ঢাকা: রাজউকের গাজীপুর উপশহর প্রকল্প নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে চলছে ক্ষোভ-বিক্ষোভ। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে রাজউক ‘এটা নিছক বিভ্রান্তি’ ও ‘কথিত উপশহর প্রকল্প’ উল্লেখ করায় সেখানকার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
জাতীয় সংসদের ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও গাজীপুর-১ আসনের সাংসদ আ ক ম মোজাম্মেল হক সোমবার রাতে ফোনে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডিকে বলেন, রাজউক যে গাজীপুরের দুটি ইউনিয়ন ও টঙ্গী পৌরসভায় উপশহর বানাতে চেয়েছে তার পর্যাপ্ত কাগজপত্র ও তথ্যপ্রমাণ আমাদের কাছে আছে।
তিনি বলেন, ‘গণবিস্ফোরণের পরদিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তখন প্রধানমন্ত্রী রাজউক চেয়ারম্যানকে ডেকে নিয়ে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণের জন্য কৈফিয়ত তলব করেন। একটা মহল রাজউকের পক্ষ হয়ে গাজীপুরের মানুষের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার চেষ্টা করছে। আমাদের আন্দোলনকে ব্যর্থ অভিহিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ’
গাজীপুর উপশহর প্রতিরোধ কমিটির আহবায়ক ও গাছা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম মোবাইল ফোনে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডি’কে বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত না হয়ে রাস্তায় নামিনি। রাজউকের গাজীপুর উপশহর প্রকল্পের সব ধরনের কাগজপত্র হাতে পাওয়ার পর বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছি। ’
তিনি বলেন, বিপাকে পড়ে রাজউক এখন মিথ্যা বক্তব্য দিচ্ছে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া রাজউকের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের ১২ লাখ লোকের বাসস্থানের জন্য এ প্রকল্প বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। রাজউক প্রবর্তিত ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ)-এ চিহ্নিত ফাড ফো জোনের একটি বড় অংশও রয়েছে এ প্রকল্প এলাকায়। প্রকল্প এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের কিভাবে পুনর্বাসিত করা হবে সেটাও নির্দিষ্ট করেনি রাজউক। এছাড়া প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এ অঞ্চলের আদিবাসীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রাজউকের ওয়েব সাইটেও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় চারটি আবাসিক প্রকল্পের কথা উল্লেখ রয়েছে। এর একটি হচ্ছে গাজীপুর উপশহর প্রকল্প। গত মাসে এ প্রকল্পের বিস্তারিত প্রস্তাবনাপত্র তৈরি করে অনুমোদনের জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে উপস্থাপন করা হয়।
প্রসঙ্গত, গত ২৪ জুন দৈনিক মানবজমিনে ‘পূর্বাচলের পর গাজীপুর উপশহর’ শিরোনামে বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপা হয়। গত ৩০ জুন দৈনিক কালের কণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায় ‘জলাশয় ভরাট করে গাজীপুর উপশহর প্রকল্প: জনরোষে রাজউক’ শিরোনামে আরেকটি বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপা হয়। রাজউকের প্রস্তাবনায় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৪ হাজার ৩২২ দশমিক ০৬৭ একর জমি অধিগ্রহণ, প্রকল্প এলাকার অবস্থান, মৌজাপ্রতি জমির পরিমাণ, জমির প্রকৃতি প্রভৃতি বিষয় বিস্তারিত তুলে ধরা হয়।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া রাজউকের প্রস্তাবনার পৃষ্ঠা ১৪-এর ১৫.১ ধারায় তুলে ধরা হয়েছে প্রকল্পের প্রেক্ষাপট। এতে উপশহর বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা, সুবিধা, অসুবিধা এবং এর ব্যাপ্তি তুলে ধরা হয়েছে। প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকল্প এলাকার বর্তমান ভূমির প্রকৃতি ও গেজেট করা ড্যাপের নির্দেশনা।
