ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

রাজউকের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বাঁধছে

স্টাফ করেস্পন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭০৯ ঘণ্টা, জুলাই ৩, ২০১০
রাজউকের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বাঁধছে

ঢাকা: রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান নুরুল হুদার বক্তব্যকে ঘিরে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন জাতীয় সংসদের সাংসদরা। তারা চেয়ারম্যানের বক্তব্যকে ‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।



অপরদিকে গাজীপুরে রাজউকের ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ডিএপি) বাস্তবায়নের বিরোধিতা করে জনগণকে নিয়ে আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন সাংসদ জাহিদ আহসান রাসেল। তিনি বলেছেন, প্রয়োজনে তিনি সংসদ সদস্যের পদ থেকে পদত্যাগ করতে প্রস্তুত। কিন্তু গাজীপুরের জনগণের স্বার্থবিরোধী কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে দেবেন না।

সাংসদদের তোপের মুখে নুরুল হুদা

সাংসদদের জড়িয়ে রাজউক চেয়ারম্যানের বক্তব্যকে শিষ্টাচার লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছেন সংসদ সদস্যরা। চেয়ারম্যানের বক্তব্য উদ্দেশ্যমূলক বলে মন্তব্য করে এজন্য তার ব্যাখ্যা চাইতে তাকে সংসদীয় কমিটিতে তলব করার দাবি জানিয়েছেন তারা।

এবিষয়ে প্রতিকারে চেয়ে সাংসদরা জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদের কাছে লিখিতভাবে আবেদন জানাবেন এবং সংসদ অধিবেশনেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন।

‘একটি স্বার্থান্বেষী মহল, যাদের মধ্যে বর্তমান সংসদ সদস্যরাও রয়েছেন, ড্যাপ বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করছে। ’-রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান নুরুল হুদা সম্প্রতি এমন মন্তব্য করায় সাংসদদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে।

এরই মধ্যে সাংসদরা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত বিভাগের সংসদীয় কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাংসদরা বলেছেন, দেশের আইন প্রণেতাদের হেয় করে রাজউক চেয়ারম্যান কার এজেন্ডা বাস্তবায়নে নেমেছেন, সেটা আমাদের জানতে হবে।
তারা বলেন, ঢাকা মহানগরীকে একটি পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা বিগত আওয়ামী লীগ সরকার  নিয়েছে। এটা কোনো বিশেষ মহলের পরিকল্পনা নয়। কাজেই একটি বাস্তবসম্মত ড্যাপ- নকসাও এ সরকারই করবে। তারা বলেন, রাজউক চেয়ারম্যান একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়েও ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স মেনে কথা বলেননি।

জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আব্দুস শহীদ বলেন, ‘রাজউক চেয়ারম্যান এধরনের মন্তব্য করে অবশ্যই ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স লঙ্ঘন করেছেন। কারণ সংসদ সদস্যরা তার কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। ’

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী বলেন, ‘সংসদ সদস্যরা আমার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। রাজউক চেয়ারম্যানের সব বক্তব্যের নথিপত্র সংগ্রহ করা হচ্ছে। আগামী ৬ তারিখের বৈঠকে এ বিষয়ে আমরা যারা কমিটির সদস্য তারা প্রথমে আলোচনা করবো। পেপারকাটিং ও ভিডিও কিপিংগুলো দেখে পরে সিদ্ধান্ত নেব। ’

সাংসদ ফজলে করিম চৌধুরী বলেন, ‘রাজউকের কর্মকান্ড নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ সংসদীয় কমিটি কাছে এসেছে। সংসদীয় কমিটি রাজউকের কর্মকান্ড তদন্ত করবে। ’

হাবিবুর রহমান মোল্লা বলেন, ‘তাকে অবশ্যই সংসদীয় কমিটিতে তলব করে জিজ্ঞাসা করতে হবে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে তিনি সাংসদদের নিয়ে এমন মন্তব্য  করেছেন। ’ তিনি বলেন, ‘আমরা জনগণের সরকার। জনগণের স্বার্থই আমরা দেখবো। যারা কেতাব নিয়ে বসে বসে নগর পরিকল্পনার নকশা তৈরি করে। তাদের মাঠে আসার আহবান জানাচ্ছি। তাদের বিলাসী বিষয় বাস্তবায়ন করলে লাখ লাখ মানুষ ভূমিহীন হবে। ’

