ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

দায়সারা সাংবাদিক সম্মেলনে সংবাদমাধ্যমকে দুষলেন ড. ইউনূস

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১০
দায়সারা সাংবাদিক সম্মেলনে সংবাদমাধ্যমকে দুষলেন ড. ইউনূস

ঢাকা: একটি দায়সারা গোছের সাংবাদিক সম্মেলন করলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রোববার দুপুরে মিরপুরে গ্রামীণ ব্যাংকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে তার বিরুদ্ধে সংবাদ পরিবেশনার জন্য মোটা দাগে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমকেই দুষলেন তিনি।



নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রামাণ্যচিত্র ও প্রতিবেদন প্রকাশ করে গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে অর্থ সরানোর অভিযোগ আনার পর ওই টেলিভিশনে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদও পাঠাননি ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

গণমাধ্যম মিথ্যা বা ভুল প্রতিবেদন প্রকাশ বা প্রচার করেছে মনে করে থাকলে সেজন্য প্রতিবাদলিপি পাঠানো প্রতিকারের প্রথম উদ্যোগ বলে বিবেচিত হলেও ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস সাংবাদিকদের বলেছেন তিনি তার প্রয়োজন মনে করেননি।

সংবাদ সম্মেলনে বাংলানিউজের পক্ষ থেকে বিষয়টি উত্থাপন করা হলে ডক্টর ইউনূস বলেন, ‘এমন প্রতিবাদ করার প্রয়োজন আমি মনে করিনি। ’

এদিকে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে যেসব সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার করা হয়েছে তার বিপরীতে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য তুলে না দিয়ে ডক্টর ইউনূস একটি লিখিত পাঠ করেন। আর এই লিখিত বক্তব্যেই তিনি ঢালাওভাবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। সংবাদ মাধ্যমের পরিবেশিত কোন সংবাদটি মিথ্যা এবং কেন মিথ্যা তারও কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা তিনি দেননি।

ডক্টর ইউনূস বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক একটি ব্যাংক এবং এর বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। কারণ এতে গ্রাহকদের ওপর প্রভাব পড়তে পারে। তবে আমরা ভাগ্যবান যে আমাদের গ্রাহকরা তাতে প্রভাবিত হননি।
 
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বিরুদ্ধে গরীবের রক্ত চুষে খাওয়ার যে অভিযোগ করেছেন সে প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, প্রধানমন্ত্রী যা মনে করেছেন ঠিক তাই বলেছেন।

তার বিরুদ্ধে কোনো ধরণের ষড়যন্ত্র চলছে কি না.. এমন প্রশ্ন করা হলে জবাবে ডক্টর ইউনূস বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না এমন কিছু হতে পারে। ’

পল্লীফোনের নারীদের হাতে কেনো এখন ফোন নেই কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, এখনো ৪ লাখ নারী এ ফোন ব্যবহার করছেন। তবে দেশের সর্বস্তরে মোবাইল ফোন ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ার কারণে এ ফোনের ব্যবসা হ্রাস পেয়েছে।

কিনটন ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে পুরস্কার গ্রহণের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমাকে সবাই টাকা দেন, কাউকে আমার টাকা দিতে হয় না। ’

লিখিত বক্তব্যে যা ছিলো...

এর আগে লিখিত বক্তব্যে ডক্টর ইউনূস বলেন, গত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের একটি উল্লেখযোগ্য অংশে যা প্রকাশিত হয়েছে তার জন্য আমি দুঃখিত হয়েছি। দুঃখ প্রকাশ করার জন্যে আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আমার মনে হয়, আমার মতো দেশের বহু মানুষ তাদের মনে এরকম কষ্ট পেয়েছেন। নরওয়েজিয়ান টেলিভিশনে প্রচারিত ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ক প্রামাণ্যচিত্রের একটি অভিযোগকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে সাজিয়ে আমার অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতি বলে সংবাদ মাধ্যমে তুলে ধরা হযেছে।

নরওয়েজিয়ান প্রামাণ্যচিত্রে বলা হয়েছিলো এক প্রতিষ্ঠান থেকে আরেক প্রতিষ্ঠানে টাকা স্থানান্তর করার মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংক অনুদানের শর্ত লঙ্ঘন করেছে। এতে কোথাও আত্মসাৎ বা দুর্নীতির অভিযোগ ছিলো না।

