জাহিদ মালেক। মানিকগঞ্জ-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন।
জেলার বালুমহাল থেকে শুরু করে সবজির আড়ত পর্যন্ত, সব ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণ ছিল জাহিদ মালেকের। এই আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে নিজস্ব বাহিনী গড়েছিলেন তিনি। বাহিনীটিকে নিয়ন্ত্রণ করতেন তার একমাত্র ছেলে রাহাত মালেক।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে স্থানীয় ও ভুক্তভোগীরা জাহিদ মালেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন।
সাটুরিয়া ও মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন এবং মানিকগঞ্জ পৌরসভা নিয়ে গঠিত মানিকগঞ্জ-৩ আসন। নৌকা প্রতীকে টানা চারবার এ আসন থেকে এমপি পদে বিজয়ী হন জাহিদ মালেক। গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগের শাসনামলে জাহিদ মালেক গড়ে তুলেছেন মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ১০ তলা বাণিজ্যিক ভবন, বিশাল বাগানবাড়ি, সভা-সেমিনার করার জন্য ছেলের নামে ‘শুভ্র সেন্টার’, ঢাকায় একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লটসহ বনানীতে ১৪ তলা বিটিএ টাওয়ার। গত ২০০৮ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকা পর্যন্ত ১১ গুণ সম্পদ বেড়েছে জাহিদ মালেকের। মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে সহযোগী সংগঠনের সব পদ-পদবিতে নেতা নির্ধারণে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন জাহিদ মালেক। তার সাম্রাজ্যে কেউ বাধা হতে চাইলে তাকেই সরিয়ে দিতেন তিনি। ‘দুষ্ট ও অসৎ’ লোকজন নিয়ে কমিটি ঘোষণা করে বাণিজ্য করাই ছিল সাবেক এই মন্ত্রীর কাজ। উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কে কোন পদ পাবেন, টাকার বিনিময়ে তা নির্ণয় করেছেন সাবেক এই মন্ত্রীর ছেলে রাহাত মালেক।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, জেলায় বালু মহালগুলোর অধিকাংশই নিয়ন্ত্রণ করত জাহিদ মালেক বাহিনী। এসব বালু মহাল থেকে বড় একটি মাসোহারা প্রতি মাসে পেতেন জাহিদ মালেক। মাসোহারার অর্থ দিতে দেরি হলে পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হতো ব্যবসায়ীদের। একপর্যায়ে এই বালু মহালের মাসিক মাসোহারার অর্থ কম বলে নারাজি প্রকাশ করেন সাবেক এই মন্ত্রী। পরবর্তী সময়ে মহাল পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশার ওরফে মাটি বাশার এবং জাহিদের বিশ্বস্ত সহচর আফসার সরকারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর বালু মহাল নিয়ন্ত্রণে রেখে শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন জাহিদ মালেক ও তার বাহিনী। মানিকগঞ্জে সরকারিভাবে স্বল্পমূল্যে সার পাওয়ার কথা থাকলেও সেই সার নিয়ন্ত্রণ করতে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়েছিলেন জাহিদ মালেক। সাবেক এই মন্ত্রীর আস্থাভাজন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আবু বক্কর তুষার গং জেলার সার নিয়ন্ত্রণ করেছে। চড়া দামে কালোবাজারে এই সার পাচার করেছেন তারা। এদিকে সার না পেয়ে কৃষকরা হাহাকার করেছেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জানলেও সেসময় কিছু বলতে সাহস পায়নি। আবু বক্কর তুষার গংয়ের সিন্ডিকেটের কারণে জেলা-উপজেলার সাধারণ কৃষককে চড়া দাম দিয়ে সার কিনতে হতো। এতে উৎপাদন খরচ অনেকাংশেই বেড়ে যেত তিন গুণ। আর অতিরিক্ত মূল্যে কালো বাজারের সার বিক্রির বড় একটি অংশ পেতেন জাহিদ মালেক।
মানিকগঞ্জ-৩ আসনের জাগীর ইউনিয়নের মেঘশিমুল এলাকার চাষি জয়নাল মিয়া বলেন, সার কেনার কথা সরকার নির্ধারিত ডিলারের কাছ থেকে। তবে মৌসুমের শুরুতে কিছু সার পেলেও মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে সংকট দেখা দিত। যেহেতু সার সংকট সেজন্য বাধ্য হয়েই প্রতি কেজি সারে ২-৩ টাকা বেশি দিয়ে বাইরের দোকান থেকে ক্রয় করতে হয়েছে আমাদের। অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে সার ক্রয়ের কারণেই উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যেত। মানিকগঞ্জের পরিবহন সেক্টরের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করত জাহিদ মালেক গং। জানা গেছে, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে প্রতিটি যানবাহন থেকে জিপির নামে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা তুলত মালেক বাহিনী। সরাসরি এই বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতেন পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ও জেলা শ্রমিক লীগের নেতা বাবুল সরকার ওরফে কানা বাবুল। এই সেক্টর থেকে বছরে দুই শত কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়েছে এবং সিংহভাগ নিতেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
