ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

সংবিধান প্রণয়ন বার্ষিকী ও প্রাসঙ্গিক কিছু তথ্য

আশরাফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩০২ ঘণ্টা, নভেম্বর ৪, ২০১২
সংবিধান প্রণয়ন বার্ষিকী ও প্রাসঙ্গিক কিছু তথ্য

ঢাকা: ৪ নভেম্বর, রোববার। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের চল্লিশতম বার্ষিকী।

১৯৭২ সালের এ দিনে তৎকালীন গণপরিষদে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান গৃহীত হয় এবং তা একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়। বাংলাদেশের জাতীয় ও বৃহত্তর জীবনে ৪ নভেম্বর অত্যন্ত তাৎপর্যময় ও ঐতিহাসিক একটি দিন।
বর্তমানের সংবিধানে ২০১১ সালের পঞ্চোদশ সংশোধনীসহ সংবিধানের ১৫টি সংশোধনী রয়েছে।

প্রাপ্ত্যতথ্য অনুয়ায়ী, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পথে দিল্লীতে তার সম্মানে আয়োজিত জনসভায় ‘গণতন্ত্র’, ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র প্রতি তার অঙ্গীকারের কথা ব্যক্ত করেন। সেই প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতেই রচিত হয় বাংলাদেশের সংবিধান।

সংবিধান রচনার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়, ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ জারিকৃত ‘গণপরিষদ আদেশ’। গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে ১৯৭২-এর ১০ এপ্রিল । মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ-এর সভাপতিত্বে অধিবেশনে স্পিকার ছিলেন, শাহ আবদুল হামিদ।

সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল আইন বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে ৩৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। একই বছরের ১৭ এপ্রিল থেকে ৩রা অক্টোবর পর্যন্ত এ কমিটি বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করে। জনগণের মতামত সংগ্রহের জন্য মতামত আহ্বান করা হয়। সংগ‍ৃহীত মতামত থেকে ৯৮টি সুপারিশ গ্রহণ করা হয়। ভারত ও ব্রিটেনের সংবিধানের আদলে তৈরি সংবিধানটি ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন সংবিধান বিলি আকারে গণপরিষদে উত্থাপন করেন। এরপর ৪ নভেম্বর, ১৯৭২ সালে বিলটি পাস হয় এবং আইনে পরিণত হয়।  

গণপরিষদের সদস্যরা ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭২ সংবিধানের বাংলা ও ইংরেজিতে স্বাক্ষর করেন। ৩৯৯ জন সদস্য হাতে লিখিত মূল সংবিধানে স্বাক্ষর করেন। প্রথম হাতে লিখিত সংবিধানটি ছিল ৯৩ পাতার, স্বাক্ষরসহ যা ছিল ১০৮ পাতা।  

সংবিধান লেখার সময় খসড়া পর্যালোচনার জন্য শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামানকে আহ্বায়ক, সৈয়দ আলী আহসান এবং মযহারুল ইসলামকে ভাষা বিশেষজ্ঞ হিসেবে একটি কমিটি গঠন করে পর্যালোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সেই সময়ে সংবিধান ছাপাতে ব্যয় হয়েছিলো মাত্র ১৪ হাজার টাকা। সংবিধানের অলংকরণের দায়িত্ব পালন করেন শিল্পী হাশেম খান । ১৯৪৮ সালে তৈরি ক্র্যাবটি ব্রান্ডের দুটি অফসেট মেশিনে ছাপা হয় ঐতিহাসিক এ সংবিধানটি ।

ঐতিহাসিক বাংলাদেশ সংবিধানে প্রস্তাবনা, ১৫৩টি নিবন্ধের সমন্বয়ে ১১টি আলাদা বিভাগ ও ৭টি তফসিল রয়েছে । সংবিধানে এ ১১টি ভাগ হচ্ছে-প্রজাতন্ত্র, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, মৌলিক অধিকার, নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা, বিচারবিভাগ, নির্বাচন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, বাংলাদেশের কর্মবিভাগ, সংবিধান সংশোধন ও বিবিধ।  

বহির্বিশ্বের সংবিধান: বিশ্বের যে সব দেশে সংবিধান প্রণীত হয়েছে, তাদের সবারই রয়েছে কিছু নিজস্বতা। সংবিধান প্রণয়নেও রয়েছে ভিন্নতা। কিন্তু মৌলিক বিষয়গুলোতে খুব বড় ধরণের পার্থক্য হয়তো ধরা দিবে না। তবে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের বিশেষত্ব হলো এটিই বিশ্বের সবচে’ কম সময়ে লিখিত ও গ‍ৃহীত কোনো সংবিধান। ১৮১ দিনে বিশ্বের অত্যন্ত সম্বৃদ্ধ বাংলাদেশের সংবিধান লিখিত ও গৃহীত হয়।

সাংবাদিক ও গবেষক শাহরিয়ার কবির সংবিধানের ইতিহাস নিয়ে এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘‘বর্তমান বিশ্বে লিখিত সংবিধান রয়েছে এমন দেশের সংখ্যা ১২৫টি। কিছু দেশ আছে যেখানে লিখিত সংবিধান নেই, লিখিত সংবিধান নেই, কতগুলো সর্বমান্য বিধান, চুক্তি ও আইনের মাধ্যমে সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালিত হয়, যার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ ইংল্যান্ড। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের অভু্যদয়ের ছয় দশক অতিক্রান্ত হয়েছে, তারা এখনও সংবিধান প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি। ’’

তিনি লিখেছেন, ‘‘লিখিত সংবিধান গ্রহণকারী ১২৫টি দেশের ভেতর বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের সংবিধান অতি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সংবিধান সবচেয়ে কম সময়ে মাত্র ১৮১ দিনে লিখিত ও গৃহীত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মূল সংবিধান ১শ দিনে লিখিত হলেও গৃহীত হতে সময় লেগেছে এক বছরেরও বেশি। ভারতের সংবিধান লিখতে সময় লেগেছে চার বছর। পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান লিখিত ও গৃহীত হতে সময় লেগেছে নয় বছর, দ্বিতীয় সংবিধান চার বছরে এবং তৃতীয় (বর্তমান) সংবিধান দেড় বছরে লিখিত ও গৃহীত হয়েছে। ভিয়েতনামের সংবিধান প্রণয়ন করতে সময় লেগেছে সতের বছর। স্বাধীনতা লাভের দু`শ` বছরে ভেনিজুয়েলা ছাব্বিশবার পুরনো সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান গ্রহণ করেছে। ’’

বাংলাদেশের সংবিধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেরা অবদান বলে উল্লেখ করেছেন এ সাংবাদিক।

১৯৭২-এর ৪ নভেম্বর গণপরিষদে সংবিধান গ্রহণের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবো না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এ রাষ্ট্রে কারও নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারও বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম করবে, তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বৎসর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানী, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার এ বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। ’’

সংবিধান প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক সে ভাষণে আরও বলেন, ‘‘যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলবো ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি। কেউ যদি বলে গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার নাই, আমি বলবো সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যদি গুটি কয়েক লোকের অধিকার হরণ করতে হয়, তা করতেই হবে। ’’

বাংলাদেশ সময়: ০৩৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৪, ২০১২
এআই/ সম্পাদনা: মাহাবুর আলম সোহাগ, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।