ঢাকা, বুধবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন, কাঁদালেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল

জেসমিন পাঁপড়ি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৪, ২০১২
সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন, কাঁদালেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল

ঢাকা: হুঁশ হওয়ার পর দেখি আমি রমনা থানায়। টর্চারের ফলে আমার পিঠে এবং পায়ের পেছনে কোনো চামড়া ছিল না।



মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে এসে এভাবেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অত্যাচার-নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন দেশবরেণ্য গীতিকার ও সুরকার মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তিনি গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ১৪তম সাক্ষী।

সাক্ষ্যদানকালে তিনি মুক্তিযুদ্ধকালে তাকেসহ কয়েকজনকে আটক, কয়েকজনকে হত্যা এবং তার নিজের ওপর লোমহর্ষক নির্যাতনের বর্ণনা দেন।

বৃহস্পতিবার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল সাক্ষ্য দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। তার পরে সাক্ষ্য দেন ১৫তম সাক্ষী ফরিদ আলম (৬০)।     

সাক্ষ্য দিতে গিয়ে সাক্ষী বুলবুল আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। এমনকি ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি ও তাকে সাক্ষ্যদানে সহায়তাকারী প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুমের গলাও ভারি হয়ে ওঠে। সাক্ষী ও সকলের নীরব কান্নায় বেদনাবিধূর হয়ে পড়ে ট্রাইব্যুনালের পরিবেশ।

সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে রাষ্ট্রপক্ষের ১৪তম সাক্ষী আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে জেরা করেন গোলাম আযমের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম। তবে ১৫তম সাক্ষী ফরিদ আলমকে জেরা করবেন না বলে জানান আসামিপক্ষ।

আগামী রোববার ৭ অক্টোবর গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৬তম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।

বর্তমানে ৫৭ বছর বয়সী আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের একাত্তরে বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। সে সময় ঢাকার আজিমপুরে ওয়েস্টটেন্ট হাইস্কুলে পড়ালেখা করতেন তিনি। তার পিতা মৃত ওয়াফিজ আহমেদ ও মাতা ইফাদ আরা নাজিমুন নেসা। স্নাতক ডিগ্রিধারী বুলবুল দেশের সুপরিচিত গীতিকার, সুরকার এবং সঙ্গীত পরিচালক।

মাত্র ১৫ বছর বয়সে ও স্কুলছাত্র থাকাকালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন বুলবুল। প্রথমে বন্ধু সজিবের নেতৃত্বে বিহারিদের অস্ত্র ছিনতাই করে একটি ছোট মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করেন তারা। জিঞ্জিরায় প্রথম মুক্তিযুদ্ধের ঘাঁটি তৈরি করে তারা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে বেশ কিছু প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। পরে বুলবুল তার বড় ভাই ক্র্যাক প্লাটুনের বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত ইফতেখার উদ্দিন আহমেদ টুলটুলের সঙ্গে ঢাকায় বেশ কিছু গেরিলা অপারেশনে অংশ নেন। সব শেষে তিনি ভারতে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে ফের বন্ধু সজিবের গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সশস্ত্র যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেন।

ওয়াই বা ইয়াং প্লাটুনের বীর এ যোদ্ধা কয়েকবার পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের হাতে আটক হয়ে পাশবিক ও রোমহর্ষক নির্যাতনের শিকার হন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে আটক থাকা অবস্থায় বুলবুল শহীদ সিরু মিয়া দারোগা ও তার সন্তান শহীদ কামাল আনোয়ার ও শহীদ নজরুলসহ ৩৮ জনকে ঈদের দিন রাতে কারাগার থেকে বের আনার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। ওই ৩৮ জনকে পরে হত্যা করে গণকবর দেয় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা, যে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ১১তম সাক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিউদ্দিন আহমেদ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৈরতলা দক্ষিণপাড়া গ্রামের সোনা মিয়া। ১৪তম সাক্ষী হিসেবে নির্মম সে গণহত্যার আরো বিস্তারিত বর্ণনাও করেন বুলবুল।

