ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

এবার প্রতারণায় নেমেছে ‘ইউনিগেটওয়ে টু ইউ’!

সাঈদুর রহমান রিমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১০
এবার প্রতারণায় নেমেছে ‘ইউনিগেটওয়ে টু ইউ’!

ঢাকা: দ্বিগুণ, তিনগুণ লাভের স্বপ্ন দেখিয়ে সারাদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানিগুলোর (এমএলএম) বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।

শুধু ওয়েবসাইটকে পুঁজি করে গড়ে তোলা এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে কখনো হৈ চৈ শুরু হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মানিলন্ডারিং শাখা সাময়িক সময়ের জন্য তাদের অ্যাকাউন্ট স্থগিত করে দায় সারছে।

পরে অ্যাকাউন্ট স্থগিতের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো আদালতে রিট পিটিশনের মাধ্যমে তাদের অনুকুলে রায় নিয়ে আবার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ব্যবসায় নেমে পড়ছে।

নিউওয়ে, জিজিএন, যুবকের পর এবার মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের নামে ‘ইউনিপে টু ইউ’র দেশজুড়ে মাতামাতি শেষ হতে না হতেই এবার প্রতারণায় নেমেছে ইউনিগেটওয়ে টু ইউ নামে আরেকটি হায় হায় সংস্থা। নিজেদেরকে তারা ব্যবসায়িক সংস্থা বলে দাবি করলেও কী নিয়ে তারা ব্যবসা করেন, কোথায় ব্যবসা-মার্কেট সেসবই টপ সিক্রেট। ৱ

ইউনিগেটওয়ে টু ইউ নিজেদেরকে তথাকথিত ‘ইউনি গ্রুপভুক্ত’ সদস্য হিসেবে দাবি করে থাকে। ইউনি গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন ইউনিটের হায় হায় চক্রটি সীমিত সময়ের মধ্যেই ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী এলাকায় ১৫ লক্ষাধিক সদস্য তৈরি করে তাদের কাছ থেকে ‘বিনিয়োগ’ বাবদ হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা।

চারটি মহানগরীতে দুই হাজারেরও বেশি এজেন্টের মাধ্যমে ‘ইউনি গ্রুপ’ এই বিপুল অংকের টাকা নিজেদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নিয়ে নিচ্ছে। এ ব্যাপারে বাংলানিউজে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে তা ব্যাপকভাবে ফলাও হয়। এরপর কিছুদিন ইউনিপে টু ইউ এর কার্যক্রম সাময়িকভাবে ঝিমিয়ে পড়ার পর এবার নতুন এক প্রতারকচক্র মাঠে নেমেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাতীয় পার্টির সাবেক এক সংসদ সদস্যের পৃষ্ঠপোষকতায় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ‘ইউনিগেট ওয়ে টু ইউ ট্রেডিং (প্রাইভেট) লিমিটেড’ নামে একটি মার্কেটিং নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। বেসরকারি সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকে (এসআইবিএল) প্রিন্সিপাল শাখায় মাত্র দেড় মাস আগে খোলা এর ব্যাংক হিসাবে এরইমধ্যে ১২ কোটি টাকা জমা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে, মাত্র ১০ মাসে আড়াইগুণ টাকা লাভ দেওয়ার লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে ইউনিগেট ওয়ে টু ইউ ট্রেডিং (প্রাইভেট) লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটি জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে। ‘ইউনিপে টু ইউ বাংলাদেশ’ এর চেয়ে আরও চতুরতার সঙ্গে তারা জনসাধারণের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড শুরু করেছে বলে ব্যাংক কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন।

প্রাথমিকভাবে সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মতাবলে এ হিসাব থেকে অর্থ উত্তোলন এক মাসের জন্য স্থগিত করতে সোমবার এসআইবিএল কর্তৃপকে নির্দেশ দিয়েছে। ব্যাংকটি এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্থগিতাদেশ বাস্তবায়ন করছে বলে জানা গেছে।

ইউনিগেটওয়ে টু ইউ ট্রেডিং (প্রাইভেট) লিমিটেডের রহস্যজনক কার্যক্রম ও সংশ্লিষ্টদের পরিচিতিসহ বহুবিধ ঠিকানা ব্যবহার রীতিমত সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। এ ব্যাপারে বাংলানিউজের পক্ষ থেকে এক অনুসন্ধান চালিয়ে পাওয়া গেছে রহস্যময় নানা তথ্য।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ইউনিগেট ওয়ে ট ুইউ ট্রেডিং (প্রাইভেট) লিমিটেড ১২ অক্টোবর ঢাকা সিটি কর্পোরেশন থেকে একটি ট্রেড লাইসেন্স পায়, যার নম্বর- ০৪৫০২১৫। প্রতিষ্ঠানটির রেজিস্টার্ড ঠিকানা দিলকুশার সাধারণ বীমা ভবনের ৬ষ্ঠ তলা। অফিসের ঠিকানা হচ্ছে- লেক প্লাজা, রোড ৩০, বাসা ১১, অ্যাপার্টমেন্ট ৩০২, গুলশান ১।

