ঢাকা: ভোট না দিয়ে ঘোরাতে থাকলে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মহাসচিব ও বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের (বিএসপিপি) সদস্য সচিব কাদের গণি চৌধুরী।
মঙ্গলবার (৩ জুন) সকালে ‘অবৈধ পুশ-ইন বন্ধ করা, ভারতীয় নাগরিকদের ফেরত পাঠানো, মানবিক করিডোর, ত্রাণ চ্যানেল প্রসঙ্গ, সীমান্ত নিরাপত্তা বৃদ্ধি’ শীর্ষক নাগরিক সভায় প্রধান আলোচকের বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।
কাদের গণি চৌধুরী বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে, হাসিনার বিরুদ্ধে শত শত মানুষ জীবন দিয়েছে, হাজার হাজার মানুষ জীবন দিয়েছে গণতন্ত্রের জন্য, ভোটাধিকারের জন্য। আমরা যেন এ কথাটি ভুলে না যাই। গণতন্ত্রের সবচেয়ে সুন্দর পথ হলো ভোটাধিকার। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভোটাধিকারের বাইরে অন্যকিছু চিন্তা করা যায় না। আমরা বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ দেখতে চাই। আমরা চাই, দেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার আসবে এবং তারা একটি মানবিক বাংলাদেশ গঠনের জন্য কাজ
করবে। ভোট না দিয়ে ঘুরাতে থাকলে এ সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। এ সরকার আমাদের সবার আন্দোলনের ফসল, এ সরকার ছাত্র-জনতার জীবনের বিনিময়ে অর্জিত সরকার। আমরা চাই না এ সরকার বিতর্কিত হোক। আমরা যেন গণতন্ত্রের পথে হাঁটি, ফ্যাসিস্ট হাসিনার পথে না হাঁটি।
সীমান্তে ভারতের পুশ-ইন নিয়ে তিনি আরও বলেন, সীমান্তে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র প্রতিনিয়ত আইন-কানুনকে অবজ্ঞা করে, শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে কিছু লোককে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের ওপর একটি চাপ সৃষ্টির জন্য ভারত এই পুশ-ইন শুরু করেছে। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে একটি অস্থিতিশীলতা তৈরির জন্য ভারত এ অপকর্মটি করছে। জোরপূর্বক এক দেশ থেকে আরেক দেশে মানুষকে ঠেলে দেওয়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে আরও কঠোর হওয়া দরকার। কারণ স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো আপস চলে না, চলতে পারে না।
বিএফইউজের মহাসচিব আরও বলেন, বাংলাদেশ পুশ-ইন বন্ধের জন্য ভারতকে একটি চিঠি দিয়েছিল। তারা (ভারত) এটা আমলে নেয়নি। বিজিবি এবং বিএসএফ এর মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছিল। তারা কোনো কিছু কর্ণপাতই করছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ভারত পায়ে পাড়া দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি বিরোধ তৈরি করতে চায়। স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আমার প্রশ্ন হলো- এই যে অপকর্মগুলো ভারত করে যাচ্ছে, আমরা (বাংলাদেশ) কী তার যথাযথ জবাব দিতে পারছি? আমাদের মধ্যে যদি ন্যূনতম দেশপ্রেম থাকে আমাদের এ বিষয়ে আরও বেশি সোচ্চার হওয়া দরকার ছিল, যেটা আমরা এখনো পারিনি।
তিনি বলেন, সীমান্তে বরাবরই ভারতের অবস্থান আক্রমণাত্মক। তাদের আচরণ একেবারেই ভয়ঙ্কর। বিএসএফ নিয়মিত বাংলাদেশের মানুষকে গুলি করে হত্যা করছে। আমাদের (বাংলাদেশ) সীমান্তে ঢুকে ফসল কেটে নিয়ে যাচ্ছে। আবার যাতে সহজে তাদের দেশের মাদক-অস্ত্র আমাদের দেশে আসতে পারে, সেই ব্যবস্থা তারা (বিএসএফ) করে দেন। এ অবস্থায় আমাদের শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে হবে। আমাদের মধ্যে দেশপ্রেম, দেশত্ববোধ জাগ্রত করতে হবে। আমাদের সরকারগুলোর মধ্যে এটার অভাব রয়েছে।
২০০২-২০০৩ সালেও ভারত একবার এমন পুশ-ইন করেছিল জানিয়ে তিনি আরও বলেন, যখন তারা (ভারত) বিএনপি সরকারকে উৎখাত করার জন্য নানা ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। তারা (ভারত) এই কাজগুলো তখনই করে, যখন তাদের পছন্দের সরকার থাকে না। এখনো সেই কাজগুলো করছে। হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য তারা (ভারত) এ অপকর্মটি করছে। এটা সবার কাছে সুস্পষ্ট।