নিজের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ সম্পর্কে বুলবুল ট্রাইব্যুনালে বলেন, ‘‘ছোট বেলায় আমি দূরন্ত নির্ভীক ছিলাম। ৭১ সালের ২৫ ও ২৬ মার্চ যারা অবলোকন করেছেন, শুধু  তারাই আমার বিষয়টি অনুধাবন করতে পারবেন। ’’

‘‘আমার মনে পড়ে, ২৭ মার্চ কয়েক ঘন্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হয়েছিল। যখনই কারফিউ শিথিল করা হয়েছে আমি তখন বাইসাইকেল নিয়ে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, পড়ে পলাশি ফায়ার সার্ভিস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ, রোকেয়া হল, ব্রিটিশ কাউন্সিলের চতুর্দিক ঘুরেছি এবং লাশের পর লাশ দেখেছি। যা কি না আপনারা ছবির মাধ্যমে দেখেছেন। ’’

বুলবুল বলেন, ‘‘তারপর আমি এই জঘণ্যতম গণহত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। আমি ২৭  মার্চ বিকাল বেলায় একজন বিহারির বাসায় জোরপূর্বক ঢুকে তাদের বন্দুক ছিনতাই করি। এবং একটি ক্ষুদ্র দল গঠন করি। দলকে শেখাই, আমাদের আরো অস্ত্রের প্রয়োজন। ’’

‘‘এর মধ্যে সজিব নামের এক বন্ধুকে প্রধান করে আমরা বেশ কয়েকজন বিহারির বাসা থেকে অস্ত্র ছিনতাই করি। এবং জিঞ্জিরায় প্রথম মুক্তিযুদ্ধের ঘাঁটি তৈরি করি। ’’

সাক্ষী আরো বলেন, ‘‘আপনারা হয়তো শুনে থাকবেন, জিঞ্জিরিয়ায় পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করেছিল সেটা আমাদের কারণেই। আমরা সে আক্রমণের মুখে টিকে থাকতে না পেরে জায়গা পরিবর্তন করে জিঞ্জিরার কৈটা নামক স্থানে চলে যাই। সেখান থেকে আমরা সমস্ত অস্ত্র বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দিয়ে ঢাকায় চলে আসি। তারপর সেখান থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নেই, আমাদের অনেক ভারী অস্ত্র প্রয়োজন। তা না হলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করা যাবে না। এর পর আমরা বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েকদিন পালিয়ে বেড়িয়েছি। ’’

‘‘বাসায় ফিরে মায়ের কাছে জানতে পারলাম, আমার বড় ভাই ইফতেখার উদ্দিন আহমেদ টুলটুল (বর্তমানে মৃত) ২৭ মার্চ রাতে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। সেই থেকে আমার মনে স্বপ্ন ছিল, আমার ভাই ফিরে এলে অস্ত্র শিক্ষা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবো। ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয় মে মাসে। তার সঙ্গে আমাকে রাখার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাই। আমার ভাই ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য ছিলেন। তাদের কমান্ডার ছিলেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম। ’’

বুলবুল বলেন, ‘‘আমার বড় ভাই ও আমি মিলে একটি অপারেশনে যোগ দেই। সেটিই ছিল আমার প্রথম অপারেশন। আমরা আজিমপুর গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার অফিস পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম। সে মোতাবেক আমি নিজেই ডিনামাইট বসিয়েছিলাম। কিন্তু ওই মুহূর্তে কিছু সাধারণ ছাত্রী এসে যাওয়ায় ডিনামাইটটি চার্জ করতে পারিনি। ’’