সিটি কর্পোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স পাওয়ার দিনই ইউনিগেট ওয়ে টু ইউ’র নামে স্যোসাল ইসলামি ব্যাংক লিমিটেডের (এসআইবিএলের) প্রিন্সিপাল শাখায় একটি চলতি হিসাব (নম্বর-১৩৩০০০৫৬৯৯৭) খোলা হয়। হিসাব খোলার ফরমে পরিচয়দানকারী হিসেবে রয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী দেলোয়ার হোসেন খান। তার ব্যক্তিগত চেম্বারকেই ইউনিগেট ওয়ে টু ইউ’র রেজিস্টার্ড ঠিকানা হিসেবে দেখানো হয়েছে।

ব্যাংক হিসাব খোলার ফরমে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে মাসুদুর রহমান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে মুশফিকুর রহমানের নাম রয়েছে। হিসাব খোলার ফরমে মাসুদুর রহমানের বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা দেওয়া আছে কুষ্টিয়ার মিরপুর। অথচ হিসাব খোলার ফরমে সংযুক্ত তার জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপিতে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে মতলব পৌরসভা, মতলব দণি, চাঁদপুর লেখা দেখা গেছে। অন্যদিকে তার আয়কর প্রত্যয়নপত্রে বর্তমান ঠিকানা হিসেবে দেখানো হয়েছে ঢাকার কাকরাইলের একটি হোল্ডিং।

হোটেলকক্ষে গড়ে ওঠে ইউনিগেট টু ইউ

অতিসম্প্রতি বনানীর একটি আবাসিক হোটেলের কক্ষে গোপন বৈঠকে মাসুদুর রহমানকে চেয়ারম্যান ও মুশফিকুর রহমানকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক করে ইউনিগেটওয়ে টু ইউ ট্রেডিং (প্রাইভেট) লিমিটেড নামে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গঠনের উদ্যোগ নেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন এ রহমান নামে অপর একজন যুক্তরাজ্য প্রবাসী ব্যবসায়ী।

এ রহমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবেই বাংলাদেশে তার প্রতিনিধিত্ব করছেন জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ অ্যাডভোকেট দেলোয়ার হোসেন। তার সূত্রেই দিলকুশা’র সাধারণ বীমার ষষ্ঠ তলায় একটি কক্ষে অফিস খোলা হয়।

অ্যাডভোকেট দেলোয়ার হোসেনের সার্বিক তত্ত্বাবধানেই ট্রেড লাইসেন্স, টিন নম্বরসহ অন্যান্য কাগজপত্র তৈরি করা সম্ভব হয় বলেও জানা গেছে। এক্ষেত্রে চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান ইউনিগেট টু ইউ এর ৭০ ভাগ অংশীদার নিযুক্ত হন এবং বাকি ৩০ ভাগের দাবিদার হন মুশফিকুর রহমান।

ভূঁইফোড় ভিসেরেভ !

ইউনিগেটওয়ে টু ইউ ট্রেডিং (প্রাইভেট) লিমিটেড বাংলাদেশে ‘ভিসেরেভ’ (ঠওঝঅজঊঠ) নামে অপর একটি ভূঁইফোড় কোম্পানির অনুকুলে টাকা সংগ্রহ করে চলেছেন। গ্রাহকদের সঙ্গে ব্যবসায়িক সকল বিষয়ে ইউনিগেটওয়ে টু ইউ যোগাযোগ স্থাপন করলেও গ্রাহকের টাকা জমা নেওয়া হয় ভিসেরেভ এর নামে। অথচ ভিসেরেভ নামের কোম্পানি বা সংস্থা’র বাংলাদেশে আদৌ কোনো অস্তিত্ব নেই। ফলে গ্রাহকরা লাখ লাখ টাকা জমা দিলেও পরবর্তীতে জমা গ্রহণকারী ভিসেরেভ সংস্থাকে খুঁজেও পাবেন না। তবে ভারতে ভিসেরেভ সংস্থার কার্যক্রম থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের সঙ্গেই যৌথভাবে চার মাস ধরে ব্যবসায়িক লেনদেন করছে ইউনিগেটওয়ে টু ইউ প্রাঃ লিঃ।

অন্যদিকে অর্থ সংগ্রহের দায়িত্ব পালনকারী ইউনিগেটওয়ে টু ইউ ট্রেড (প্রাঃ) লিঃ এর কাউকে প্রতারণার জন্যও দায়ী করতে পারবেন না গ্রাহকরা। কারণ ইউনিগেটওয়ে টু’কে টাকা দেওয়ার কোনো প্রমাণপত্র গ্রাহকদের কাছে থাকছে না।

মাত্র এক মাসের জন্য লেনদেন স্থগিত ঘোষণা দিলেও আগের তিন মাসের ব্যবসায়িক লেনদেনের প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা হুণ্ডির মাধ্যমে ভারতে ভিসেরেভ এর কাছে পাচার হয়ে গেছে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে।

মাসুদুর রহমানের বক্তব্য

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ইউনিগেট টু ইউ ট্রেডিং প্রাইভেট লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, তিনি আর ইউনিগেট টু ইউ’র সঙ্গে জড়িত নন। নানা কারণে ইউনিগেট টু ইউ ট্রেডিং প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।

বর্তমানে তার অংশের ৭০ ভাগ তিনি ফয়জুর এ রহমানের কাছে হস্তান্তর করেছেন বলেও দাবি করেন। বর্তমানে ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন ফয়জুর এ রহমান। ইউনিগেটটুইউ’র নামে ডাচ বাংলা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টটিও চলতি মাসের ১১ তারিখে স্থগিত করে দিয়ে মাসুদুর রহমান দেশের বাইরে চাল গেছেন বলে জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।