ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

মহল্লার যুবকদের হাতেই তুলে দিতে হলো কোরবানির চামড়া

সাঈদুর রহমান রিমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৭, ২০১০
মহল্লার যুবকদের হাতেই তুলে দিতে হলো কোরবানির চামড়া

ঢাকা: রাজধানীতে মহল্লার যুবকদের হাতেই তুলে দিতে হয়েছে কোরবানির চামড়া। তারা আগেই বলে রেখেছিল কোরবানি দাতাদের।

তাদের নির্দেশ অমান্য করার সাধ্য ছিলো না কারো। তাই দরদাম করে চামড়া বেচার সুযোগ হয়নি তাদের।

নিজের ইচ্ছেমাফিক চামড়া বেচতে না পারা কোরবানি দাতাদের সঙ্গে কথা বলে এ অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে র‌্যাব-পুলিশের টহল দলের কাছে বা থানায় এ নিয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। মহল্লার যুবকদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করার ঝুঁকি নেননি তারা।

শাহজাহানপুর এলাকার বাসিন্দা মোকসেদ আলী (৪৫) বাংলানিউজকে বলেন, ‘চামড়া নিয়ে মহল্লা পর্যায়ের চাঁদাবাজি বন্ধের সাধ্য কারো নাই। এটা হয় নীরবে-অতি গোপনে। বাড়ি বাড়ি চামড়া দেওয়ার আগাম নির্দেশ থাকায়-চামড়া অন্য কোথাও বিক্রির সাধ্য থাকে না। ’

তিনি জানান, দুই গরু আর এক খাসি কোরবানি দিয়েছেন এবার। আগের রাতেই মহল্লার কয়েক যুবক বাসায় হাজির হয়ে চামড়া তাদের কাছে বিক্রি করতে হবে বলে হুকুম জারি করে।

মোকসেদ আলী জানান, ঈদের জামাত শেষ হতেই এক যুবক হাজির হয় তার বাসায়। সহযোগিতা করে কোরবানি যজ্ঞেও। মাংস ছাড়ানোর পর তারা চামড়া তিনটি গুছিয়ে নিয়ে যায়। দুপুরে একটা ইনভেলাপে ১০০ টাকার ১০টি নোট পাঠায় তারা।

মোকসেদ আলী বলেন, ‘কি করার আছে ? এলাকায় ভাড়া থাকি, তিনটা চামড়ার নিয়ে মহল্লার যুবকদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ রাখতে কে চায়?’

সরেজমিনে দেখা গেলো মুগদাপাড়ার ওয়াপদা কলোনির এক গলিতে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা জমিয়েছেন এক দিনের চামড়া ব্যবসা। কোন বাসায় কয়টি গরু বা ছাগল কোরবানি হচ্ছে তার তালিকা করেন তিনি। সেই তালিকা ধরে কোরবানি দাতাদের বাসায় গিয়ে চামড়া কেনার অনুরোধ জানিয়ে আসেন। কয়টি বাসায় কতগুলো গরু-ছাগল কোরবানি হবে তার তালিকাও করা হয়। এরপর প্রতিটি বাসায় নিজে যান, কোরবানি দাতাদের চামড়া দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে আসেন।

ওই আওয়ামী লীগ নেতা কেবল ওয়াপদা কলোনির গলি থেকেই তিন শতাধিক চামড়া সংগ্রহ করেছেন বলে জানিয়েছেন তারই এক ঘনিষ্ঠজন। চামড়ার সর্বোচ্চ দাম দিয়েছেন ৫০০ টাকা যা সরকার নির্ধারিত বিক্রি মূল্যের চেয়ে কম।

মগবাজার ডাক্তার গলির যুবলীগ নেতা আসাদুজ্জামানও চামড়া কিনেছেন মহল্লাবাসীকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে। তার একজন ঘনিষ্ট সহযোগী বারেক বাংলানিউজকে জানান, ভদ্রভাবে সবাইকে চামড়া আমাদের কাছে বিক্রি করতে বলেছিলাম। ’

তিনি বলেন, ‘মহল্লার সব ঝুট-ঝামেলা বিপদ-আপদে আমরা পাশে থাকি, আর চামড়া বিক্রি করবেন হাজারীবাগে? তা হবে না। ’

ধলপুর এলাকায় চামড়া কেনা নিয়ে যুবলীগের মধ্যেই দুটি দলের সৃষ্টি হয়। একদল বুধবার রাতেই কোরবানি দাতাদের চামড়া তাদের জন্য রাখতে নির্দেশ দিয়ে যায়। কিন্তু সকালে অন্যদল বাসায় বাসায় হাজির হয়ে কোরবানিস্থলে অবস্থান নেয়। ফলে কোরবানিদাতারা বেশ বিপাকে পড়েন। গোলাপবাগ মাঠ সংলগ্ন পূর্বধলপুরের বাসিন্দা সিদ্দিক মাস্টার ও রেজ্জাকুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, চামড়া বিক্রির টাকা বরাবরই তারা স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় দেন। রেজ্জাকুল বাংলানিউজকে বলেন, ‘মহল্লার ছেলেপেলেরা কম টাকায় চামড়া নিলে আমরা কম টাকাই মাদ্রাসায় জমা দিবো। এ নিয়ে অভিযোগ, পুলিশি সহায়তা নেওয়ার ঝামেলায় যাওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। ’