‘‘পরবর্তীতে আমি ভাইয়ের কাছে অনুরোধ করি, কিছু গ্রেনেড দেওয়ার জন্য। ভাই আমাকে, মাহবুবকে এবং সারোয়ারকে এক সঙ্গে তিনটি করে গ্রেনেড দেন। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সেই গ্রেনেডগুলোর মধ্যে মাত্র দু’টি নিয়ে আমি এবং সারোয়ার নিউ মার্কেটের ১ নম্বর গেটের সামনে তিনটি পাকিস্তানি লড়ির ওপর হামলা চালাই। হতাহতের সংখ্যা কতো ছিল বলতে পারবো না। এরপর আমরা পলাতক ছিলাম। ’’

তিনি বলেন, ‘‘পরে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে আমরা ভারতে চলে যাই। সেখানে আগরতবলা হয়ে মেলাঘরে ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফিরে সজিব বাহিনীতে যোগ দেই। আমাদেরকে ওয়াই বা ইয়াং প্লাটুন বলা হতো। ’’

‘‘এরপর ২৯ অক্টোবর আবারো ভারতে যাওয়ার পথে  আমি, মানিক, মাহবুব ও সারোয়ার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের হাতে বন্দি হয়ে যাই। ’’

‘‘কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাঝামাঝি তন্তর চেকপোস্টে আটক হই। সেখানে ঘন্টাখানেক জিজ্ঞাসাবাদের পর যখন আমরা বারবার বলছিলাম, আমরা মুক্তিযোদ্ধা নই, তখন পাশবিক নির্যাতন শুরু করে। একটানা আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা নির্যাতনের পর আমাদের চারজনকে উলঙ্গ করে ফেলে। তখন আমাদের পরনে শুধু জাঙ্গিয়া ছিল। ’’

‘‘এরপর পাকিস্তানি সুবেদার আমাদের হত্যার নির্দেশ দেন। সে মোতাবেক পাশের মসজিদ থেকে একজন ইমাম ডেকে নিয়ে আমাদেরকে গরম পনিতে গোসল করিয়ে সুরা পড়ানো হয়। এরপর কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেধে দিলেও আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, দু’জন পাকিস্তানি সেনা মেশিনগান বা ওই জাতীয় কিছু তাক করেছিল। সে মুহূর্তেও আমি বিচলিত না হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুণছিলাম। ’’

‘‘হঠাৎ করে নিস্তব্দতার ভেতরে একটি ওয়ারলেসে বেজে ওঠার শব্দ শুনতে পাই। শুনতে পেলাম, ‘মুক্তিকো হেডকোয়ার্টার মে লে আও’। এরপর আমাদেরকে গুলি না করে উলঙ্গ অবস্থায় প্রায় ৫ ঘণ্টা বাসের মধ্যে নিচে বসিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাজাকার হেডকোয়ার্টারে আমাকেসহ বাকি তিনজনকে নিয়ে যায়।

‘‘সেখানে নিয়ে আমাদের চারজনকে আলাদা করে ফেলা হয়। আমাকে একটি ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হলে আমি দেখতে পাই, চেয়ারে ক্যাপ্টেন আলী রেজা বসে অছেন। তার মাথায় চুল ও সামনের দাঁত ছিল না। প্রথমেই তিনি আমাকে অভদ্র ভাষায় গালি  দেন। এরপর আমার নাম জিজ্ঞাসা করলে বলি, ‘মাই নেম ইজ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল’। এরপর আমি পড়ালেখা করি কি না জিজ্ঞেস করলে আমি তাকে ‘পড়ালেখা করি’ বলে জানাই। তিনি আমাকে বললেন, ‘শিক্ষিত ছেলে হয়ে তুমি কিভাবে ভাবলে পাকিস্তানের এতো বড় সৈন্য বাহিনীর সঙ্গে তোমরা যুদ্ধে জিতবে?’ আমি জবাব দিলাম, ‘স্যার আপনারা এখন কোনো র‌্যাংকিংয়ে নেই। আমরা যে র‌্যাংকিং দেবো, তাই আপনাদের র‌্যাংকিং। ’’ এরপর তিনি আমার মৃত্যুভয় আছে কি না জিজ্ঞেস করেন। জবাবে আমি তাকে একটি গালি দিলে তিনিও অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। এবং কাল দেখে নেবেন বলে হুমকি দেন। ’’

