ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

স্বপ্ন পূরণ হলো না ফারুকের

সাঈদুর রহমান রিমন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২১ ঘণ্টা, জুলাই ১, ২০১০

ঢাকা: ‘বিদেশ যাবার স্বপ্ন দেখতো ফারুক। তার ইচ্ছা ছিল, বিদেশে গিয়ে সংসারের অভাব-অনটন দূর করবে; পাল্টে দিবে পরিবারের বেহালদশা।

উপার্জনক্ষম ফারুকের অকাল মৃত্যু আমাদের পরিবারের জন্য শুধুই কান্না বয়ে এনেছে। ’ চোখের জল মুছতে মুছতে কথাগুলোই বলছিলেন হরতালের আগের রাতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত ফারুক হোসেনের ভাবী আলেয়া বেগম।

আলেয়া জানান, বুধবার রাতে ফারুক শেষ কথা ছিল-‘ভাবী দুইটা হাই পাওয়ারের ঘুমের ট্যাবলেট খাওয়ান-আমি যে আর যন্ত্রণা সইতে পারছি না। ’

আজ বৃহস্পতিবার ভোর থেকেই ফারুকদের ১৩৩/১ ডিস্টিলারি রোডের ভাড়া বাসায় চলছিল বোন, ভাবীসহ স্বজনদের কান্না আর মা শিরিন বেগমের বুক চাপড়ানো আহাজারি। ডিস্টিলারী রোডের মুরগিটোলায় জাহির আলীর বস্তি সাদৃশ্য বাড়ির দুটি খুপরি ঘরে ভাড়া থাকে ফারুক হোসেনের পরিবার। মা, দুই বোন, এক ভাই আর ভাবীকে নিয়েই ছিল ফারুকের পরিবার। পরিবারের জন্য অপরিহার্য ছিলেন তিনি। বড় ভাই টিএন্ডটির ফরিদাবাদ এক্সচেঞ্জে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে মাস্টাররোলের কর্মচারী। তার সীমিত আয়ে দুটি ঘরের মাসিক ভাড়াটাই শুধু দেয়া যায়। বাকি সব খরচের যোগান দিতেন ফারুক।

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ফারুকের বাবা মকবুল হোসেন মুরগিটোলা এলাকাতেই ছোট্ট একটি ওষুধ বিক্রির দোকান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

ফারুকের মা শিরিন বেগম বলেন, ‘গত দেড় বছর আগে ফারুকের বাপ বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মারা যায়। হের পর থেইক্যা সব ঝামেলা আমার এই ছোট্ট ব্যাটার (ফারুক) মাথায়। ছোটবেলা থেকেই মেকানিকের কাজ-কাম শিখা ফারুক খালি সংসার চালানো নিয়া ব্যস্ত থাকতো। বন্ধু বান্ধব নিয়া কোনো আড্ডাবাজিতেও সময় দিতো না সে...বলতো আড্ডা দিলে পেটে ভাত আসবে কোত্থেকে ?’

ফারুকের ব্যাপারে এসব স্মৃতিচারণ করতে করতেই বিলাপ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন শিরিন বেগম।

ফারুকের বড় ভাই সেলিম মুখে কোনো কথা বলতে পারছিলেন না। কিছু বলার চেষ্টা করতেই হু হু করে কেঁদে ওঠেন। চোখে পানি নিয়ে তাকে শান্তনা দিতে পাশে এসে দাঁড়িয়ে সেলিমের স্ত্রী আলেয়া নিজেও কথার খেই হারিয়ে ফেলেন।

আলেয়া জানান, ফারুক মৃত্যুর আগে বলেছেন, বন্ধু ফয়সালের প্রাইভেট কার নিয়ে ফারুক ও সুমন মিলে তিন বন্ধু গুলশান যান পাওনা টাকার তাগিদ দিতে। ফেরার সময় মগবাজার রেলক্রসিং সংলগ্ন ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি কার্যালয়ের পাশে প্রাইভেটকার থামিয়ে ফয়সাল সিগারেট কেনার জন্য নামতেই ৪/৫ যুবক তাদের গাড়ি ঘিরে দাঁড়ায়। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা পেট্রোল ঢেলে দেয় গাড়িতে, তা ছিটিয়ে দেয় ফারুক ও সুমনের সারা দেহে। এরপর কয়েক মুহূর্ত দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে পুরো গাড়ি, পুড়তে থাকে ফারুক-সুমন। গাড়ির গ্লাস ভেঙ্গে যখন বাইরে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে ততক্ষণে ফারুক ঝলসে যাওয়া মাংসখন্ডের মতো ছটফট করতে থাকে।

পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ডিএমসি) বার্ণ ইউনিটে তাদের ভর্তি করা হলেও ফারুকের অবস্থা ক্রমেই সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার চিকিৎসার খোঁজ খবর নিতে ডিএমসির বার্ণ ইউনিটে যাবার পর বার্ন ইউনিটের আইসিইতে তার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সব ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে ফারুক চিরতরে হারিয়ে গেল।

পরিবারের সদস্যরা আরো জানান, বিদেশে যাওয়ার জন্য দুই লাখ টাকা যোগাড় করতে রাত-দিন ম্যাকানিকের কাজে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। গাড়ির গ্যারেজ ছাড়াও একটি ফ্যান ফিটিংস কোম্পানিতে পার্টটাইম কাজ শুরু করেন। বোনদের বিয়ে দিয়ে, বড় ভাইকে ব্যবসা-বাণিজ্যে দাঁড় করিয়ে তবেই ফারুক নিজে বিয়ে করবেন-এ কথা জানাতেন মাকে।

বাড়ি মালিক জাহির আলী বলেন, ‘ফারুকবিহীন পরিবারের সদস্যরা যে এখন কিভাবে বেঁচে থাকবে, কিভাবে যে তাদের খাদ্যের যোগান হবে-তা নিয়ে রীতিমত দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা’।


বাংলাদেশের স্থানীয় সময় : ১৯১১ ঘন্টা, জুলাই ০১, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।