সাংসদ জাহিদ আহসান রাসেল বলেন, ``রাজউক চেয়ারম্যান সুশীল সমাজ নামধারী কয়েকজন ব্যক্তিকে নিয়ে অসংসদীয়ভাবে কেন এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন তা খতিয়ে দেখতে হবে। তিনি বলেন, রাজউক চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত  স্বার্থ না থাকলে এখন অন্তত ড্যাপ নিয়ে তিনি কথা বলতেন না। তাছাড়া তিনি সাংসদদের নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তার বড় খেসারত তাকে দিতে হবে। ``

সাংসদ সুকুমার রঞ্জন ঘোষ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ``জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে কোনো সরকারি কর্মকর্তার এ ধরনের মন্তব্য করা আইনবিরোধী ও অসংসদীয়। একজন সরকারি কর্মকর্তা যা খুশি বলতে পারেন না। ``

আকম মোজাম্মেল হক বলেন, ``সংসদ সদস্যদের কুচক্রী বলায় নরুল হুদাকে জনসম্মুখে আসতে হবে। ``

কামাল মজুমদার বলেন, ``এভাবে কথা বলা তার উচিত হয়নি। তার উচিত ছিল ‘মাননীয় সংসদ সদস্য’ বলা। ``

মোস্তফা জামাল মহিউদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ``কারা কি কারণে কুচক্রী এটা তাকে নির্দিষ্ট করে বলতে হবে। ``

বেনজীর আহমেদ বলেন, ``আমাদের চেয়ে কি তার ড্যাপপ্রীতি বেশি?``

নাসরুল হামিদ বিপু বলেন, ``রাজউক চেয়ারম্যান সাংসদদের কাজের ফিরিস্তি নেওয়ার কে?``

রাজউক চেয়ারম্যান নুরুল হুদা বলেন, ``আমি সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে কথা বলিনি। আমি বলেছি মাননীয় সংসদ সদস্যদের ড্যাপ বাস্তবায়নে আইন প্রণয়ন করা উচিত। কিন্তু গণমাধ্যমে আমার বক্তব্য সাঠিকভাবে ছাপা হয়নি। ``

একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে জনপ্রতিনিধিদের প্রতি দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেওয়া এবং তাদের প্রকাশ্যে সমালোচনা করে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স লঙ্ঘন করেছেন কি না -এ প্রশ্নের কোন জবাবে তিনি বলেন, ‘এপ্রসঙ্গে আমি কোন কথা বলতে চাই না। ’

উল্লেখ্য ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের অবস্থান রাজউক চেয়ারম্যানের ছয় ধাপ উপরে। সাংসদদের অবস্থান ১৩ নম্বরে। আর রাজউক চেয়ারম্যানের অবস্থান ১৯-এ।

গত বুধবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসকাবে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) আয়োজিত ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড:বাস্তবায়ন এবং করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, ‘একটি কুচক্রীমহল ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) বাস্তবায়নে যারা বাধা সৃষ্টি করছে, যাদের মধ্যে অনেক সংসদ সদস্য রয়েছেন। ’

গাজীপুরে রাজউক প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু, নেতৃত্বে সাংসদ

‘গাজীপুরে রাজউকের জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে দেওয়া হবে না। রাজউকের যত উন্নয়ন আছে তারা তা গাজীপুরের দক্ষিণে, উত্তরায় করুক। তারা যাতে গাজীপুরে না আসে। ’

গতকাল শুক্রবার বিকালে গাজীপুর সদর উপজেলার বোর্ড বাজার এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে গাজীপুরে রাজউক প্রতিরোধ কমিটি আয়োজিত প্রতিবাদ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি জাহিদ আহসান রাসেল তিনি একথা বলেন।

