ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘শেরপুর এলাকার স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রধান ছিলেন কামারুজ্জামান’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১, ২০১২
‘শেরপুর এলাকার স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রধান ছিলেন কামারুজ্জামান’

ঢাকা: ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে আলবদর ও রাজাকার সদস্যরা সোহাগপুর ও বেনুপাড়া গ্রামের ২৪৫ জনকে হত্যা করে। এলাকার বল্লু বকা বুড়া, নসা ও কাদির ডাক্তার রাজাকার ছিলেন।

এ রাজাকারদের প্রধান ছিলেন কামারুজ্জামান। তারা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে এসে গ্রামে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে।

আমি এলাকার মুরুব্বিদের কাছে শুনেছি, নলিতাবাড়ী ও শেরপুর এলাকার আলবদর, রাজাকার ও আলশামসের প্রধান ছিলেন জামায়াত নেতা কামারুজ্জামান।
 
মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে এসে এসব কথা বলেছেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সন্তান মো. জালাল উদ্দিন। তিনি কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের দশম সাক্ষী।

সেদিনের গণহত্যা সম্পর্কে মর্মষ্পর্শী বর্ণনা দানকালে  জালাল উদ্দিন আরো জানান, শহীদদের মধ্যে তার বাবা, জেঠা ও মামাতো ভাইসহ কয়েকজন স্বজন ছিলেন।  

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে-২ সোমবার সাক্ষ্য দেন তিনি। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তাকে জেরা শুরু করেন কামারুজ্জামানের আইনজীবী কফিল উদ্দিন চৌধুরী। মঙ্গলবার পর্যন্ত জেরা মুলতবি করেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।

বর্তমানে ৬২ বছর বয়সী মো. জালাল উদ্দিন গণহত্যার সংঘটিত হওয়া শেরপুরের নালিতাবাড়ীর সোহাগপুর গ্রামের বাসিন্দা। তার পিতা মো. শফিউদ্দিনও শহীদ হন ওই ঘটনায়।

সাক্ষী তার সাক্ষ্যে বলেন, ‘‘১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে আলবদর ও রাজাকার সদস্যরা আনুমানিক সকাল সাতটা থেকে সাড়ে সাতটর দিকে গ্রামে ঢোকে। আমার ছোট ভাই আলাউদ্দিন দৌঁড়ে এসে এ খবর আমাকে বলে। তখন আমি এক স্থানে আর ছোট ভাই ধানের মাচায় পালিয়ে থাকি। ওই সময় প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। ’’

তিনি বলেন, ‘‘কিছুক্ষণের মধ্যে গোলাগুলির শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। গোলাগুলির শব্দ বন্ধ হয়ে গেলে আমি পূর্বদিকে যাই। সুরুজ আলীর বাড়ির পূর্ব দিকে চার জনের লাশ পড়ে থাকতে দেখি। তারা হলেন মন্তাজ আলী, শহীদ আলী, আবুল বাশার ও হাসেম আলী। ’’

‘‘সেখান থেকে ফিরে দেখি, আমার বাড়ির উঠানে আরো ১১ জনের লাশ পড়ে আছে। তাদের মধ্যে ছিলেন আমার বাবা সফিউদ্দিন, জেঠা কিতাব আলী, মামাতো ভাই মোন্নাস আলী, মোহাম্মদ আলী, মমিন মিয়া, কুটুমউদ্দিন, রেজত আলী, ঈমান আলী। নাম না জানা আরো অনেকের লাশ পড়ে আছে। তবে তাদের মধ্যে ঈমান আলী মরেননি। তার হাত নড়াচড়া করছে। ’’

তিনি বলেন, ‘‘ঈমান আলীর হাত নড়াচড়া করায় তার স্ত্রী এবং আমি মিলে দু’জনে ধরাধরি করে বরান্দায় নিয়ে যাই। বরান্দায় নেওয়ার পরে তিনি মূত্যুবরণ করেন। সারাদিন কান্নাকাটি করার পরে শহীদদের লাশ আলাদা আলাদা তিনটি স্থানে গণকবর দেওয়া হয়। ’’

সাক্ষি বলেন, ‘‘একসঙ্গে সাত জনকে, আর একটিতে তিন জনকে এবং একটিতে এক জনকে এভাবে মাটিচাপা দিয়ে গণকবর দিলাম। আমরা ওই সময় গ্রাম ছেড়ে জুবলি গ্রামে আশ্রয় নিলাম। ’’

‘‘ওই ঘটনার তিন দিন পরে জানতে চাই, কিভাবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এলাকার লোকজন মুরুব্বি শ্রেণীর যারা ছিলেন তারা জানান, ২৪৫ জন লোককে ঘটনার দিন সোহাগপুর ও বেনুপাড়া গ্রামে হত্যা করা হয়েছে। ’’

সাক্ষী বলেন, ‘‘মুরুব্বিদের মধ্যে বল্লু বকা বুড়া, নসা ও কাদির ডাক্তার রাজাকার ছিলেন। এ রাজাকারদের প্রধান ছিলেন কামারুজ্জামান। তারা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে এসে গ্রামে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। কামারুজ্জামান শেরপুর জেলা ভিত্তিক একজন রাজাকার নেতা ছিলেন। তার কথায় রাজাকাররা ওঠা-বসা করতেন। ’’