বুলবুল জানান, ‘‘আমাদের চারজনকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলখানায় পাঠায়। সেখানে আমাদের মতো বয়সী অনেক ছাত্রদেরকে দেখতে পাই। যাদে সঙ্গে বেশি পরিচিত হই তারা হলেন, শহীদ নজরুল, শহীদ কামাল, কামালের বাবা শহীদ সিরু মিয়া দারোগা, কুমিল্লার বাতেন ভাই, কুমিল্লার শফিউদ্দিন এবং আরো অনেকে। সেই জেলখানায় সম্ভতব ৫৫ জন মুক্তিযোদ্ধা বন্দি ছিলেন। নজরুল, সিরু মিয়া এবং কামাল তন্তর চেকপোস্টে আমাদের দু’দিন আগে ধরা পড়েছিলেন। ’’

‘‘পরের দিন আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পিস কমিটির অফিসে, যা ‘দারা মিয়ার বাড়ি’ হিসেবে পরিচিত। সেখানে নিয়ে প্রথমে যাকে দেখি তিনি হলেন কুখ্যাত পেয়ারা মিয়া। তার অশ্রাব্য উক্তি এবং নির্যাতনের কথা আমি সারা জীবন মনে রাখবো। ওই পিস কমিটির অফিসে অনেকক্ষণ নির্যাতনের পরেও যখন আমি কিছুই বলিনি তখন পেয়ারা মিয়া আমাকে আবারো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আর্মির সেল অফিসে পাঠান। ’’

‘‘সেখানে লেফটেন্যান্ট ইফতেখার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এভাবে আমাদের ৫৫ জনকে প্রতিদিন দু’বার করে প্রথমে পিস কমিটির অফিসে ও দ্বিতীয়বার আর্মি সেল অফিসে নিয়ে নির্যাতন করা হতো। তখন আমাদের শরীরের রক্ত শুকাতো না। আমাকে আর্মিদের সামনে দোভাষির কাজও করতে হয়েছে। ’’

ঈদের রাতে কারাগার থেকে ৩৯ জনকে বের করে আনার ঘটনা সম্পর্কে সাক্ষী বলেন, ‘‘শহীদ নজরুল তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তাকে একদিন পালিয়ে যেতে বললে তিনি আমাকে মারধর করে বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধারা পালাতে শেখেননি। এখান থেকে ফুলের মালা গলায় দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা একদিন আমাদেরকে মুক্ত করে নিয়ে যাবে। আমরা নজরুলের পিছনে নামাজ পড়তাম। তিনি আমাদের মাঝে ইফতারি বন্টন করতেন। তিনিই ছিলেন আমাদের নেতা। ’’

‘‘রোজার ঈদের দিন বাহ্মণবাড়িয়া জেলের দরজা খুব জোরে শব্দ করে খুলে যায়। আমরা সকলে চমকে উঠি। জেলের ভেতরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রবেশ করে উচ্চস্বরে ‘লাইন আপ, লাইন আপ’ বলে চিৎকার করে। আমরা এ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। ওই কথা শুনে আমরা জেলের গারদ থেকে বেরিয়ে কংক্রিটের মেঝেতে লাইন দিয়ে বসে পড়ি। ’’

‘‘সেখানে ক্যাপ্টেন আলী রেজা এবং লে. ইফতেখারকে দেখতে পাই। এরপর ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহ এবং অনেক রাজাকারসহ পেয়ারা মিয়াকে দেখতে পাই। ক্যাপ্টেন আলী রেজা আঙ্গুল তুলে একজন একজন করে দাঁড় করাতে থাকেন। আমাকে একা রেখে এভাবে প্রায় ৪৩ জনকে আলাদা করা হয়।