উত্তর কমলাপুর এলাকায় চামড়ার পাইকার ক্রেতাদের ঘুরতে ফিরতে দেখা গেছে। স্থানীয় একটি মাদ্রাসার মাঠে ২৫/৩০টি চামড়া স্তুপ করে রাখা ছিল। সেগুলো কিনতে পারলেও বাড়ি বাড়ি খুঁজে চামড়া কেনার সাধ্য তাদের ছিল না। এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে চামড়া ব্যবসায়ী মান্নান মিয়া জানান, কেউ চামড়া কিনতে বাধাও দিচ্ছে না, কিন্তু বাড়ি মালিকরা চামড়া অন্য কোথাও বিক্রি করতেও সাহস পাচ্ছেন না। কোরবানি দেওয়া বাড়িওয়ালাদের চামড়া কেনাবেচার কথা বললে তাদের একটাই উত্তর: চামড়া আগেই বিক্রি হয়ে গেছে।

গাবতলী টার্মিনাল সংলগ্ন বড়বাগ বাজারের সামনে বিকেল তিনটার দিকেই চামড়ার স্তুপ জমে উঠে। তিনটি স্তুপে ৫ শতাধিক চামড়া আছে বলে জানান পাহারাদার সুজন, মুন্না, আরিফ, শামীমসহ কয়েকজন। স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা জয়নাল আবেদিন এসব চামড়া সংগ্রহ করেছেন।

জয়নালের সহযোগী আরিফ জানান, সব চামড়াই তারা যথাযথ দাম দিয়ে কিনেছেন, কাউকে ভয়ভীতি বা হুমকি দিয়ে তারা চামড়া কেনেননি বলেও দাবি করেন তিনি। চামড়া কেনার দর কেমন জিজ্ঞাসা করা হলে জয়নালের অপর সহযোগী সুজন জানান, বড় আকারের গরুর চামড়া তার ৮শ’ টাকায়, মাঝারি শ্রেণীর ৬শ’ টাকায় এবং ছোট গরুর চামড়া তারা ৪/৫ শ’ টাকায় কিনেছেন। ছাগলের চামড়া কিনেছেন আড়াইশ’ থেকে সাড়ে তিনশ’ টাকায়।

পেশাদার চামড়া ব্যবসায়িরা তাদের সেসব চামড়া কেনার জন্য প্রায় দ্বিগুণ দাম বলছেন। এরপরও দর কষাকষি করছেন সুজনরা। মুন্না ও সুজন বলেন, ‘আমরা ছাত্র মানুষ-সারা বছরের মধ্যে এই একদিনই তো চামড়ার ব্যবসাটা করি। এলাকায় কোনো ঝুট্-ঝামেলা করি না বলে মানুষ আমাদের সেধে সেধেই চামড়া দিয়েছে। কারো কাছ থেকে মাগ্না (বিনামূল্যে) চামড়া নেওয়ার কোনো প্রমাণ পাইবেন না। ’  

যাত্রাবাড়ী ছনটেক মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা আব্দুল আউয়াল জানান, প্রতি বছর বিভিন্ন মহল্লা থেকে দুই শতাধিক গরুর চামড়া দান হিসেবে পাওয়া যায়। এবার মহল্লায় মহল্লায় যুবকরা জোর জবরদস্তি চামড়া সংগ্রহ করায় মাদ্রাসায় মাত্র ত্রিশ-বত্রিশটা চামড়া এসেছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কোরবানি দাতারা তাদের চামড়াগুলো নিজের ইচ্ছায় বিক্রি বা দান করতে পারেননি। বখাটে ছেলেপেলের ভয়ে তাদের হাতেই চামড়া তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে প্রাপ্য চামড়া থেকে এতিমখানা, মসজিদ-মাদ্রাসা বঞ্চিত হয়েছে।

এসব ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা মহানগর পুলিশের সদর দপ্তরের উপ-কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘চামড়া কেনাবেচা নিয়ে নগরীর কোথাও কোনোরকম হৈ হট্টগোল, মাস্তানি কর্মকাণ্ডের সুযোগ ছিল না। পুলিশ বিষয়টি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে নজর রেখেছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেউ অভিযোগ না দিলে পুলিশ তো আর নিজে নিজে অভিযোগ উত্থাপন করতে পারে না। মহল্লার বাড়ি বাড়ি পর্যায়ে হুমকি দিয়ে চামড়া নেওয়ার ব্যাপারে এ পর্যন্ত কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি বলেও পুলিশের উপ-কমিশনার হাবিবুর রহমান মন্তব্য করেন।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৭, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।