ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

গ্রেনেড হামলার আগে হাওয়া ভবনে যান আব্দুর রহিম: আদালতে সাক্ষী

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৩
গ্রেনেড হামলার আগে হাওয়া ভবনে যান আব্দুর রহিম: আদালতে সাক্ষী

ঢাকা: আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আগে কয়েকদিন জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) তৎকালীন মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) আব্দুর রহিম হাওয়া ভবনে গিয়েছিলেন।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় রোববার সাক্ষ্য দানকালে এ কথা জানান জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সহকারী পরিচালক ইউসুফ হোসেন।

মামলার ৪৫১ জন সাক্ষীর মধ্যে ৬৬তম সাক্ষী হিসেবে তিনি সাক্ষ্য দেন ঢাকায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ।

সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তাকে জেরা শুরু করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় সোমবার পর্যন্ত মুলতবি করেছেন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. শাহেদ নূর উদ্দিন।

আব্দুর রহিম মামলার ৫২ আসামির একজন। অধিকতর তদন্তের পর তারেক রহমানসহ অন্য ৩০ জনের মধ্যে তাকেও আসামির তালিকায় যোগ করে সিআইডি।

ইউসুফ তার সাক্ষ্যে বলেন,  ‘‘আব্দুর রহিম ২০০৪ সালের ১২ আগস্ট থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তখন আমি ও কনস্টেবল মনোয়ার সিএমএইচে ডিজি (রহিম) স্যারের দেখভালের জন্য রোস্টার ডিউটি করতাম। আমাদের সঙ্গে ওয়াকিটকি থাকতো। ১২ আগস্টের পর ২১ আগস্টের আগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একদিন আব্দুর রহিম হাওয়া ভবনে গিয়েছিলেন। ’’

 “ডিউটি চলার সময় একদিন ড্রাইভারকে (রহিমের গাড়িচালক) ওয়েটিং রুমে পাইনি। ফিরে এলে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান,  স্যারকে নিয়ে তিনি বনানীতে হাওয়া ভবনে গিয়েছিলেন। ”

ইউসুফ বলেন, ‘‘২১ আগস্ট বিকাল সাড়ে ৪টায় আমি আমার ওয়াকিটকিতে শুনতে পাই যে, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়েছে। এই খবরটি আমি ডিজি স্যারকে (রহিম) জানাই। তিনি শেখ হাসিনার খবর জানতে চাইলে আমি বলি, বিরোধী দলীয় নেত্রী বেঁচে থাকলেও গুরুতর আহত হয়েছেন। ”

মামলার রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান জানান, সাক্ষ্য শেষ হওয়ার পর ইউসুফকে জেরা শুরু করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় আদালতের কার্যক্রম সোমবার পর্যন্ত মুলতবি করেন বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা সোমবার ইউসুফকে পুনরায় জেরা করবেন।
উল্লেখ্য, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের জনসভায় সন্ত্রাসীরা ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালায়। হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৩ জন নির্মমভাবে নিহত হন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সাবেক বিরোধী দলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। আহত হন শতাধিক নেতাকর্মী।

এ ঘটনায় মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফারুক হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জলিল ও সাবের হোসেন চৌধুরী বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় পৃথক ৩টি মামলা দায়ের করেন।

মামলার প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা নিযুক্ত হন মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আমির হোসেন। এরপর ডিবি ইন্সপেক্টর শামসুল ইসলাম, সিআইডির এএসপি আব্দুর রশীদ ও মুন্সি আতিকুর রহমানের হাত ঘুরে সর্বশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা নিযুক্ত হন সিআইডির এএসপি মো ফজলুল কবীর।

তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে এর তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে।

গ্রেনেড হামলার ৪৬ মাস পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৮ সালের ১১ জুন প্রথম চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি। প্রথম চার্জশিট দাখিল করেন সিআইডির এএসপি মো ফজলুল কবীর। এ চার্জশিটে ২২ জনকে আসামি করা হয়। আরও ৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হলেও ২ জন তদন্তকালে মারা যান এবং ৪ জনের সঠিক নাম ঠিকানা না পাওয়ায় তাদের মামলার দায় থেকে অব্যাহতির আবেদন করা হয়।

এছাড়াও ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় গ্রেফতারকৃত জজ মিয়াসহ অপর ২০ জনকেও অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয়।  

চার্জশিট দাখিলের পর ২০০৮ সালের ২৯ অক্টোবর মুফতি হান্নানসহ ২২ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলতে থাকার এক পর্যায়ে ৬১ জন সাক্ষী নেওয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মামলাটি পুনরায় তদন্ত চেয়ে আদালতে আবেদন করা হয়।

২০০৯ সালের ৩ আগস্ট ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক মো. মাসদার হোসেন বর্ধিত তদন্তের আবেদনটি মঞ্জুর করেন এবং ২ মাসের মধ্যে অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দানের জন্য পুলিশের আইজিকে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে মামলাটি দ্রুত বিচার আইনের নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বিচার কার্য সম্পন্ন করতে না পারায় মামলাটি ঢাকা মহানগর আদালতে পাঠিয়ে দেন।