ভারতকে আগ্রাসী মনোভাব পরিত্যাগ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশকে যদি দুর্বল ভাবেন, সেটা ভারতের চরম ভুল। এদেশের ৩০ লাখ মানুষ বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে সেসময়ের আগ্রাসী পাকিস্তানের কবল থেকে বাংলাদেশকে উদ্ধার করেছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। তাদের (শহীদ) রক্তস্রোত আমাদের শিরায় শিরায় বয়ে বেড়াচ্ছে। অতএব ভারত যদি আমার স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত আনতে চায়, বাংলাদেশের মানুষ বসে থাকবে না, প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।
ভারতের উদ্দেশে বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সদস্য সচিব বলেন, বন্ধু হিসেবে আমরা তোমাদের পাশে চাই, আগ্রাসী শক্তি হিসেবে নয়। তুমি (ভারত) যদি আগ্রাসী হও, জবাব দেওয়ার জন্য আমরা (বাংলাদেশ) প্রস্তুত আছি। তোমাদের বলি, এসব অপকর্ম, আগ্রাসী মনোভাব বন্ধ করো।
অন্তর্বর্তী সরকারকে ভারতের এসব আগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, প্রয়োজনে এ বিষয় আন্তর্জাতিক মহলে আপনারা (অন্তর্বর্তী সরকার) তুলে ধরুন।
কাদের গণি চৌধুরী আরও বলেন, বাংলাদেশে গত ১৮ বছর ধরে যে গণতন্ত্র হত্যা হয়েছিল, ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন থেকে শুরু করে ফ্যাসিস্ট হাসিনা পর্যন্ত এর পুরোটার মদদ দিয়েছে ভারত। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে গুলি করে শিক্ষার্থী হত্যার সাহস হাসিনা পেয়েছে ভারতে ইন্ধন, মদদ, পৃষ্ঠপোষকতায়। ভারত কখনো কারো বন্ধু হয় না। এর প্রমাণ হলো- তাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, চীন, নেপাল, ভূটানের সঙ্গে তাদের বৈরী সম্পর্ক।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে দেশপ্রেমিক, সাহসী সরকার দরকার। যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে। যারা শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ভারতের পদতলে বাংলাদেশে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে সমর্পণ করতে চায়, সেই ধরনের কোনো সরকার আমরা চাই না। মানবিক করিডোর আমরা মানি না।
ক্ষমতায় দীর্ঘদিন থাকার পাঁয়তারা স্বরূপ এ ধরনের কোনো চক্রান্তের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ একমত হতে পারে না।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুকোমল বড়ুয়া বলেন, আমার ঘর, জায়গা-জমি রক্ষা করার দায়িত্ব যেমন আমার, তেমনি দেশ, মাটি ও জনগণকে রক্ষা করার দায়িত্বও আমার। আমরা যদি দেশপ্রেমিক হই, আমরা যদি আমাদের ভাতৃত্বমূলক পারস্পরিক সম্পর্কগুলো রক্ষা করি, বীরত্ব দেখাই, তাহলে বাইরের দেশ কোনোভাবে আক্রমণ করতে পারে না। এজন্য প্রথমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিরোধী দলের মধ্যে এ বোধ আনতে হবে। তৃতীয়ত, বিরোধী দলকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এদেশ গণতান্ত্রিক দেশ। গণতান্ত্রিক দেশ হলে, গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে হবে আমাদের। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার প্রধান শর্ত হচ্ছে, সুষ্ঠু নির্বাচন।
সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা পরিষদের উপদেষ্টা বিচারপতি আব্দুস সালাম মামুনের সভাপতিত্বে ও পরিষদের প্রধান সমন্বয়ক মো. মোস্তফা আল ইহযাযের সঞ্চালনায় নাগরিক সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ টি এম জিয়াউল হাসান, মেজর জেনারেল (অব.) আমসা আমিন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) খন্দকার ফরিদুল আকবর, সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা পরিষদের সমন্বয়ক প্রভাষক এম শাহজাহান সাজু, বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম মহসীন প্রমুখ।
এসসি/আরআইএস