জালাল উদ্দিন বলেন, ‘‘১৯৭১ সালে আরো অনেক ঘটনা ঘটেছে। সোহাগপুর গ্রামের কেদার নাথের বাড়িতে রাজাকাররা আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং ৫ জনকে হত্যা করে। নালিতাবাড়ীতে আলশামস, আলবদর, রাজাকার ও পাকসেনাদের ক্যাম্প ছিল। শেরপুরের ডাকবাংলায় একটি ক্যাম্প ছিল। ১৯৭১ সালের পরে আমি কামারুজ্জামানকে অনেক বার মিটিং-ফিটিংয়ে দেখেছি। ’’

উল্লেখ্য, কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষের আরো ৯ জন সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করেছেন।

গত ১৫ জুলাই প্রথম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন ১৯৭১ সালে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি হামিদুল হক। ২য় সাক্ষী হিসেবে গত ২৬ জুলাই সাক্ষ্য দেন শেরপুরে কামারুজ্জামানের স্থাপন করা আলবদর ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্রের দারোয়ান মনোয়ার হোসেন খান মোহন। ৩য় সাক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সী বীরপ্রতীক সাক্ষ্য দেন ১ আগস্ট। ৬ আগস্ট সাক্ষ্য দেন ৪র্থ সাক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকির আব্দুল মান্নান। ৫ম সাক্ষী মুক্তিযুদ্ধের শহীদ গোলাম মোস্তফা হোসেন তালুকদারের ছোট ভাই মোশাররফ হোসেন তালুকদার সাক্ষ্য দেন ২৯ আগস্ট। ৩ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য দেন ৬ষ্ঠ সাক্ষী শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামানের বড় ভাই ডা. মো. হাসানুজ্জামান। ৭ম সাক্ষী লিয়াকত আলী ও ৮ম সাক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদের পুত্র জিয়াউল ইসলাম সাক্ষ্য দেন ১৭ সেপ্টেম্বর। ৯ম সাক্ষী অ্যাডভোকেট আবুল কাশেম সাক্ষ্য দেন ২৪ সেপ্টেম্বর।
 
আসামিপক্ষ তাদের জেরা সম্পন্ন করেছেন।

গত ৪ জুন কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। তার বিরুদ্ধে একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, দেশত্যাগে বাধ্য করাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সাত ধরনের ঘটনায় অভিযোগ আনা হয়।

ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন, একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বরসহ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা কামারুজ্জামান। শেরপুর ডাকবাংলোয় বসে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সন্দেহভাজনসহ নিরীহ বাঙালিদের ধরে আনার নির্দেশ, হত্যা, নির্যাতন চালাতেন তিনি।

এছাড়া শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে তার পরিকল্পনা ও পরামর্শে ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই ১২০ জন পুরুষকে হত্যা করা হয় এবং ওই গ্রামের প্রায় ১৭০ জন মহিলাকে ধর্ষণ ও নির্যাতন করা হয়। সে ঘটনার পর থেকে সোহাগপুর গ্রাম এখন ‘বিধবাপল্লী’ নামে পরিচিত। এ কারণে সোহাগপুরের বিধবাপল্লীর জন্যও দায়ী কামারুজ্জামান।

সব মিলিয়ে গণহত্যা, গণহত্যা সংঘটনে ষড়যন্ত্র, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও হত্যা, ব্যাপক নির্যাতনযজ্ঞ, দেশত্যাগে বাধ্য করা, নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্মগত ও রাজনৈতিক কারণে ক্রমাগত নির্যাতনের সুপিরিয়র হিসেবে সব অপরাধের একক ও যৌথ দায় কামারুজ্জামানের ওপর বর্তায় বলেও উল্লেখ করা হয়েছে অভিযোগে।

২ জুলাই কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ৮১ পৃষ্ঠার ওপেনিং স্টেটমেন্ট (সূচনা বক্তব্য) উত্থাপন করেন প্রসিকিউটর একেএম সাইফুল ইসলাম ও নূরজাহান বেগম মুক্তা।
 
সূচনা বক্তব্যে প্রসিকিউটররা কামারুজ্জামানকে ‘প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধী’ বলে উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনালকে বলেন, তিনিসহ মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাসেম আলী, আশরাফ হোসেন, মোঃ শামসুল হক, মোঃ সাদত হোসাইন, আশরাফুজ্জামান খান, চৌধুরী মঈনউদ্দিন ও আব্দুস সালাম ছিলেন আলবদর বাহিনীকে পরিচালনা করতেন।

প্রসঙ্গত, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগের মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়। ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।

কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে গত ৩১ জানুয়ারি ৮৪ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল-১।

এরপর গত ১৬ এপ্রিল প্রসিকিউশনের প্রধান গোলাম আরিফ টিপুর এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কামারুজ্জামানের মামলাটি প্রথম ট্রাইব্যুনাল থেকে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। গত ১৬ মে আসামিপক্ষ এবং ২০ মে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ করেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ০১, ২০১২
এমইএস/সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad