ঢাকা, সোমবার, ২২ আশ্বিন ১৪৩১, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৩ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

‘জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করতে হবে’

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৫ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০২৪
‘জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করতে হবে’ ছবি: শাকিল আহমেদ

ঢাকা: জলবায়ু পরিবর্তন ও নানাবিধ অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে উপকূলীয় মানুষের ভালোভাবে টিকে থাকা এখন অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। পরিবেশকে বাঁচাতে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

মানুষকে সচেতন হতে হবে। কম্যুনিটি বেজড অ্যাডাপটেশন নিয়ে কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে কম্যুনিটির অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

শনিবার (৩০ মার্চ) পরিবেশ সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)- এর আয়োজনে ‘উপকূলের জীবন-জীবিকাঃ সংকট ও করণীয়’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন।  

উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় এ সংলাপ থেকে সরকার, সুশীল সমাজ, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, পরিবেশ কর্মী এবং ভুক্তভোগী জনগণকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়।

ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) এর উপদেষ্টা কমিটির অন্যতম সদস্য এবং রোমান ক্যাথলিক চার্চ ঢাকা-এর আর্চবিশপ বিজয় নিসফরাস ডি’ক্রুজ, ওএমআই এর সভাপতিত্বে এবং ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) এর সদস্য সচিব শরীফ জামিল এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ জাতীয় সংলাপে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপকূলীয় অঞ্চল খুলনার সাবেক সংসদ সদস্য (সংরক্ষিত নারী আসন) অ্যাডভোকেট গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার।  

সংলাপে সম্মানিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার, ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) এর সহ-আহ্বায়ক শারমীন মুরশিদ, এবং বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের বেসরকারি উপদেষ্টা, ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) এর সহ-আহ্বায়ক এমএস সিদ্দিকী। সংলাপে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন উপকূল রক্ষায় আমরা এর সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র।

সংলাপে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একুয়াকালচার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং বিভাগীয় চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ আলী এবং বেসরকারি সংস্থা ব্লু প্ল্যানেট ইনিশিয়েটিভের গবেষণা এবং কর্মসূচি বাস্তবায়ন ব্যবস্থাপক মো. ইকবাল ফারুক।

সংলাপে বক্তারা বলেন, লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া এ অঞ্চলে বেড়েছে সুপেয় পানির সংকট। সুন্দরবন উপকূলে ৭৩ শতাংশ পরিবার সুপেয় পানির পরিবর্তে খারাপ পানি খেতে বাধ্য হয়। গত ১২ বছরে বাস্তুচ্যুত হয়ে উপকূল অঞ্চলের ৮৫ লাখ ৯৫ হাজার মানুষ। গত ৩৫ বছরে উপকূলীয় অঞ্চলে পূর্বের তুলনায় লবণাক্ততা বেড়েছে ২৬ ভাগ যার পরিমাণ ২ পিপিটি থেকে বেড়ে ৭ পিপিটিতে দাঁড়িয়েছে আর তার প্রভাব পড়েছে কৃষিখাতে। লবণাক্ততা বাড়ার কারণে বেড়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকিও। বাড়ছে উচ্চ রক্তচাপ আর কমছে জন্মহার। উপকূলে গর্ভবতী মায়েদের প্রি-একলাম্পশিয়া ও উচ্চ রক্তচাপের হার ৬.৮ থেকে ৩৯.৫ শতাংশ বেড়েছে। জাতীয়ভাবে দেশে জন্মহার ১.৩৭ শতাংশ হলেও সাতক্ষীরার শ্যামনগরে জন্মহার মাত্র ০.৮৯ শতাংশ। এছাড়াও নারীদের জরায়ু রোগ, গর্ভকালীন ঝুঁকি এমনকি অপরিণত শিশু জন্ম দেওয়ার হারও বেড়েছে।

সভাপতির বক্তব্যে আর্চবিশপ বিজয় নিসফরাস ডি’ক্রুজ, ওএমআই বলেন, উপকূলের মানুষের কান্না আমরা শুনতে পাই। তাদের কান্না যেন আমাদের হৃদয়েও বাজে। সৃষ্টিকর্তার এ পৃথিবীর সব মানুষ ভাই ভাই। আমরা সংঘাতে না জড়িয়ে আমাদের নিজেদের রক্ষা করতে পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে। জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করতে হবে আমাদের সবাইকে।

অনুষ্ঠিত জাতীয় সংলাপে শরীফ জামিল বলেন, দেশের অন্যতম পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) খুব অল্প সময় আগে এর কার্যক্রম শুরু করলেও সারাদেশের বিভিন্ন এলাকার জলবায়ু, পরিবেশ ইত্যাদির সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের অন্যান্য পরিবেশ সংবেদনশীল এলাকাগুলোর মধ্যে উপকূল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর যে কয়েকটি দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হুমকির মুখে রয়েছে বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম আর এ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির ফলে বাংলাদেশের উপকূলের মানুষ এবং বাস্তুসংস্থান আজ সংকটে নিপতিত। জলবায়ু পরিবর্তন ও নানাবিধ অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে উপকূলীয় মানুষের ভালোভাবে টিকে থাকা এখন অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে।