আমাদের সংবাদ মাধ্যমে এটা সরাসরি আমার দ্বারা সংঘটিত ‘আত্মসাৎ’ ‘তহবিল তসরুফ’ ‘কাঠগড়ায় দাঁড় করানো’ ইত্যাদি নানা অভিযোগে পরিণত হয়ে গেছে। নরওয়েজিয়ান প্রতিবেদনের সঙ্গে অভিযোগ খণ্ডন করে গ্রামীণব্যাংকের ব্যাখ্যাটিও দেওয়া ছিলো। এরপর নরওয়ে কর্তৃপক্ষ গ্রামীণব্যাংকের নেওয়া পদক্ষেপে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয়ে যে চিঠি দিয়েছিল সেটাও দেওয়া ছিলো। কিন্তু যারা খবরটি বিকৃত করেছে তারা এগুলির কথা উল্লেখ করেন নি। দেশে এ ধরনের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর আমরা আবার প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরে সবাইকে জানিয়ে একটি ব্যাখ্যা প্রচার করি।

আমাদের সঙ্গে নোরাডের যে মতদ্বৈধতা ছিলো তা ছিলো একটা অনেস্ট ডিজআ্যগ্রিমেন্ট। মোডালিটি নিয়ে দুপক্ষের দুই মত ছিলো। অন্য দাতা সংস্থাগুলি আমাদের মোডালিটি নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করেনি। নোরাড করেছে। পরে আমরা সেটারও নিষ্পত্তি করেছি।

পরে আমরা সেটার নিষ্পত্তি করেছি যাতে আমাদের মধ্যে সুসম্পর্ক নষ্ট না হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের অভিমত দিয়ে ছিলেন যে যেহেতু নোরাডের টাকাটা ফেরত দিয়েছেন সিডার (SIDA) টাকাটাও একই ভাবে ফেরত দিয়ে দিন। আমরা সিডাসহ (SIDA) অবশিষ্ট সকল দাতা সংস্থার টাকা ফেরত নিয়ে এসে এসেছি। এতে আর বিতর্কের কোনো অবকাশ থাকে না।

নরওয়ে সরকার নুতন ভাবে নিজস্ব অনুসন্ধান প্রক্রিয়া শেষ করে তার প্রতিবেদন ও মাননীয় বৈদেশিক সাহায্য মন্ত্রীর বক্তব্যসহ আবার সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন যে ১২ বছর আগে গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে বিষয়টি সুন্দরভাবে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। এখানে কোনো দুর্নীতি বা আত্মসাতের কোনো বিষয় ছিলো না। তারা এই প্রতিবেদনের উপসংহারে এ কথা বলেছেন: গ্রামীণ ব্যাংক ‘‘......... is perhaps the single most successful development project in the world’’. আমাদের সংবাদ মাধ্যমের একটি অংশ যত গুরুত্ব দিয়ে কল্পিত অভিযোগগুলি পাঠক ও দর্শকদের কাছে তুলে ধরেছিলেন পরবর্তীতে অভিযোগগুলি সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পর সে খবর প্রচার করাকে আর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন মনে করেননি। এমন কি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বরাত দেওয়া ভুয়া খবর সম্পর্কে ভারতীয় হাই কমিশনের প্রতিবাদলিপিও অনেকে প্রকশ করেননি।

এ সব বিষয় আমাকে অত্যন্ত ব্যথিত করেছে। আমার এই দুঃখের কথা জানানোর প্রয়োজন আছে মনে করে এটা আপনাদের সামনে তুলে ধরার জন্য আজ আপনাদের কাছে এসেছি। এব্যাপারে গ্রামীণ ব্যাংকের বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও নরওয়ে সরকারের বক্তব্য ইতোমধ্যে মিডিয়াকে অবহিত করা হয়েছে আজ আবার তা আপনাদের কাছে বিতরণ করা হয়েছে।

আমি আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে চাই যে গ্রামীণ ব্যাংক একটি সৎ প্রতিষ্ঠান। এখানে যাতে কোন দুর্নীতি ঢুকতে না পারে এজন্য আমরা সব সময় সতর্ক দৃষ্টি রাখি। এই প্রতিষ্ঠান জাতির জন্য একটা গৌরবের প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে এবং বরাবর সেভাবেই গৌরবের প্রতিষ্ঠান  হিসেবে নিজেকে সমুন্নত রাখার জন্য এই প্রতিষ্ঠানের সকল সহকর্মী অঙ্গীকারবদ্ধ।

