রাজশাহী: রাজশাহী শহরে আসবেন, অথচ পদ্মার অপরূপ সৌন্দর্য না দেখে ফিরে যাবেন- তাতে আফসোস হবারই কথা। কিন্তু কী এমন দেখার আছে এই পদ্মায় বা এর পাড়ে ? এমন প্রশ্ন যারা করেন সংখ্যায় তারা অবশ্যই বিরল।
জীবনানন্দের ভাষায় বলা যায় ‘যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই...’
কিন্তু এদের বাইরে আছেন লক্ষ কোটি মানুষ যারা প্রথম দর্শনেই পদ্মার মোহনীয় রূপ-মাধুর্য্যে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যান। অনেকেই যারা পদ্মা বা পদ্মাপাড়ের অবারিত অপরূপ সৌন্দর্য নিজ চোখে দেখেননি, অন্যদের কাছে শুনে তারাও অধীর আগ্রহে দিন গোনেন পদ্মাপারে বেড়াতে যাওয়ার আশায়।
আর সে কারণেই দেশি-বিদেশি হাজারো মানুষ প্রতিদিন ভীড় জমান রাজশাহীর পদ্মাপারে। তবে বিনোদনপিপাসু প্রকৃতি-প্রেমী এসব পর্যটক-দর্শনার্থীর জন্য তেমন কোনও সুযোগ-সুবিধা বা অবকাঠামো তৈরি করেনি পর্যটন মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশন, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কিংবা সরকারের অন্য কোনও বিভাগ।
রাজশাহীবাসীর অভিযোগ, চাহিদা ও অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এত বছরেও রাজশাহীতে তেমন কোনও পর্যটনকেন্দ্র গড়ে ওঠেনি।
শুধু পদ্মাপাড়ের অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে সহজেই দেশি-বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ করে বিপুল রাজস্ব আয়ের সুযোগ রয়েছে এখানে। । এটা করতে পারলে এ অঞ্চলে ব্যবসা বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি হতো, সৃষ্টি হতো ব্যাপক কর্মসংস্থানেরও সুযোগ। কিন্তু পর্যটন মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে উদাসীন
পদ্মাপাড়ে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য রাজশাহীবাসীর দাবি এখনো অরণ্যে রোদন হয়েই রয়েছে। কোনও এক রহস্যময় কারণে জনপ্রতিনিধি বা সরকারের কর্তাব্যক্তিদের নজরেই আসছে না বিষয়টি।
তবে রূপসী পদ্মার আকর্ষণ এমনই অমোঘ যে সরকারের শত উদাসীনতা আর অবহেলার পরেও এখানে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষার বাছ-বিচার না করেই প্রতিদিন ছুটে আসেন শত শত মানুষ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বাংলানিউজকে জানায়, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তাদের সর্বশেষ ২০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনায় পদ্মা নদীকে ঘিরে একটি বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নিলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে- এজন্য কোনও অর্থ দেওয়া হবে না। আর এ কারণেই তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে ।
কিন্তু সরকারি কোনও উদ্যোগ না থাকলেও থেমে নেই বিনোদন পিয়াসী মানুষ। সৌন্দর্যপিপাসুরা প্রতিনিয়তই ছুটে আসছেন প্রকৃতির গড়া অপরূপা পদ্মার পাড়ে। আধুনিক নগরজীবনে আকাশ-সংস্কৃতির বিনোদনের বাইরে বিশেষ করে রাজশাহী নগরবাসী খানিক প্রশান্তির নাগাল পান পদ্মাতীরবর্তী বিভিন্ন স্পটে এসে। এ কারণেই প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এখানে ভিড় লেগে থাকে নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর এমনকি বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়া মানুষেরও।
সজেমিনে দেখা যায়, মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে চোখ-মনের তৃপ্তি লাভে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ পদ্মার তীরে ভিড় জমান। বিনোদনপিয়াসী মানুষের এই আনাগোনাকে ঘিরে পদ্মাতীরবর্তী শহররক্ষা বাঁধের ধারে প্রতিদিনই বসছে হরেক পদের অস্থায়ী সব দোকান।
