চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের অনেকগুলো আলোচিত ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্যে ২০১২ সালের সালের শেষের দিকে এসে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে নগরীর বহদ্দারহাটে সিডিএর নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙে পড়ার ঘটনা।
সিডিএর’র নিজস্ব তহবিল থেকে ১০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন এ ফ্লাইওভারের ১২ ও ১৩ নম্বর স্পেনের তিনটি গার্ডার ভেঙে পড়ে ১৬ জনের মৃত্যু হয়।
ঘটনার পর উত্তেজিত জনতা এ প্রকল্পের বিভিন্ন সরঞ্জাম ও বহদ্দারহাট পুলিশবক্সে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ওই এলাকায় ভাংচুর চালায়। তারা চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রেভিনিউ), ফায়ার সার্ভিসের ঊদ্ধারকারী যান এবং একটি অ্যাম্বুলেন্সও ভাঙচুর করে। এসময় উত্তেজিত জনতা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট পাথরও নিক্ষেপ করে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশ কয়েক রাউন্ড টিয়ারসেলও নিক্ষেপ করে ব্যর্থ হয়। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। ঘটনার পর রাত ১১টা থেকে উদ্ধারকাজ শুরু করে সেনাবাহিনী।
এ ঘটনার পর থেকেই সিডিএ’র স্বপ্নের ফ্লাইওভার চট্টগ্রাম নগরবাসীর কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাঁড়ায়।
অন্যদিকে ক্ষুব্ধ জনতার রোষাণলে পড়ার ভয়ে দুর্ঘটনার ৪দিন পরও ঘটনাস্থলে যেতে পারেনি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম। দুর্ঘটনার পরদিন ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেলে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ড.হাসান মাহমুদকে ধাওয়া দেয় উত্তেজিত জনতা।
এ ঘটনায় পরদিন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি, গৃহায়ন ও গণপূর্ত বিভাগের দুটি ও সিডিএ কর্তৃপক্ষের একটি সহ মোট চারটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এরমধ্যে তিনটি গঠন করা হয়েছে দুর্ঘটনার কারণ তদন্তে। একটি কমিটি গঠন করা হয় বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার প্রকল্পের কাজের মান যাচাইয়ে। গত ৩০ নভেম্বর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতিকে দায়ি করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় জেলা প্রশানের করা তদন্ত কমিটি। এছাড়া কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য ১২ দফা সুপারিশ করে কমিটি।
এ দুর্ঘটনার তিনদিন পর প্রকল্প পরিচালকসহ সিডিএ’র তিন প্রকৌশলীকে বরখখাস্ত করে কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি চান্দগাঁও থানার উপ- পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে প্রকল্প পরিচালকসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
এছড়া ২৯ নভেম্বর সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, প্রকল্প পরিচালক এ এমএম হাবিবুর রহমান, প্রধান প্রকৌশলী নাছির উদ্দিন মাহমুদ, প্রয়াত আওয়ামীলীগ নেতা জাহাঙ্গির সাত্তার টিংকুর স্ত্রী ও মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অ্যাটকো-পারিশা কনস্ট্রাকশন্সের স্বত্তাধিকারী খুজেস্তা ই নূর ই নাহরিন মুন্নী, নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান মির আক্তার-পারিশা(জেবি) কনস্ট্রাকশন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এ এ আর এম অ্যাসোসিয়েটস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ মতিনকে আসামী করে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম নুরে আলম ভূঁইয়ার আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। নাগরিক অধিকার ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠনের মহাসচিব লায়ন এ্যাডভোকেট যাদব চন্দ্র শীল বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলাটি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
গত ২৮ নভেম্বর ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন গণপূর্ত মন্ত্রণালয় গঠিত একটি তদন্ত কমিটি। কমিটির প্রধান শ্যামসুন্দর সিকদার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, কাজ করার সময় নিরাপত্তার যথেষ্ট ঘাটতি ছিল।
এ দুর্ঘটনায় হতাহতদের পরিবারকে সিডিএর পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী পরিবারের সদস্যদের হাতে চেকত তুলে দেন। এছাড়া সমালোচনার মুখে পড়া সিডিএ চেয়ারম্যান তাঁর পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে হতাহতদের আর্থিক সহায়তা দেন।
প্রসঙ্গত, ২৪ নভেম্বর ছাড়াও চলতি বছরের ২৯ জুন এবং ২১ নভেম্বর নিমার্ণাধীন এই ফ্লাইওভারে দু’বার দূঘর্টনা ঘটে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি আর সিডিএর সঠিক তদারকির অভাবকেও দায়ী করেন তারা। প্রকৌশলীরা বলছেন, নির্মাণের পদ্ধতিগত ত্র“টি থেকে দুর্ঘটনা ঘটেছে। আগের দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা না নেয়ার কারণেই এ ধরণের দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
বাকি কাজ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে:
বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার প্রকল্পের বাকি কাজ শেষ করার দায়িত্ব নিচ্ছে সেনাবাহিনী। চট্টগ্রাম ফ্লাইওভারের তিনটি গার্ডার ভেঙে পড়ে হতাহতের সার্বিক পরিস্থিতি সেনাবাহিনীকে সার্বিক কার্যক্রম তদারকিসহ পুরো কাজ শেষ করতে এ দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম বাংলানিউজকে বলেন, বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার প্রকল্পের বাকি কাজ শেষ করার দায়িত্ব নেয়ার জন্য মন্ত্রণালয় ও সিডিএ‘র পক্ষ থেকে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
কাজ শুরুর প্রাক প্রক্রিয়া হিসেবে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের একটি টিম ফ্লাইওভার পরিদর্শন করেছে। এসময় সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী নাছির উদ্দিন মাহমুদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম নগরীর ব্যস্ততম এলাকা বহদ্দারহাট জংশনে যানজট নিরসনে ফ্লাইওভার নির্মাণের উদ্যোগ নেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ)। ২০০৯ সালে এ ফ্লাইওভারে ভিত্তি স্থাপনের পর সিডিএর অধিনে ২০১০ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন এ ফ্লাইওভারের কাজ করছে পারিশা এন্টারপ্রাইজ ও মীর আক্তার এন্টার প্রাইজ নামে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশ সময়:১২ ৫১ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১ ২০১২
এমইউ/টিসি