ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

পঞ্চম সংশোধনী বাতিল মামলার রায় এ মাসেই

জাকিয়া আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৫৫ ঘণ্টা, জুলাই ১, ২০১০
পঞ্চম সংশোধনী বাতিল মামলার রায় এ মাসেই

ঢাকা: বহুল আলোচিত পঞ্চম সংশোধনী বাতিল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় এ মাসেই দিতে পারেন আদালত। এরই মধ্যে মূল রায় লেখা শেষ হয়েছে।

এখন চলছে বিচারপতিদের মধ্যে চূড়ান্ত আলাপ-আলোচনার পর্ব।

সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলাম বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডিকে জানিয়েছেন তিনিই গুরুত্বপূর্ণ এ মামলার মূল রায় লিখেছেন।

মো. তাফাজ্জাল ইসলাম জানান, মূল রায় লেখার কাজ এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। অন্য বিচারপতিরা এ ব্যাপারে তাদের অভিমত জানালে রায় চূড়ান্ত করা হবে।

সূত্র জানিয়েছে, প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এ মাসের প্রথম সপ্তাহেই আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করার জোর সম্ভাবনা রয়েছে।   অনেক সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক প্রশ্ন জড়িত থাকায় এ মামলার রায় লিখতে গিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আদালতের দেওয়া যুগান্তকারী রায় পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

গত ২ ফেব্র“য়ারি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এ মামলার সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেন। বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতির বেঞ্চ ওই রায় দেন।

সংপ্তি রায় ঘোষণার সময় আপিল বিভাগ কিছু পর্যবেণ ও সংশোধনীসহ হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ও সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবীর লিভ টু আপিল খারিজ করে দেন। অপর আইনজীবীরা হচ্ছেন তাজুল ইসলাম, মুন্সি আহসান কবির ও কামরুজ্জামান ভূঁইয়া।  

বেঞ্চের অন্য সদস্যরা ছিলেন বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম (বর্তমান প্রধান বিচারপতি), বিচারপতি মো. আবদুল মতিন, বিচারপতি বি, কে দাস, বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন ও বিচারপতি এস কে সিনহা। তাঁদের মধ্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলাম ও বিচারপতি বি, কে দাস এরই মধ্যে অবসরে গেছেন।

বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলাম বলেন, ‘পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া সংপ্তি এই রায় ঘোষণার পর অনেক প্রশ্নের উত্তর বাকি থেকে গেছে। গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু প্রশ্নের জবাবের জন্য এখন  অপো পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণার। ’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে, নাকি থাকবে? রাষ্ট্রের মূলনীতি কী হবে? হাইকোর্ট যে ’৭২ এর সংবিধানের চার মূলনীতি ফিরিয়ে আনার নির্দেশনা দিয়েছিলেন তা কি বহাল থাকবে? এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব এ রায়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি আমরা। ’

১৯৭২ সালের আদি সংবিধানের ১২ ও ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিলো। আদি সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘ধর্মনিরপেতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, (ঘ) কোন বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।

সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে এ অনুচ্ছেদটি বাতিল করা হয়।

২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট হাইকোর্টের রায়ে আদি সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ পুনর্বহালের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আদি সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ সাপেে সমিতি বা সংঘ গঠন করবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে। তবে শর্ত থাকে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পন্ন বা ল্যানুসারী কোন সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্যে সম্পন্ন বা ল্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোন সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার বা তার সদস্য হইবার বা অন্য কোন প্রকারে তার তৎপরতায় অংশ গ্রহণ করিবার অধিকার কোন ব্যক্তির থাকিবে না। ’

পঞ্চম সংশোধনীতে এ অনুচ্ছেদটি পরিবর্তন করা হয়। আর এরই সুযোগে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতি করার সুযোগ পায়।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এ ব্যাপারে কী অভিমত দেন এখন সেটাই দেখার বিষয়। তবে ১২ ও ৩৮ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল হলেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে নাকি এর জন্য আলাদা আইন তৈরি করতে হবে, এ নিয়ে আইন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। সংবিধানের মূলনীতি কী হবে তা-ও নির্ধারিত হবে পঞ্চম সংশোধনী মামলার বহুল প্রতিক্ষিত চূড়ান্ত রায়ে।

এ প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডিকে বলেন, ‘পঞ্চম সংশোধনী নিয়ে আমিও আর সবার মতো উদ্বেগের মধ্যে আছি। অনেক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি রায় দেখার জন্য। কারণ, কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেণ ও সংশোধনীসহ এ রায় ঘোষণা করা হবে। সেই পর্যবেক্ষণ এবং সংশোধনী কেমন হবে এ নিয়ে খুব উদ্বেগের মধ্যে আছি। জানি না, কী রায় হবে। আর সবার মতো আমিও অন্ধকারে আছি। ’

অপরদিকে সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হকের সঙ্গে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডি’র পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে এখনই পঞ্চম সংশোধনীর চূড়ান্ত রায় নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজী হননি। তিনি শুধু বলেন, ‘কয়েকটি সংশোধনী দেওয়া হবে আগামী রায়ে। সেটা না দেখে কিছু বলা যাবে না। ’

২০০৫ সালের ২৯শে আগস্ট হাইকোর্ট সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেন।   বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। মুন সিনেমা হলের মালিকানা নিয়ে দায়ের করা একটি রিট আবেদনে হাইকোর্ট ওই রায় দেন। হাইকোর্টের রায়ে খোন্দকার মোশ্তাক আহমদ থেকে শুরু করে জিয়াউর রহমান পর্যন্ত সকল সামরিক সরকারের মতা দখল ও তাদের কার্যক্রমকে আইন ও সংবিধান-বহির্ভুত ঘোষণা করা হয়। রায়ে সংবিধানের ৬, ৮, ৯, ১০, ১২, ২৫, ৩৮, ৪২ ও ১৪৫ অনুচ্ছেদ বাতিল ঘোষণা করা হয়।

রায়ে আরও বলা হয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ই এপ্রিল পর্যন্ত দেশ চলেছে অবৈধ ও অসাংবিধানিক উপায়ে মতা দখলকারীদের ইচ্ছা অনুযায়ী। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলে রাষ্ট্রের মৌল কাঠামো বদলে যাবে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। এর ফলে দেশে বর্তমানে সক্রিয় ধর্মীয় আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতি করার অধিকার হারাবে। এছাড়া, জাতীয়তার পরিচয়েও আসবে পরিবর্তন। বাংলাদেশী নয়, আমাদের জাতীয় পরিচয় হবে আমরা বাঙালি। ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিলো।   তবে ১৯৭৭ সালে আনা সংশোধনীতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার অধিকার দেওয়া হয়। রাষ্ট্রের চার মূলনীতি বদলে গিয়ে তাতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। চূড়ান্ত রায়ে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলে ’৭২ এর সংবিধানের চার মূলনীতি সংবিধানে ফিরে আসবে। এছাড়া সংবিধান থেকে ‘সর্বশক্তিমান আলাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ শব্দ দুটি উঠে যাবে।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৭৩৫ জুলাই ১, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।