জাতীয় সংলাপে এডভোকেট গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার বলেন, যারা নদী ধ্বংস করছেন, যারা খাল দখল করছেন তারা এ সমাজেরই, আমাদেরই পরিবারের, সমাজের। তারা সবসময় ক্ষমতার আশপাশেই থাকেন, এরা ব্যবসায়ী। নদী এবং পরিবেশ  রক্ষায় সুধীজন এবং সমাজের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, প্রকৃতি বদলাচ্ছে। আমাদেরকে অবশ্যই প্রকৃতিকে বুঝতে হবে। ষড়ঋতুর দেশে বাংলাদেশ আজ চার ঋতুর দেশে পরিণত হয়েছে। আষাঢ়েও এখন আর বৃষ্টির দেখা পাওয়া যায় না। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল সমুদ্রগর্ভে বিলীন হবে আর লবণাক্ততা বেড়ে ঢুকে যাবে আরও ভেতরে। রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং এর বিকল্প নেই। মানুষকে সচেতন হতে হবে। কম্যুনিটি বেজড অ্যাডাপটেশন নিয়ে কাজ করতে হবে, বাড়াতে হবে কম্যুনিটির অংশগ্রগণ।

ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, নদীর দখল করে প্রস্তুত করা স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে। নদী দখল করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা যাবে না। নদী বাঁচাতে হবে। পরিবেশ বাঁচাতে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

সংলাপে শারমীন মুরশিদ বলেন, নদী হলো পাবলিক প্রোপার্টি। এ নদীতে বাঁধ দেওয়া হচ্ছে কার সিদ্ধান্ত? নদীতে বর্জ্য ফেলা আইন করে বন্ধ করতে হবে। উপকূল রক্ষায় গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। উপকূলের কম্যুনিটির মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

এমএস সিদ্দিকী বলেন, মানুষই যদি না থাকে তাহলে উন্নয়ন দিয়ে কি করবো। মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বাঁচাতে হবে নদী ও পরিবেশকে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ঠেকাতে সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে।

সংলাপে নূর আলম শেখ বলেন, আমরা সারাবছর পানির মধ্যেই বসবাস করি কিন্তু খাওয়ার জন্য সুপেয় পানি পাই না। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের গরম পানি নদীতে ছাড়া হচ্ছে। তাতে মরে যাচ্ছে নদীর মাছ। অন্যন্য প্রাণীরা আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন রোগে।

সানজিদা রহমান বলেন, চুনতি অভয়ারণ্য থেকে বাঁশখালী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূরত্ব মাত্র ৩ কিলোমিটার। এ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রভাবে অভয়ারণ্য আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পড়েছে, বিলীন হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।

জাতীয় সংলাপে উপকূলীয় অঞ্চল থেকে আসা জলবায়ুর অভিঘাতে ভুক্তভোগীরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, অনাবৃষ্টি, বর্জ্য থেকে পানিদূষণও ইলিশের অভয়াশ্রমের প্রবেশপথে নানা প্রকল্পে ভরাট হয়ে যাওয়ায় ভরা মৌসুমে ইলিশের দেখা না মেলার মূল কারণ। পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সংলগ্ন সমুদ্রে দীর্ঘ ডুবোচর, রাবনাবাদ, আগুনমুখা, আন্ধারমানিক এলাকায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র হওয়ায় ইলিশের আনাগোনা কমে গেছে। কক্সবাজার সংলগ্ন মাতারবাড়ি অঞ্চলে উপকূলীয় মৎস্য সম্পদ ও মৎসজীবীদের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে।

তারা আরও বলেন, উপকূলের লবণ চাষের জন্য উল্ল্যেখযোগ্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়াতে লবণ চাষিদের জমিতে লবণ পানি প্রবেশ করানো বন্ধ হয়ে গেছে। প্রকল্প কর্তৃপক্ষের বাধ দেওয়ার কারণে লবণ পানি প্রবেশ করিয়ে পানি শুকিয়ে লবণ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানে এখন পানিও আসে না, আর তাই লবণ চাষও হয় না। যার ফলে লবণ চাষের উপর নির্ভরশীল চাষিরা পড়েছেন জীবিকার সংকটে।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন, সুন্দরবন রক্ষায় আমরা এর সমন্বয়ক নূর আলম শেখ, চুনতি রক্ষায় আমরা এর সমন্বয়ক সানজিদা রহমান এবং উপকূল অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের প্রতিনিধিরা। জাতীয় সংলাপে উপকূল অঞ্চলের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার ব্যক্তিদের মধ্যে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বরগুনার তালতলীর কৃষক রফিকুল ইসলাম, বরগুনার পরিবেশ কর্মী শফিকুল ইসলাম খোকন, কক্সবাজারের পরিবেশ কর্মী ফরিদুল আলম শাহিন এবং তৌহিদ বেলাল, পটুয়াখালীর কলাপাড়ার মোহাম্মদ আল ইমরান, বাগেরহাটের ক্ষতিগ্রস্ত নারী কমলা সরকার, বনজীবী ইসরাফিল বয়াতি, বরগুনার তালতলী উপজেলার টেংবাগিরির আরিফুর রহমান ও  স্কুল শিক্ষার্থী প্রজ্ঞা নূর।


বাংলাদেশ সময়: ১৯২৫ ঘণ্টা, মার্চ ৩০,২০২৪
জিসিজি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