ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

সংবাদ বিশ্লেষণ:

যুদ্ধাপরাধ বিচার দ্রুত শুরু করার তোড়জোড়

সালাম ফারুক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৩২ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০১০

ঢাকা: মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ দ্রুত সক্রিয় হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীর তিন শীর্ষ নেতা ভিন্ন কিছু মামলায় গ্রেপ্তার হলেও তারা যে আসলে একাত্তর সালে কৃত যুদ্ধাপরাধের মামলায় আটক ও গ্রেফতার হতে যাচ্ছেন সে আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেতা, আইনজীবী ও রাজনীতি-বিশ্লেষকদের সর্ব সাম্প্রতিক বক্তব্য-বিবৃতি ও বিশ্লেষণে এ ইঙ্গিতই পাওয়া যাচ্ছে। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্র ও সরকারের নানামুখি তৎপরতাও সে কথাই বলে। ট্রাইব্যুনালে প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগসহ, সহায়ক উপকরণ সরবরাহ ইত্যাদি কাজে হঠাৎই অভ’তপূর্ব গতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের এ সংক্রান্ত সক্রিয়তা যুদ্ধাপরাধ মামলা দ্রুত চাঙ্গা করার ইঙ্গিতবাহী।

বিশেষ করে জামায়াত আমীর মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে গ্রেপ্তার করার পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা ছাড়াও যুদ্ধাপরাধ মামলাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। আর বিচার চলাকালে বিশৃঙ্খলা এড়াতে জনগণকে আগে থেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখার কৌশল হিসেবে সরকারদলীয় নেতারা বারবার যুদ্ধাপরাধ মামলার বিষয়টি তুলে ধরছেন।

সরকার এরই মধ্যে ’৭১-এর মানবতাবিরোধী কাজ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আইনজীবী প্যানেল ও তদন্তসংস্থার সদস্যদের চাহিদা অনুযায়ী সহায়ক সব কিছু দ্রুত গতিতে সরবরাহ শুরু করেছে। জামায়াতের তিন শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার পর গত মঙ্গলবারই তিনটি গাড়ি দেওয়া হয়েছে তদন্তসংস্থা ও আইনজীবী প্যানেল সদস্যদের। ট্রাইব্যুনালের ব্যাপারে এর আগে সরকারের  এতোটা মনোযোগ দেখা যায়নি।

এদিকে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সুষ্ঠু ও আন্তর্জাতিক মানের বিচার অনুষ্ঠানের স্বার্থে আইনজীবী প্যানেল-সদস্যদের জন্য প্রয়োজনীয় গাড়ি ও তদন্তসংস্থার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল দ্রুত নিয়োগ করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি এমন কথাও বলেছেন, প্রয়োজনে উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ও পরিদর্শক (ইনস্পেক্টর) পদমর্যাদার কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হবে।

আইনমন্ত্রী শনিবার সকালে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘তদন্ত সংস্থার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল চাইলে জামায়াতের গ্রেপ্তার হওয়া শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধের মামলায়ও গ্রেপ্তার দেখাতে পারবে। ’

এর আগে বুধবার ট্রাইব্যুনালের জ্যেষ্ঠ তদন্ত কর্মকর্তা আবদুর রহিম জানান, তদন্তের জন্য তৈরি অভিযুক্তদের তালিকায় গ্রেপ্তার হওয়া এই তিন জামায়াত নেতার নাম রয়েছে। চলতি সপ্তাহে আরও ১৬ তদন্ত কর্মকর্তা যোগ দিচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘ট্রাইব্যুনাল সঠিক সময়েই এই তিন নেতাকে তাদের বিরুদ্ধে আনীত যুদ্ধাপরাধের  অভিযোগের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদের উদ্যোগ নেবে। ’

এদিকে ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল যখন বলবে তখনই গ্রেপ্তারকৃত জামায়াত নেতাদের যুদ্ধাপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হবে’’ বলে শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সংস্থা আয়োজিত এক মুক্ত আলোচনায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু ঘোষণা করেন।  

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করার পথে সরকারের এই সক্রিয়তার পাশাপাশি আরো একটা ব্যাপার লক্ষ্যনীয় । সেটা হচ্ছে খোদ সরকারি দল আওয়ামী লীগ, সমমনা দল ও সমাজের বিভিন্ন  স্তরের মানুষের পক্ষ থেকে আসা ক্রমাগত চাপ। তিন জামায়াত নেতাকে গ্রেফতার করার পর সে চাপ আরও বেড়েছে। দিন দুই আগে আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. নাসিম এক অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তৃতায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আইনি প্রক্রিয়া দ্রুততর করার দাবি জানিয়েছেন। তিনি এ তিনজনকে যুদ্ধাপরাধ মামলায় গ্রেফতার দেখানোর দাবি জানান।

তিনি বলেছেন, ‘শীর্ষ তিন জামায়াত নেতাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাই জনগণকে বিভ্রান্ত না করে চিহ্নিত তিন যুদ্ধাপরাধীকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় আসামি করে শিগগিরই বিচার করতে হবে। ’

শুধু নাসিম নন, আটক তিন নেতাকে যুদ্ধাপরাধ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলসহ নানা সংগঠন ও ব্যক্তি।

শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত এক প্রতিবাদ সভায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নেতারা বলেন, ‘চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেপ্তারের পর জামায়াত সারাদেশে অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছে। তাই এখনই যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করা প্রয়োজন। ’

একই দিন বিকেলে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলীয় কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ সমাবেশে আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম মন্তব্য করেন, ‘ট্রাইব্যুনাল যথাসময়েই জামায়াতের তিন নেতাকে যুদ্ধাপরাধ মামলায় গ্রেপ্তার দেখাবে। ’

এদিকে বসে নেই একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিও। কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির আজ রোববার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা এ অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে সাহায্য করতে সহায়ক মঞ্চ গঠন করেছি। এ ট্রাইব্যুনালের তদন্তসংস্থা ও আইনজীবী প্যানেলের সঙ্গে শিগগিরই আলোচনায় বসবো। তাদের কি ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন সেটা আমরা তাদের কাছে জানবো। ’ এ ব্যাপারে একই রকম মনোভাব ও প্রত্যয় সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম ও ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটিরও। তারাও বসে নেই। সব মিলিয়ে তিন জামায়াত নেতাকে দিয়েই যে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হতে যাচ্ছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে বিপুল পূর্ব করণীয় শেষ করে কখন তা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করা যাবে সেটাই প্রশ্ন।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫১ ঘণ্টা, জুলাই ০৪, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।