প্রস্তাবনায় গাজীপুরের বাসন ও গাছা ইউনিয়নের কিছু অংশ এবং টঙ্গি পৌরসভার কিছু অংশ নিয়ে এ উপশহর গড়ার কথা বলা হয়েছে। ৪ হাজার ৩২২ দশমিক ০৬৭ একরের এ প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা হিসেবে প্রস্তাবনায় দেখানো জমির ৫২ ভাগ কৃষি ও ৩২ ভাগ গ্রামীণ বসতি। এছাড়া তুরাগ নদীর পাড়ের এ প্রকল্পে দুটি বড় প্রাকৃতিক খাল এবং ১০৫টি পুকুর রয়েছে। প্রকল্পের উত্তর-পূর্ব অংশ উঁচু, মধ্য অংশ মাঝারি উঁচু ও পশ্চিমাংশ নিচু ভূমি হিসেবে দেখানো হয়েছে। রাজউকের প্রস্তাবনায় পাস হওয়া ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানে গাজীপুর উপশহর প্রকল্প এলাকাকে মূলত কৃষিভূমি, গ্রামীণ বসতি, শহুরে বসতি ও বন্যাপ্রবাহ জোন হিসেবে দেখানো হয়েছে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে যেমন কৃষি জমি নষ্ট হবে, তেমনি বন্যা প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে এবং ভূমির প্রকৃতিও পরিবর্তন করতে হবে।
উপশহর প্রকল্পটির অবস্থান দেখানো হয়েছে আধাপাশা, বড় কলমেশ্বর, বাসন, ভারারি পাড়া, ভোগড়া, চান্দপাড়া, চান্দুরা, দারাইল, দৌলতপুর, গাছা, ইছারকান্দি, ইসলামপুর, কড্ডানন্দুল, কলমেশ্বরি, কমরজুড়ি, কাথোরা, মহিষেরটেক, মুদিপাড়া, ওনাড়িপাড়া, পলাশনা, সাতাইশ, নাওজুরি ও সোন্ডা মৌজায়। প্রকল্পের মোট আয়তন ৪ হাজার ৩২২ দশমিক ০৬৭ একর।
রাজউকের প্রস্তাবনায় ‘অসুবিধাসমূহ’ উপশিরোনমে বলা হয়েছে, অধিকাংশ এলাকা কৃষিভূমি হওয়ায় প্রকল্প গ্রহণের ফলে মূল্যবান কৃষিজমি ধ্বংস হবে। প্রকল্প এলাকার বন্যাপ্রবাহ এলাকাসমূহ সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না হলে বন্যার পানি বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে ও নতুন এলাকা প্লাবিত হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সুবিধা হিসেবে দেখানো হয়েছে, প্রকল্প এলাকা ঢাকা-ময়মনসিংহ এলাকায় হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধা হবে এবং কম বসতিপূর্ণ হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি কম হবে।
এ বিষয়ে রাজউকের পরিকল্পনাবিদ ড. জহিরুল হক বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডি’কে বলেন, ‘গাজীপুর উপশহর’ নামেও কোনো প্রকল্প প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়নি। রাজউকের ছয় কর্মকর্তা স্বাক্ষরিত প্রস্তাবনাকে তিনি জাল বলে আখ্যায়িত করেন।
রাজউকের সচিব খিজির আহমেদ ৩ জুলাই গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেন, ঢাকা শহরের ওপর চাপ কমানোর জন্য দীর্ঘ মেয়াদে ঢাকার আশপাশে চারটি উপশহর নির্মাণের পরিকল্পনা সরকারের বিবেচনায় আছে। কিন্তু কোন এলাকায় কতটুকু জমি নিয়ে এ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে তা এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি বা জমি অধিগ্রহণের কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার সংসদ সদস্য, জনপ্রতিনিধি ও জনসাধারণের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১১৩৩ ঘণ্টা, জুলাই ০৬, ২০১০