আমি গত ৩৪ বছরে অনেকগুলি প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির পেছনে ছিলাম। এগুলির সঙ্গে আমার আর্থিক সম্পর্ক নিয়ে অনেকে ভুল ধারণার সৃষ্টি করেন। গতকালও একটি টিভি চ্যানেলে বলা হয়েছে নোরাডের টাকাটা ড. ইউনূসের মালিকানাধীন “গ্রামীণ কল্যাণ” নামক প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করা হয়েছে। গ্রামীণ কল্যাণ যে একটা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, এটা যে গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ড কর্তৃক সৃষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান, এটার যে মালিক নেই এসব কথা আমাদের প্রতিবেদনে পরিষ্কারভাবে বলা আছে। নরওয়েজিয়ান সাংবাদিকও তাঁর প্রতিবেদনে এটা আমার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বলে উল্লেখ করেননি। তাহলে টিভি চ্যানেল এত কথার পরেও আবার একথা প্রচার করছে কেন? দুঃখ পাবার কারণ তো এভাবেই সৃষ্টি হচ্ছে।

অমি সুস্পষ্টভাবে সবার সামনে জানিয়ে রাখতে চাই যে আমি একমাত্র গ্রামীণ ব্যাংক ছাড়া আমার সৃষ্ট কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কোন রকম আর্থিক সুবিধা, বাড়ি, গাড়ি, ভাতা কিছুই পাই না। আমি গ্রামীণ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা হিসেবে ব্যাংক থেকে বেতন ও অন্যান্য সুবিধা পাই। গ্রামীণ পরিবারের কোন প্রতিষ্ঠানে আমার কোন মালিকানা নেই। গ্রামীণ ব্যাংক বা গ্রামীণ পরিবারের কোন প্রতিষ্ঠানের একটি শেয়ারের মালিকও আমি নই। যেহেতু গ্রামীণ ব্যাংকে আমার কোন শেয়ার নেই সেজন্য আমি ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ডের সদস্য থাকলেও এতে আমার ভোটাধিকার নাই। আমি একজন নন ভোটিং সদস্য।

প্রত্যেকটি কোম্পানী সৃষ্টি করার পেছনে মূল অনুপ্রেরণা ছিল দেশের কোন একটি সামাজিক বা অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করা। কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কোন আর্থিক সুবিধা নেয়ার কথা আমার মনে কখনো আসেনি, কখনো আর্থিক সুবিধা নিইনি। এমনকি বোর্ড মিটিং করার সময় বোর্ড মেম্বারদের সামান্য সম্মানী দেওয়ার যে রেওয়াজ আছে সেটাও আমি কখনো গ্রহণ করিনি।

দারিদ্র আমাদের এক নম্বর জাতীয় সমস্যা। এই সমস্যার সমাধানের জন্য জাতির সকল অংশ নানাভাবে চেষ্টা করছে। শতাব্দীর উন্নয়ন লক্ষ্য (MDG) অর্জনে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বাংলাদেশ এই লক্ষ্য অর্জনে সাফল্য দেখিয়ে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

গ্রামীণ ব্যাংক দারিদ্র নিরসনে নিয়োজিত একটি প্রতিষ্ঠান। একাজে সাফল্যের জন্য আমরা সংবাদ মাধ্যমের সহযোগিতা কামনা করছি। আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। সংবাদ মাধ্যমে আমাদের ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেবেন-কোনরকম নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীতে নয়, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে। আমাদেরকে জনসমক্ষে হেয় করার জন্য নয়-আমাদেরকে জাতীয় লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা দানের জন্য। এই সহযোগিতা আমাদের উৎসাহ এবং কর্মদক্ষতাকে আরো অনেক বাড়িয়ে দেবে। আমাদের লক্ষ্য অর্জনকে আরো দ্রুততর করে দেবে। আশা করি আমরা সেই সহযোগিতা আপনাদের কাছ থেকে পাবো।

বাংলাদেশ সময় ১৪০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।