ঢাকা: নতুন বাংলাদেশে সবার জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে—এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে জার্নালিজম মানুষের অধিকার হরণ করেছে।
বৃহস্পতিবার (১৫ মে) জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী গণমাধ্যমের হালচাল’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে শফিকুল ইসলাম বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে এসেছে। বিশেষ করে একটি নতুন ‘সোস্যাল কন্ট্রাক্ট’ খুব জরুরি। এখন সাংবাদিকতার নামে দালালি করে স্বাধীনতার জায়গা ভয়াবহভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, মানুষের আস্থার জায়গা নষ্ট হয়েছে। এজন্য আমাদের নতুন এক ‘নিউ ইকোনমিক মডেল’ দরকার, যেখানে সাংবাদিকদের কপিরাইট রক্ষা পাবে, বেতন সুরক্ষা পাবে। বর্তমানে যা হচ্ছে তা টেকসই না, কেবল দুই-তিনজন সুবিধা পাচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা যা করেছি, সেটা আগে পরিষ্কার করতে হবে। আমরা অন্যায় করে থাকলে, সেটা স্বীকার করতে হবে। যে অন্যায় হয়েছে, সেটা বলা এবং মেনে নেওয়ার মধ্যেও এক ধরনের সাহস দরকার। যতক্ষণ না আমরা এটা বলছি, ততক্ষণ মানুষের আস্থা ফিরবে না। আমরা চাই সাংবাদিকতা আবার মানুষের আস্থার জায়গায় ফিরুক।
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে নীতিমালা থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্বের সব দেশেই সোশ্যাল মিডিয়া গাইডলাইন আছে। প্রতিটি মিডিয়ার উচিত এ ধরনের গাইডলাইন রাখা, যাতে ভারসাম্য বজায় থাকে। একজন সাংবাদিক সোশ্যাল মিডিয়ায় কী লিখছেন, তা প্রতিষ্ঠান দেখবে কি না—এই প্রশ্নের উত্তর এখনও খুঁজিনি আমরা। ৯ মাস পার করে ফেলেছি, ১৬ ধাপ এগিয়েছি, কিন্তু আমাদের আরও ১০০ ধাপ এগোনো উচিত ছিল।
বিদেশি গণমাধ্যম অধিকার সংস্থাগুলোর উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা আসেন, দেখে যান, আমরা কারো মুখ বন্ধ করছি কি না, বাকস্বাধীনতায় আঘাত করছি কি না। আমরা চেষ্টা করছি সাংবাদিকদের জন্য একটি সুরক্ষিত সাংবাদিকতা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। কেউ আক্রান্ত হলে, হুমকির সম্মুখীন হলে আমাদের জানাবেন, আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নেব।
তিনি আরও বলেন, নতুন বাংলাদেশে আমরা চাই, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সবার জন্য থাকুক—যেই মতাদর্শেরই হোন না কেন, রাজনৈতিক অবস্থান যাই হোক না কেন। কিন্তু সেই মতাদর্শ যেন গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে রক্ষা করে। এটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমরা চাই না আবুল আসাদদের মতো মানুষদের আবার টেনে-হিঁচড়ে বের করার পরিস্থিতি তৈরি হোক। এ ধরনের কাজ বাংলাদেশে আর না ঘটুক।
তিনি জানান, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ২৬৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে মাহমুদুর রহমানের মতো সাংবাদিককে রক্তাক্ত করার ঘটনাও রয়েছে, যার লিড দিয়েছিল এক সংবাদমাধ্যম।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামে সাংবাদিকেরা প্রতিবাদকারীদের ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। এখন যদি সেই প্রতিবাদকারীরা বলে, এসব মিডিয়া হাউজের দিকে মিছিল করে যাবো, তখন কী করবেন? এজন্যই আমরা বলছি, সাংবাদিকদের জন্য নতুন সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট দরকার।
আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন “ফ্যাসিবাদমুক্ত গণমাধ্যম চাই” প্ল্যাটফর্মের মুখপাত্র তারিক প্লাবন। তিনি বলেন, গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করবে—এই প্রত্যাশা থাকলেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সাংবাদিকতা পেশায় এখনো ফ্যাসিবাদী মনোভাব, দলীয় আনুগত্য এবং কর্পোরেট স্বার্থ প্রবলভাবে কাজ করছে। পুরোনো প্রভাবশালী সাংবাদিকরা এখনও তাদের অবস্থান ধরে রেখেছে এবং তাদের বয়ান নিউজরুম, টকশো এবং সম্পাদকীয় পাতায় দাপটের সঙ্গে ফিরে আসছে।
তিনি গণমাধ্যম সংস্কারের জন্য কয়েকটি দাবিও উত্থাপন করেন, যার মধ্যে সাংবাদিকদের অংশীদারিত্ব ও স্বাতন্ত্র্য নিশ্চিত করা, ফ্যাসিবাদী প্রচারক ও দালাল সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের অধীনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন, দুর্নীতিবাজ ও লুটেরা কর্পোরেট কোম্পানিগুলোকে গণমাধ্যম জগত থেকে বিতাড়ন এবং আওয়ামীপন্থী যে কোনো প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ, পাশাপাশি গণমাধ্যম কাঠামোগত সংস্কার করে সাংবাদিকদের জীবনমান উন্নয়ন ইত্যাদি রয়েছে।
ফ্যাসিবাদমুক্ত গণমাধ্যম চাই প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক জয়নাল আবেদীন শিশিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পিআইবির মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ, ডিইউজের সভাপতি শহিদুল ইসলাম, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর প্রধান প্রতিবেদক আব্বাস উদ্দীন নয়ন, এটিএন বাংলার প্রধান প্রতিবেদক একরামুল হক সায়েম এবং জুলাই রেভ্যুলুশনারি জার্নালিস্ট অ্যালায়েন্সের প্রতিনিধি ইসরাফিল ফরাজী। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ইমন মাহমুদ।
সভায় বক্তারা গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমের ভূমিকা, স্বাধীনতা ও দায়িত্ব নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। উঠে আসে পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় গণমাধ্যমের নতুন চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, সেই প্রশ্ন। পাশাপাশি গণমাধ্যমের পেশাগত স্বাধীনতা, তথ্যপ্রযুক্তির নতুন সুযোগ এবং সমাজে জবাবদিহিমূলক কাঠামো গঠনে সাংবাদিকদের করণীয় নিয়েও বক্তব্য দেন বক্তারা।
জিসিজি/এমজে