জেলার সদর উপজেলার মানড়া এলাকার বাস মালিক সিদ্দিক মিয়া বলেন, আওয়ামী লীগের শাসনামলে পরিবহন সেক্টর ছিল তাদের কাছে সোনার হরিণ। এই পরিবহন সেক্টরের বাস মালিক সমিতির সভাপতি আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের আস্থাভাজন হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত ছিলেন। ওই সময়টাতে আমাদের মতো সাধারণ বাস মালিকদের জিম্মি করে ইচ্ছেমতো জিপির নামে চাঁদা আদায় করেছেন জাহিদুল। প্রতিটি পরিবহনের মালিক ক্ষুব্ধ হলেও নীরবে সব অত্যাচার সহ্য করে গেছেন, কারণ জাহিদুলের মাথার ওপর ছিলেন সাবেক মন্ত্রীর ছায়া। সেলফি পরিবহনের এক শ্রমিক লতিফ বলেন, পাটুরিয়া ঘাট থেকে ঢাকার গাবতলী পর্যন্ত যেতে প্রতিটি গাড়িকে চাঁদা দিতে হয়েছে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকা পর্যন্ত। এই জিপির নামের বড় একটি চাঁদার টাকার নিয়ন্ত্রণ ছিল বাস মালিক সমিতির সভাপতি জাহিদুল ইসলামের হাতে। অন্য কেউ জিপির টাকা তুললে জানাজানি হবে বিধায় তার নিজের আপন ভাই মাহিদুল ইসলাম ও মাহিন খান নামের এক নারী ওই টাকা সরাসরি লেনদেন করতেন। এই ধরনের চাঁদার পর তো পুলিশের একটি মাসোহারা আছেই। সব মিলিয়ে গত ১৫ বছরে পরিবহন মালিকসহ শ্রমিকরা তেমন সুবিধা করতে পারিনি।
মানিকগঞ্জ-৩ আসনেই সীমাবদ্ধ ছিল না জাহিদ মালেকের একচ্ছত্র আধিপত্য, বাকি দুটি সংসদীয় আসনেও চলত তার তাঁবেদারি। কোন প্রতিষ্ঠানে কোন ঠিকাদার কাজ করবে সেটাও তিনি নির্বাচিত করতেন। এই কাজে তাকে সহায়তা করতেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুলতানুল আযম খান আপেলসহ নির্দিষ্ট একটি মহল। প্রতিটি ঠিকাদারি কাজের লাভের একটি অংশ নিজ পকেটে নিতেন জাহিদ মালেক। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আতিকা সরকার জেপির কর্ণধার আকরাম খান বলেন, গত ১৫টি বছর আমরা যারা সাধারণ ঠিকাদারি কাজ করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেছি তাদের পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে জাহিদ মালেকের সিন্ডিকেট। কাজ পাওয়ার জন্য অনলাইনে আবেদন করলেও তার মধ্যে বিভিন্ন কারসাজি করে, কাজ দিতে নয়ছয় করেছে। অথচ তাদের পছন্দের ঠিকাদারদের একের পর এক কাজ করেই চলছিল। এমনও হয়েছে আমরা কাজ শেষ করেও বিল পাইনি, ঘুরতে হয়েছে বছরের পর বছর। কিন্তু আওয়ামী লীগ বা মন্ত্রী সিন্ডিকেটের ঠিকাদাররা কাজ শুরুর পরপরই আংশিক বিল পেয়ে যেত। এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে আওয়ামী লীগের অনেক বড় বড় নেতাসহ সরকারি প্রকৌশলীরা জড়িত ছিলেন। আউটসোর্সিং খাতে জেলার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়।
অভিযোগ, এসব নিয়োগের জন্য প্রতিজনকে গুনতে হয়েছে আড়াই থেকে তিন লাখ করে টাকা। আউটসোর্সিংয়ে যারা নিয়োগ পেয়েছে তাদের বলা হয়, চাকরি স্থায়ী হলে আরও পাঁচ লাখ করে টাকা দিতে হবে। এসব আউটসোর্সিংয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের আস্থাভাজন সহচর আফসার উদ্দিন সরকার। নিয়োগের পুরো টাকাই নিজের কবজায় নেন জাহিদ মালেক। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক তার নির্বাচনি এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা কমিটিতে নিজের লোক রাখার জন্য বলপ্রয়োগ করতেন। এ ক্ষেত্রে সুপারিশকৃত ব্যক্তি অযোগ্য হলেও কমিটিতে রাখতে হতো। যে কারণে দীর্ঘদিন ধরে ওইসব অঞ্চলে শিক্ষার ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। অধিকাংশ কমিটিতে জাহিদ মালেকের বাহিনীর উগ্র সমর্থকদের রাখায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এভাবেই মানিকগঞ্জে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন জাহিদ মালেক।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন