবসটিও পালন করা হয় না। আর পালিত হলেও কখনো হয় তা দায়সারাভাবে। এতে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস একদিন ভুলে যাবে ভবিষ্যৎ-প্রজন্ম এমন আশঙ্কা করছেন মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেকেই।

অন্যদিকে, ঠাকুরগাঁও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ আম্মদ সুবর্ণ জানালেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস আগামী প্রজন্মকে জানাতে এধরনের দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরা দরকার। কিন্তু ঠাকুরগাঁওয়ে দিবসটি পালনে কোনো কর্মসূচি থাকে না। হলেও তা হয় দায়সারাভাবে। ’

জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের কমান্ডার জিতেন্দ্রনাথ রায় জানান, ‘৩ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও পাকহানাদার মুক্ত হয়। এধরনের দিবসগুলো পালন করতে জেলা আওয়ামী লীগের উচিত ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়া। কিন্তু এ বিষয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। ’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোস্তাক আলম টুলু দিবসটি পালনে জেলা আওয়ামী লীগের কোনো কর্মসূচি নেই বলে জানান।

ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শহিদুজ্জামান জানালেন, ‘মুক্ত দিবসের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়নি। তবে, এটি পালন করা দরকার। এজন্য সকলের উচিত এগিয়ে আসা। ’

এ প্রসঙ্গে প্রেসকাবের সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমান মিঠু বলেন, ‘শুধু মাত্র র‌্যালি বের করার কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। তবে সরকারি-বেসরকারি, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উচিৎ দিবসটি পালন করা। ’  

মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কাছে তুলে ধরতে এধরনের দিবসগুলো পালনের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচার কার্যকর করা হোক এমন প্রত্যাশা সকলের।

মুক্তিযোদ্ধা সূত্রে জানা যায়, ঠাকুরগাঁও তখন ছিল উত্তরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি মহকুমা। বর্তমানে ঠাকুরগাঁও এবং পঞ্চগড় জেলার ১০টি থানাই ছিল এ মহকুমার অন্তর্গত।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালোরাতে হায়েনারা যখন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তখন নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে সৃষ্টি করেছিল নারকীয় তাণ্ডব। এ সময় বর্বর পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো ঠাকুরগাঁও গর্জে ওঠে। পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঠাকুরগাঁওবাসী গড়ে তুলেছিল দুর্বার প্রতিরোধ। এ প্রতিরোধের কারণেই ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত হানাদার বাহিনী প্রবেশ করতে পারেনি ঠাকুরগাঁওয়ের মাটিতে। পরে ১৫ এপ্রিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত পাকবাহিনীর দখলে চলে যায় ঠাকুরগাঁও। তারা ১০টি ট্রাক ও ৮টি জিপে করে মুহুর্মুহু শেল বর্ষণ করতে করতে ঠাকুরগাঁও শহরে ঢুকে পড়ে।

তবে এ মহকুমার অন্যতম থানা তেঁতুলিয়া সবসময়ই ছিল হানাদারমুক্ত। তেঁতুলিয়াকে কেন্দ্র করে ১৫০ বর্গমাইলের ১টি মুক্তাঞ্চল গড়ে ওঠে, যেখানে পাকবাহিনী কখনো ঢুকতেও পারেনি। সেখানে থেকেই পরিচালিত হয় চূড়ান্ত লড়াই। এ কারণে ঠাকুরগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ নতুন শক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। নানা কৌশলে আক্রমণ করা হয় শত্র“র ওপর।

কখনও সম্মুখযুদ্ধ। আবার কখনও গেরিলা যুদ্ধ। মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে পাকহানাদারেরা। ব্রিজ, কালভার্ট, রেললাইন, পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দিয়ে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙে দেয়। দালাল ও রাজাকারদের ওপর শাস্তিমূলক আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। এ ধারার অভিযান অব্যাহত থাকে নভেম্বর মাসের গোড়ার দিক পর্যন্ত। ২৯ নভেম্বর এ মহকুমার পঞ্চগড় থানা প্রথম শত্র“মুক্ত হয়। পঞ্চগড় হাতছাড়া হওয়ার পর পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙে গেলে তারা পিছু হটে ময়দানদিঘি, বোদা, ভূলী হয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে ঘাঁটি স্থাপন করে। ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ আক্রমণ চলতে থাকে সেখানে। পাকসেনারা ৩০ নভেম্বর ভূলী ব্রিজ উড়িয়ে দেয়। তারা সালন্দর এলাকার সর্বত্র বিশেষ করে আখেেত মাইন পেতে রাখে। মিত্রবাহিনী তাৎণিকভাবে ভূলী ব্রিজ মেরামত করে ট্যাঙ্ক পারাপারের ব্যবস্থা করে। ১ ডিসেম্বর ভূলী ব্রিজ পার হলেও যত্রযত্র মাইনের কারণে মিত্রবাহিনীর ঠাকুরগাঁও শহরে ঢুকতে বিলম্ব হয়। ওই সময় শত্র“দের মাইনে দুটি ট্যাংক ধবংস হয়।

পরে কমান্ডার মাহাবুব আলমের নেতৃত্বে মাইন অপসারণ করে মিত্রবাহিনী ঠাকুরগাঁও শহরের দিকে অগ্রসহ হয়। ২ ডিসেম্বর প্রচণ্ড গোলাগুলির পর শত্র“বাহিনী ঠাকুরগাঁও থেকে  পেছনে হেটে যায়। ৩ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনী বিজয়ের বেশে ঠাকুরগাঁও প্রবেশ করে।

মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠক আকবর হোসেন জানান, ‘যুদ্ধ শুরুর সময়ই ভারতের থুকরাবাড়ি ক্যাম্প থেকে বর্তমান পঞ্চগড় জেলায় যুদ্ধে অংশ নিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে প্রবেশ করি।

সেদিনই এই ঠাকুরগাঁও পাক হানাদারমুক্ত হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ লড়াই আর মুক্তিকামী জনগণের দুর্বার প্রতিরোধে এখানে পতন হয় পাকবাহিনীর। তাই, একাত্তরের এই দিনে এখানকার গ্রাম-গঞ্জ-শহরে সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে মুক্তির উল্লাস। আনন্দ উদ্বেলিত কণ্ঠে ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনি আর হাতে প্রিয় স্বদেশের পতাকা নিয়ে ছুটোছুটি করতে থাকে সকলেই। সকাল থেকেই দারুণ উত্তেজনা নিয়ে ঠাকুরগাঁও শহরসহ জনপদ ও লোকালয়ে মানুষ জড়ো হতে থাকে। শহরের বিভিন্ন রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে মিছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের জয় ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে ঠাকুরগাঁও শহর। পতাকা উত্তোলিত হয় মোড়ে মোড়ে।

বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।