‘‘তখন আমি ভেবেছিলাম, এখনই বুঝি আমাকে হত্যা করা হবে। আমি সাহস করে ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহকে প্রশ্ন করি, ‘আমাকে নাকি ওদেরকে মারবে’। সাদুল্লাহ তখন আমার হাত ধরে বলেন, ‘আজকের দিনটা কত পবিত্র তুমি জানো’? জবাবে ‘আমি জানি’ বললে তিনি বলেন, ‘কোনো ভয় নেই। আজ এই দিনে কোনো মানুষকে হত্যা করা হলে সরাসরি আল্লাহর কাছে চলে যাবে’। এ সময় আমি জিজ্ঞাসা করি, তবে কি এই ৪৩ জনকে হত্যা করবেন‍?’ সাদুল্লাহ হাসিমুখে ‘সেটা করবো’ বলে জানান। ’’

‘‘এ সময় আমি তাকে আমার সঙ্গে থাকা মানিক, মাহবুব, খোকাকে আমার সঙ্গে রাখতে বলে আমাকে মারা হবে কিনা জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, যেহেতু দুই দিন পর আমাকে ধরা হয়েছে, এজন্য আরো দুই দিন পর আমাকে মারা হবে। তখন আমি মানিক, মাহবুবরাও আমার সঙ্গে ধরা পড়েছিল। তখন ওই তিনজনকে আলাদা করে আমার সঙ্গে রাখা হয়। ’’

‘‘এরপর আমি নজরুল ভাইয়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি, ভাই, আপনি তো পালিয়ে গেলেন না। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলেন, ‘আমার কিছু বলার নেই, রে! এই লুঙ্গিটা আমার মায়ের কাছে পৌঁছে দিস’। একটি সিগারেটের টুকরা দেখিয়ে সেটিও দিতে বলেন। ’’

‘‘কামালের বাবা সিরু মিয়া দারোগা বারবার কাঁদছিলেন। তখন কামাল তার বাবাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বলেন, বুলবুল, যদি কোনো দিন রাস্তায় কোনো পাগলিকে দেখিস তাহলে মনে করিস, ওটাই আমার মা। ’’

নজরুল বলেছিলেন, ‘যখন কোন পাক আর্মি দেখবি একটা করে মাথায় গুলি করবি’। কুমিল্লার বাতেন ভাই তার গায়ের চাদরটি আমাকে দিয়ে দিয়েছিলেন। সে চাদর দিয়ে আমি প্রত্যেকের চোখের পানি মুছে দিয়েছিলাম। ’’

এরপর সাক্ষী বলেন, ‘‘এরপর তাদেরকে (৪০ জন) নিয়ে যাওয়া হয় এবং আমাদেরকে গারদে আটকে রাখা হয়। আমার জানা মতে, তাদের মধ্য থেকে একজনকে জেল গেট থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরদিন আমি জানতে পারি, স্টেশনের পশ্চিমে পৈরতলা নামক স্থানে তাদেরকে এক নাগাড়ে হত্যা করা হয়েছে। ’’

‘‘এরপর আমাদের চারজনকে পুনরায় দারা মিয়ার টর্চার সেলে অর্থাৎ রাজাকার অফিসে নিয়ে যেয়ে টর্চার করা হয়। সে রাতে আমরা সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হই।   পালিয়ে আমরা বন্ধু মাহবুবের বোনের বাড়িতে উঠি। সেখানে আমাদেরকে দুধ দিয়ে গোসল করানো হয়। পরদিন আমরা লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে নৌকায় করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হই এবং আজিমপুরে এসে মায়ের সঙ্গে দেখা করি। ’’

‘‘সেই রাতে বাড়িতেই থাকি। মাঝরাতে আর্মিরা আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে আমাকে ধরে তেজগাঁও এমপি হোস্টেলে নিয়ে যায়। সেখানে সাতদিন রেখে আমাকে নির্যাতন করা হয়। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। হুঁশ হওয়ার পর দেখি, আমি রমনা থানায়। টর্চারের ফলে আমার পিঠে এবং পায়ের পেছনে কোনো চামড়া ছিল না। ’’