বর্ধিত তদন্তকালে আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন মাওলানা আবদুস সালাম, কাশ্মীরি জঙ্গি মাজেদ ভাট, আবদুল মালেক ও মামলার প্রথম চার্জশিটভুক্ত আসামি হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নান। গত বছরের ৭ এপ্রিল মুফতি হান্নান দ্বিতীয় দফায় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। এতে এ হামলার ষড়যন্ত্র ও গ্রেনেড সরবরাহের বিষয়ে কয়েকজন নতুন আসামির নাম প্রকাশ করেন।

এর পর অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ৩ জুলাই আসামির তালিকায় ৩০ জনকে যোগ করে সম্পূরক চার্জশিট দেয় সিআইডি। মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ কমিশনার আব্দুল কাহার আকন্দ সম্পূরক চার্জশিটটি দেন। এতে মোট আসামি সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২ জনে।

সম্পূরক চার্জশিট দাখিলের পর জজ মিয়া নাটক সৃষ্টি করে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টার অভিযোগ এনে সিআইডির এএসপি আব্দুর রশীদ ও মুন্সি আতিকুর রহমানসহ ৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।

সম্পূরক চার্জশিটে নতুন করে যোগ হওয়া আসামি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, খালেদা জিয়ার সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাবেক সংসদ সদস্য মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদকে হাওয়া ভবনে প্রশাসনিক সহায়তা ও পরিকল্পনায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়। চার্জশিটে অভিযোগ করা হয়, মূলত শেখ হাসিনাকে হত্যা ও আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করার জন্যই এ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। হাওয়া ভবন থেকেই তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা হয়েছিল বলেও অভিযোগ করে আসছেন আওয়ামী লীগ নেতারাও।

সম্পূরক চার্জশিটে আরও যাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয় তারা হলেন, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব) সাইফুল ইসলাম ডিউক, বিএনপির ঢাকা মহানগর শাখার নেতা ও ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আরিফুর ইসলাম আরিফ, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, গোয়েন্দা প্রধান মেজর জেনারেল (অব) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী ও ব্রিগেডিয়ার আব্দুর রহিম, ডিজিএফআই’র সাবেক কর্মকর্তা লে.  কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জেহাদের (হুজি) বর্তমান প্রধান মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, হুজির নায়েবে আমির মাওলানা মাওলানা আব্দুল হান্নান ওরফে সাব্বির, হুজির সাবেক আমির ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টির (আইডিপি) আহ্বায়ক মাওলানা আবদুস সালাম, কাশ্মীরি জঙ্গি আবদুল মাজেদ ভাট ওরফে ইউসুফ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোস্তফা ওরফে জিএম, মাওলানা আব্দুর রউফ, হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই, বাবু ওরফে রাতুল বাবু, পুলিশের সাবেক ডিসি (পূর্ব) মো. ওবায়দুর রহমান, পুলিশের সাবেক ডিসি (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান, সাবেক আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা, সাবেক আইজিপি শহিদুল হক, সাবেক এএসপি আব্দুর রশিদ, সাবেক এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান, বিশেষ পুলিশ সুপার মো. রুহুল আমিন, তৎকালীন অতিরিক্ত আইজিপি (সিআইডি) খোদাবক্স চৌধুরী ও সাবেক মেজর জেনারেল এটিএম আমিন।

প্রথম চার্জশিটে আসামি করা হয়েছিল, জোট সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, হরকাতুল জিহাদের শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নান, মুফতি হান্নানের ভাই মুহিবুল্লাহ, মফিজুর রহমান ওরফে অভি, শরীফ সাহেদুল আলম বিপুল, মাওলানা আবু সাইদ ওরফে ডাক্তার জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলুবুল, মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, শাহাদত উল্যাহ ওরফে জুয়েল, হোসাইন আহমেদ তামিম, মইনুদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল, আরিফ হাসান সুমন, মো রফিকুল ইসলাম সবুজ, মোঃ উজ্জল ওরফে রতন, সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, মোঃ খলিল, জাহাঙ্গীর আলম বাবু, মোঃ ইকবাল, হাফেজ সেলিম হায়দার, লিটন ওরফে মাওলানা লিটন, মোরসালিন ও মোত্তাকিনকে।
বর্ধিত তদন্তে নতুন করে আরও ৮৩ জনকে সাক্ষী করা হয়। প্রথম চার্জশিটে শেখ হাসিনা, জিল্লুর রহমান, আব্দুল জলিল, আব্দুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমুসহ ৪০৮ জনকে সাক্ষী করা হয়েছিল। আলামত জব্দ দেখানো হয়েছিল ৬৯ ধরনের।

তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, কায়কোবাদসহ নতুন ৩০ আসামির মধ্যে ১৮ পলাতক আছেন। জামিনে আছেন বিএনপির ঢাকা মহানগর শাখার নেতা ও ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আরিফুর রহমান। অন্যারা কারাগারে আটক আছেন। প্রথম চার্জশিটের ২২ আসামির মধ্যে ১৪ জন কারাগারে ও ৮ জন পলাতক আছেন। পলাতকদের মধ্যে মোরছালিন ও মোত্তাকিন ভারতের তিহার জেলে আটক আছেন।

সম্পূরক চার্জশিট গ্রহণ করে পলাতক ১৮ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করে রেখেছেন আদালত।

এদিকে পরবর্তীতে মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত মামলাটি ফের ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ পাঠিয়ে দেন। সেখানকার বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন বর্তমানে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।

বাংলাদেশ সময়: ২০০৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৩
এমআই/ সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।