এভাবে পদ্মাতীরবর্তী প্রায় দশ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে প্রতিদিনই বসছে হাজারো মানুষের মিলনমেলা। পদ্মাতীরের অনিন্দ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রং-রূপ-রস তারা পান করেন আকণ্ঠ। দিন শেষেও অনেকেরই ফিরে যেতে মন চায় না অপার্থিব সৌন্দর্যের এই অনন্য লীলাভূমি থেকে। কিন্তু তারা নিরূপায়, রাত কাটানোর জন্য এখানে নেই তেমন কোনও হোটেল-মোটেল বা আশ্রয়। নিরাপত্তার অভাবটাও প্রকট।
শুধু পদ্মাপাড়ই নয়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার কারণে নগরীর অন্যান্য বিনোদন কেন্দ্রগুলির অবস্থাও নাজুক। পদ্মাতীরবর্তী ৪০ একর জমিতে শহীদ কামরুজ্জামান কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানা, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) অধীনে পদ্মাপার্ক এবং সিটি কর্পোরেশনের নবনির্মিত শহীদ জিয়া শিশুপার্ক নামে তিনটি বিনোদনকেন্দ্র থাকলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল ও বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত।
এছাড়া সুপ্রাচীন বরেন্দ্র জাদুঘর, বড়কুঠি, শাহ মখদুম মাজার, শিশু একাডেমি ও শিল্পকলা একাডেমির মত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অবস্থাও প্রায় এক।
রুচিশীল বিনোদন কেন্দ্রের অভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ এবং নগরীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী তথা রাজশাহীবাসীর কাছে এখন সব থেকে পছন্দের বিনোদন কেন্দ্র পদ্মাপাড়। এই বিনোদন কেন্দ্রটি তৈরিতে কারও কোনও অর্থ ব্যয় হয়নি। তেমনি দর্শনার্থীদেরও নেই তেমন কোনও খরচ।
পদ্মায় এখন পানির স্তর অনকে নিচে। চোখ মেললেই দেখা যায় ধূধূ বালুচর। তারপরও বিনোদনের আশায় নারী, পুরুষ, শিশু বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষ ছুটে আসছে। নদীর পাড়ে বসছে অস্থায়ী সব খাবার আর খেলনার দোকান। এখানে চটপটি, ফুচকা বিক্রি করে অনেকেই সংসার চালাচ্ছেন। নৌকা ভ্রমণের মজা নিতে কেউবা আবার চরের ওপারে যাচ্ছেন নৌকায়। নৌকা চালিয়েও আয় করছেন অনেকেই।
তারপরে বাস্তবতা হচ্ছে এখানে আধুনিক পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে না।
রাজশাহী সিটি কর্পোরশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জান লিটন এ ব্যাপারে বাংলানিউজকে জানান, রাজশাহীর পদ্মাপাড়ে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। বিষয়টি সিটি কর্পোরেশনের প্রকল্পভুক্ত করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে নীতিগত সিদ্ধান্ত এলেই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে ঢাকায় পর্যটন কর্পোরেশনে যোগাযোগ করলে উপ-ব্যবস্থাপক জিয়াউল হক বাংলানিউজকে জানান, পদ্মাপাড়ের পর্যটন কেন্দ্রের বিষয়ে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক একটি চিঠি পাঠিয়েছেন পর্যটন মন্ত্রণালয়ে। এছাড়া পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় পদ্মাপাড়ে পর্যটন সুবিধাদি সৃষ্টির লক্ষ্যে পেপার-ওয়ার্ক চলছে।
তিনি জানান, পর্যটন মন্ত্রী জিএম কাদের সম্প্রতি বলেছেন, যদি বেসরকারি উদ্যোক্তারা এতে আগ্রহী না হয় সেক্ষেত্রে সরকার নিজস্ব উদ্যোগে তা করবে।
তিনি আরও জানান, একটি প্যাকেজ প্রকল্পের আওতায় রংপুর, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীর পর্যটন স্পটগুলোর উন্নয়নের পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৪, ২০১০