ঢাকা, শুক্রবার, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৬ জুন ২০২৫, ০৯ জিলহজ ১৪৪৬

জাতীয়

সিলেটে মৃত্যুকূপে বসবাস ৩৮৬ পরিবারের

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:১৫, জুন ৫, ২০২৫
সিলেটে মৃত্যুকূপে বসবাস ৩৮৬ পরিবারের

সিলেট: প্রতিবছর ভারী বর্ষণে ভূমিধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি সিলেটে।

টিলা ধসে একই পরিবারের চারজন প্রাণ হারিয়েছেন। এ ছাড়া সিলেটের আরও বিভিন্ন স্থানেও পাহাড়-টিলার পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে মৃত্যুকূপ অসংখ্য পরিবার বসবাস করছেন। মৃত্যুর ঘটনার পরও টিলার পাদদেশে ঝুঁকিতে বসবাস থামছে না। এ ব্যাপারে প্রশাসনের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ।

জানা গেছে, বৃষ্টি এলেই টিলার পাদদেশে বসবাসকারীরা দিনযাপন করলেও ভয়ে রাত কাটান অন্যের ঘরে। তাদের ধারণা দিনে টিলা ধসে পড়বে না, কিংবা সচেতন থাকতে পারবেন এবং দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে পারবেন। বড়দের এই চিন্তাধারা থাকলেও ঝুঁকিতে থেকে ছোট ছোট শিশু ও বৃদ্ধরা।

সিলেট জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসনকেন্দ্রের তথ্যমতে, জেলার মধ্যে ৩৮৬ পরিবারের এখন বসবাস টিলার পাদদেশে মৃত্যুকূপে। যে কারণে প্রতিবছরই ঘটছে দুর্ঘটনা। আর কখনো দুর্ঘটনা ঘটলেই কেবল সতর্কতার হাঁকডাক পড়ে যায়। এমনি ঘটেছে এবারও সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষনাবন্দ ইউনিয়নে টিলা ধসে চার মৃত্যুর পর।

সিলেটে কি পরিমাণ লোকজন পাহাড়-টিলার পাদদেশে বসবাস করেন, সরকারিভাবে এর কোনো তালিকা নেই। কেবল পরিবারের হিসাব রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রভাবশালীচক্র টিলা কাটা বা দখলে রাখার জন্য টিলার পাদদেশে ঘর-বাড়ি বানিয়ে ভূমিহীনদের কম ভাড়ায় রাখেন। কম ভাড়া পেয়ে খুশিতে মৃত্যুকূপে বসবাস করেন অনেক পরিবার। পাশাপাশি টিলা কেটে ঘরবাড়ি নির্মাণ ও শ্রেণি পরিবর্তন করা হচ্ছে। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। টানা বৃষ্টি হলেই সিলেটে পাহাড়-টিলা ধসের খবর পাওয়া যায়। এসব ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়-টিলার পাদদেশে ৩৮৬টি পরিবার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করলেও তাদের সরিয়ে নেওয়ার কোনো উদ্যোগ আজও পরিলক্ষিত হয়নি।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসনকেন্দ্র সিলেটের তথ্যানুযায়ী, সিলেটে ২৭৯ পাহাড়-টিলার মধ্যে ১৬৯ ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। এর মধ্যে গোলাপগঞ্জ পৌর এলাকায় পাঁচ টিলার পাদদেশে সাতটি পরিবার, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ৭১ টিলা ঘেঁষে ৮৮ পরিবার, বিয়ানীবাজার উপজেলায় নয় টিলায় নয় পরিবার, কানাইঘাট উপজেলায় একটি টিলায় তিন পরিবার, কানাইঘাট উপজেলার মোট ৭৫ টিলার মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ এক টিলায় তিন পরিবার, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ঘিলাছড়া ইউনিয়নের ১২ টিলায় ৩৮ পরিবার, বিশ্বনাথ উপজেলার এক টিলায় ছয় পরিবার, সিলেট সদর উপজেলার খাদিমনগরে ২৫ টিলায় মোট ৭০ পরিবার, খাদিমপাড়ায় ১৫ টিলায় মোট ৩৯ পরিবার, টুকেরবাজার ২০টিলায় ১২৫ পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে।

অবশ্য সিলেটের জকিগঞ্জে নয়টি টিলা, গোয়াইনঘাটের পূর্ব জাফলংয়ে ঝুঁকিপূর্ণ একটি টিলাসহ মোট ২৭ টিলা রয়েছে। এগুলোতে জনবসতি নেই বলেও জানা গেছে।