জাহিদ আহসান বলেন, ‘রাজউকের প্রেতাত্মাদের পুনর্বাসনের জন্য গাজীপুরবাসীকে উচ্ছেদ করতে দেওয়া যাবে না। এলাকাবাসীর চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি রক্ষায় তাদের পাশে আছি, থাকব। প্রয়োজনে জনগণের স্বার্থে সংসদ সদস্যপদ ছেড়ে দেব। রাজউকের উপ-শহরসহ অন্যান্য প্রকল্প বাতিল না করা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। ’

বিকাল ৪টায় প্রতিবাদ সভা আহবান করা হলেও ৩টার দিকে হাজার হাজার এলাকাবাসী মিছিল নিয়ে সভাস্থলে আসতে থাকে। এলাকাবাসী ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পশ্চিমাংশেও অবস্থান নেয়। এতে মহাসড়কের ওই পাশ দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

গাজীপুর সদর থানা আওয়ামী লীগের সংগঠনিক সম্পাদক এসএম শামীমের সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য রাখেন, সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কাজী মোজাম্মেল হক, প্রতিরোধ কমিটি আহবায়ক ও গাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম, গাজীপুর সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলম, গাছা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ, গাছা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মোশারফ হোসেন খান, সাধারণ সম্পাদ আব্দুল হামিদ, গাছা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুস সামাদ, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মহিউদ্দিন আহম্মেদ, ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সদস্য আব্দুল্লাহ আল মামুন মন্ডল, ইফতেখার আলম মনির, মশিউর রহমান, ফারুক হোসেন খান প্রমুখ।


কাজী মোজাম্মেল হক বলেন, ‘৫০ বছর আগে ডিআইটি জমি হুকুম দখল করেছিল। মানুষ তার ক্ষতিপূরণ এখনো পায়নি। আমরা বাপ দাদার ভিটে-মাটিতে যেমন আছি তেমনই থাকতে চাই। আমরা রাজউক চাই না। ’

আহবায়ক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ এখানে অসংখ্য পোশাক কারখানা রয়েছে। এ সব কারখানা থেকে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব পাচ্ছে। লাখ লাখ শ্রমিক এ সব কারখানায় কাজ করছে। এগুলো উচ্ছেদ হলে তারা বেকার হয়ে পড়বে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সাংসদ, চেয়ারম্যানসহ জন প্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মতামত নেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করে সম্প্রতি পত্রিকায় যে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। তিনি বলেন, ‘পরিবেশবান্ধব বলে গাজীপুরে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের পক্ষে রাজউকের বিভিন্ন সভায় ড. মোজাফ্ফর আহমেদ ও ড. কামাল হোসেন অভিমত দিয়েছেন। আমি এর তীব্র নিন্দা জানাই । গাজীপুরে তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করছি। ’

উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘টঙ্গীর উত্তর পাশে রাজউককে আসতে দেওয়া হবে না। ’

গাছা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ বলেন, ‘ রাজউককে জনবহুল এই এলাকা গ্রাস করতে দেওয়া হবে না। জীবনের বিনিময়ে হলেও তা রক্ষা করব। ’
এদিকে শুক্রবার সকালে সাংসদ মোজাম্মেল হকের গাজীপুরস্থ বাসভবনের সামনে রাজউকের অধিগ্রহণ-আতঙ্কিত এলাকাবাসী সমবেত হলে তাদের উদ্দেশ্যে ভুমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও গাজীপুর-১ আসনের সাংসদ আ.ক.ম মোজাম্মেল হক বলেন, নিজস্ব জমি থেকে গরীব মানুষদের উচ্ছেদ করে ধনীদের আবাসন তৈরির রাজউক-পরিকল্পনা মানবতাবিরোধী।

তিনি আরো বলেন, ‘রাজউককে গাজীপুরে  আসতে দেয়া হবে না। ’

পরে এলাকাবাসী জেলা শহরে ট্রাক, টেম্পুতে চড়ে মিছিল করেন।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময়: ১৭০৯ ঘন্টা ৩ জুলাই ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।