বুলবুল বলেন, ‘‘রমনা থানায় ৮৪ জন বন্দি ছিলেন। তাদের মধ্যে পাকিস্তান চ্যাম্পিয়ন পোল ভল্টার মিরাজ উদ্দিনকে দেখতে পাই। মিরাজ ভাই আমাকে অর্ধেক সুস্থ করে তোলেন। মিরাজ ভাইকে দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী একটি ইন্টারভিউ করিয়েছিল। তাতে মিরাজ ভাই বলেছিলেন, ‘ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক জোর করে মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়েছে। আসলে মুক্তিবাহিনী বলতে কিছু নেই। সে ইন্টারভিউ প্রচার করা হয়েছিল। পাকিস্তানি বাহিনী মিরাজ ভাইকে মুক্ত করে দেবে বলে আশ্বাস দিয়েছিল। পরবর্তীতে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে তাকে চিরতরে মুক্তি দেওয়া হয়। ’’

‘‘রমনা থানা থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি গাড়ি প্রতিদিন এসে সাতজন করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করতো। ৮৪ জন থেকে যখন ১৪ জনে আসলাম তখন দেশে মিত্রবাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়। সে আক্রমণের পর থেকে গাড়িটি আর আসেনি। এই দেশে সবাই স্বাধীনতা উদযাপন করেন ১৬ ডিসেম্বর। আমি তারপর দিন মুক্তি পাই। ’’

সাক্ষী বুলবুল বলেন, ‘‘স্বাধীনতার পর পরই আমি শহীদ সিরু মিয়া দারোগা এবং শহীদ আনোয়ার কামালের পরিবারের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। তবে ২০০৮ সালে যখন আমি ঘটনাসমূহ টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানে বলি, তখন ওই অনুষ্ঠান দেখে সিরু মিয়া দারোগার স্ত্রী ও কামালের মা আমার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করেন। ’’ ‘‘আমি জেনেছি, তার নাম আনোয়ারা বেগম। জেলজীবন নিয়ে তার সঙ্গে বিশদ আলোচনা না হলেও এ ঘটনার কিছু কথা তাকে বলেছি। যেভাবে একজন মায়ের কাছে তার শহীদ ছেলের কথা এবং স্ত্রীর কাছে তার শহীদ স্বামীর কথা বলতে হয়, আমি তার সঙ্গে সেভাবেই বলেছি। ’’

‘‘এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে’’ বলেও জানান আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।

এরপর আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের জেরা শেষ হয়। পরে সাক্ষ্য দেন গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৫তম সাক্ষী ফরিদ আলম (৬০)।

ফরিদ আলম বলেন, ‘‘ঢাকার ১৪২, পশ্চিম নাখালপাড়ায় আমার বাবা আমার নামে ২.১০ কাঠা জমি কিনে দেন। আমি পাকিস্তান আর্মিতে চাকরি করতাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ফিরে আসি। ১৪২, নাখালপাড়ায় আমার নামে ক্রয়কৃত হোল্ডিংয়ে একটি সেমি পাকা দালান এবং তার এক পাশে টিনশেড ছিল। সেখানে একটি মাদ্রাসা এবং জামায়াতে ইসলামীর অফিস ছিল। ’’

‘‘আমি দেশে ফিরে দেখি, সেখানে ছাত্রলীগের ছেলেরা ক্লাব খুলেছেন। তাদেরকে বুঝিয়ে আমি ওখান থেকে সরিয়ে দেই। তারপর সেখানে মাদ্রাসাটা পুনঃস্থাপণ করি। যে স্থানে জামায়াতে ইসলামীর অফিস ছিল সেঠি ভাড়া দিয়েছিলেন আমার বাবা। ’’