সিলেটে প্রতিবছর ভারী বৃষ্টিতে বিভিন্ন টিলা-পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে যায় এবং মাটি ধসে ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটে মাঝেমধ্যে বড় ধরনের ট্র্যাজেডির সৃষ্টি হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১০ বছরে সিলেট বিভাগে টিলার মাটি ধসে অন্তত অর্ধশতাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।

ঘটনাগুলোর জন্য টিলা-পাহাড় কর্তনকেই মূলত দায়ী করছেন পরিবেশবাদী ও বিশেষজ্ঞরা।

এরপরও সিলেটে কিছুতেই বন্ধ হয় না পাহাড়-টিলা কাটা। সর্বশেষ শনিবার (১ জুন) সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায় ভারী বৃষ্টিতে টিলা ধসে পড়ে এক পরিবারের চারজন নিহত হয়েছেন।

গতবছরের ১০ জুন সিলেট মহানগরীর মেজরটিলার চামেলীভাগ আবাসিক এলাকায় টিলা ধসে মাটি চাপা পড়ে একই পরিবারের তিন সদস্য নিহত হন। এতে আহত হন আরও তিনজন। নিহতরা হলেন, আগা করিম উদ্দিন (৩১), তার স্ত্রী শাম্মী আক্তার রুজি (২৫) ও তাদের শিশু সন্তান নাফজি তানিম। একইস্থানে টিলা ধসে ১৯৯৭ সালে প্রাণ হারিয়েছিলেন হুনদা নামের এক যুবক।

এদিকে বর্ষা মৌসুমে সিলেট জেলায় টিলা ও পাহাড় ধস হলেও এগুলোর পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করেন মানুষজন। ফলে প্রতিবছরই সিলেটে ঘটে টিলা বা পাহাড় ধসে মৃত্যুর ঘটনা। মহানগরীসহ সিলেট জেলার বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়-টিলায় কয়েক বছর আগেও মানুষের তেমন আনাগোনা ছিল না কিন্তু এখন এসব সেসব এলাকায় গড়ে উঠেছে ঘনবসতি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেট নগরীর হাওলাদারপাড়া, আখালিয়া, পীরমহল্লা ব্রাহ্মণশাসন জাহাঙ্গীরনগর, তারাপুর চা বাগান এবং নগরীর উপকণ্ঠের বালুচর, বিমানবন্দর সড়ক, খাদিমপাড়া, খাদিমনগর, জোনাকি, ইসলামপুর মেজরটিলা, মংলিরপাড় এলাকায় বিভিন্ন টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে কয়েকশ পরিবার।

এ ছাড়া জৈন্তাপুর, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় টিলা ও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে কয়েক হাজার মানুষজন।

সিলেট মহানগরীর ছয় নম্বর টুকেরবাজার ইউনিয়নের জাহাঙ্গীরনগর এলাকায় কয়েকজনের সাথে কথা হলে তারা বলেন, বৃষ্টিতে টিলার পাদদেশে দিনে বসবাস করলেও রাতে পরিবার-পরিজন নিয়ে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় চলে যান। ছোট ছোট শিশু ও বৃদ্ধরাও এই মৃত্যুঝুঁকিতে দিন পার করছেন। বর্ষা মৌসুম আসার আগে কিংবা কোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকলেও প্রসাশনের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয় না। যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর প্রশাসন থেকে মাইকিং করা হয় কিন্তু বর্ষা আসার আগে কোনো ধরনের নির্শেনা কিংবা কোনো ধরনের ঝুঁকি সম্বলিত বিলবোর্ড টানানো হয় না।

পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হাই বলেন, বছর তিনেক আগে একটা জরিপ চালিয়ে দেখেছিলাম, জেলায় টিলার পাদদেশে প্রায় ১০ হাজার পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন। এখন এই সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে। বসবাসের জন্য এসব টিলার অনেকাংশ কেটে ফেলায় টিলাগুলোও দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে এগুলো ধসে পড়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। অপরিকল্পিতভাবে টিলা কাটা, বৃক্ষ উজার ও টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসের ফলে বৃষ্টি হলেই টিলা ধসে পড়ছে বলে মত ওই পরিবেশকর্মীর।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, সিলেটে নির্বিচারে পাহাড় টিলা কাটা হয়। পাহাড় কাটার কৌশল হিসেবে পাহাড়ের পাদদেশে নিম্নআয়ের মানুষের জন্য বসতি বানানো হয়। ঝুঁকি নিয়ে কয়েক হাজার মানুষ বাস করেন এসব পাহাড়-টিলার আশপাশে। ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাহাড় বা টিলা ধসে একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

এনইউ/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।