১৫তম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তাকে জেরা করবেন না বলে জানান আসামিপক্ষ।

ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয়ার্ধের সময় শেষের প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা আগেই রাষ্ট্রপক্ষের দুই সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়ে যায়। এ সময় ট্রাইব্যুনাল আর সাক্ষী উপস্থিত না থাকায় রাষ্ট্রপক্ষের ওপর আবারো বিরক্তি প্রকাশ করেন।

ট্রাইব্যুনাল বলেন, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ও গোলাম আযমের মামলায় কোনো মুলতবি দেওয়া হবে না। প্রতি কার্যদিবসেই এ দুই মামলার কার্যক্রম চলবে। কোনো পক্ষ সাক্ষী হাজিরে ব্যর্থ হলে সেখানেই তাদের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করা হবে বলে উভয়পক্ষকে সতর্ক করে দেন ট্রাইব্যুনাল।

গোলাম আযমের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত আরো ৬ জন ঘটনার সাক্ষী ও ৭ জন জব্দ তালিকার সাক্ষীসহ মোট ১৩ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। ঘটনার সাক্ষীরা হলেন, বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও গবেষক ড. মুনতাসীর মামুন, বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবউদ্দিন আহম্মদ বীরবিক্রম, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, মানবাধিকার কর্মী বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, মুক্তিযোদ্ধা শফিউদ্দিন আহমেদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৈরতলা দক্ষিণপাড়া গ্রামের সোনা মিয়া এবং একজন শহীদ পরিবারের নারী(ক্যামেরা ট্রায়াল)। আর জব্দ তালিকার সাক্ষীরা হলেন বাংলা একাডেমীর সহ গ্রন্থাগারিক মো. এজাব উদ্দিন মিয়া, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) রাজনৈতিক শাখার উচ্চমান সহকারী সেলিনা আফরোজ, কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের উচ্চমান সহকারী কাজী আইয়ুব হোসেন, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার কামালের বোন ডা. মুনিয়া ইসলাম চৌধুরী, জাতীয় যাদুঘরের কিপার ড. স্বপন কুমার বিশ্বাস, পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আমিনুল ইসলাম এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে কর্মরত সাঁট মুদ্রাক্ষরিক জামিনুর শেখ।
 
মানবতাবিরোধী ৫ ধরনের অপরাধের ৬১টি অভিযোগে অভিযুক্ত করে গত ১৩ মে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। ১০ জুন তার বিরুদ্ধে ওপেনিং স্টেটমেন্ট উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ। ১ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে সাক্ষ্যগ্রহণ।

গোলাম আযমের বিরুদ্ধে পাঁচ ধরনের অভিযোগ হলো, মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র, উস্কানি, পাকিস্তানি সেনাদের সাহায্য করা এবং হত্যা-নির্যাতনে বাধা না দেওয়া।

অভিযোগগুলোর মধ্যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা ও তাদের সঙ্গে চক্রান্ত করার জন্য ছয়টি, তাদের সঙ্গে পরিকল্পনার তিনটি এবং উস্কানি দেওয়ার ২৮টি এবং তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার ২৪টি অভিযোগ রয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ১১ জানুয়ারি গোলাম আযমকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে গ্রেফতার করা হয়।

পরে তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু কারাগারে পাঠানোর পর চিকিৎসার জন্য তাকে নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার বিচার চলছে।

এর আগে গত ৯ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউশনের দেওয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।

ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের জমা দেওয়া ওই আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মোট ৬২টি অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়। এর মধ্যে ৬১টি গ্রহণ করে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল।

২০১১ সালের ৩১ অক্টোবর গোলাম আযমের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করেন তদন্ত কর্মকর্তারা। পরে কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের মাধ্যম। মোট ৩৬০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনের পাশাপাশি ১০ হাজার পৃষ্ঠার নথিপত্র সংযুক্ত করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৪, ২০১২
জেপি/ সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর;  জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর  [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।