ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ ভাদ্র ১৪৩২, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

জাতীয়

ভারতে কারাভোগ শেষে দেশে ফিরেই শিকলে বন্দি নুর আলম

সোহাগ হায়দার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:০৯, মার্চ ২১, ২০২৪
ভারতে কারাভোগ শেষে দেশে ফিরেই শিকলে বন্দি নুর আলম শিকলে বন্দি নুর আলম

পঞ্চগড়: বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান নুর আলম (৪০)। বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের হাল ধরতে একটা সময় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের মহানন্দা নদীতে নুড়ি-পাথর উত্তোলনের কাজ করতেন।

হঠাৎ হাসিখুশি সেই ছোট্ট সংসারে কালবৈশাখী ঝড়ের মতো নেমে আসে অন্ধকার।

পাথর উত্তোলন করার সময় ভুলে সীমান্ত অতিক্রম করায় আটক হন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে। এতে তিন বছরের বেশি সময় বন্দি ছিলেন ভারতের কারাগারে। বন্দিদশা থেকে দেশে ফেরার পর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি। এর পর থেকে নিজ বাড়িতে সাত বছর ধরে শিকলবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন নুর আলম।

ঘটনাটি ঘটেছে দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায়। মানসিক ভারসাম্যহীন নুর আলম উপজেলার সর্দারপাড়া গ্রামের মৃত হকিকুল ইসলামের ছেলে।

পারিবারিকভাবে জানা গেছে, বছর দশেক আগেও স্বাভাবিক জীবন ছিল নুর আলমের। সংসার জীবনে তিনি তিন মেয়ে ও এক ছেলের বাবা। এর মাঝে বিএসএফের হাতে আটকের পর দীর্ঘ তিন বছরের বেশি সময় পর দেশে ফিরে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এর মাঝে স্থানীয়দের পাশাপাশি পরিবারের সদস্য ও স্ত্রীর ওপর হামলা চালালে স্থানীয়দের সহায়তায় তাকে শিকলবন্দি করে রাখা হয়। দীর্ঘ সাত বছর ধরে শিকলবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন তিনি।

পরিবারের সদস্য ও স্থানীয়রা বাংলানিউজকে আরও বলেন, চোখের আড়াল হলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তেন নুর আলম। কোনো কারণ ছাড়াই স্থানীয়দের ওপর হামলার করতেন। সে কারণেই তাকে শিকলে বেঁধে রাখা হয়।

কথা হয় নুর আলমের মা নুর নেহারের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমার একমাত্র ছেলে নুর ১০-১২ বছর আগে ভালো ছিল। নদীতে মা-ছেলে একসঙ্গে পাথর উত্তোলনের কাজ করতে গেলে একসময় সে ভুল করে ভারতের ওপাশে চলে যায়। এতে বিএসএফ তাকে আটক করে জেলে পাঠায়। ভারত থেকে বন্দি জীবন শেষে দেশে ফিরেই পাগল হয়ে যায় আমার আদরের ছেলে। এখন তাকে ঘরে শিকলবন্দি অবস্থায় রাখতে হয়। আর আমরা নিরুপায় হয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে সাহায্য নিয়ে চলছি। যে বয়সে কাজ করে মাকে খাওয়াবে ছেলে, সে বয়সে ছেলেকে বেঁধে রেখে কাজ করে খাওয়াতে হচ্ছে আমাকে।

কথা হয় নুর আলমের সন্তানদের সঙ্গে। তারা বাংলানিউজকে বলেন, যখন থেকে বুঝ হয়েছে তখন থেকে বাবাকে পাগল অবস্থায় দেখছি। খুব কষ্ট হয় বাবার এমন দশা দেখে। অন্যদের মতো আমাদেরও ইচ্ছে করে বাবার সঙ্গে একটু ভালোভাবে থাকতে।

স্থানীয়রা বলছে, উদ্ভট ও খেপামি স্বভাবের কারণেই তাকে শিকলবন্দি করে রাখা হয়েছে। পরিবারটি সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পেলে নুর আলম আবারো সুস্থ হয়ে উঠবেন বলে মনে করছেন সবাই।  

স্থানীয় প্রতিবেশী বর্ষা আক্তার, লিটন ইসলাম ও উসমান গণি বাংলানিউজকে বলেন, নুর আমাদের ফুফাতো ভাই। দীর্ঘ ৭ বছর থেকে এমন অবস্থায় খুব কষ্টে আছে পরিবারটি। আয় রোজগারের লোক না থাকায় অনেক সময় অনাহারে দিন কাটে তাদের। এর মাঝে আমরা স্থানীয়রা যতটুকু পারি তাদের সহায়তা করি।  

একই কথা বলেন নারগীস বেগম। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, মানুষের খেলা, নাকি আল্লাহর খেলা। আমরা কিছু বুঝতে পারছি না। এমন অবস্থা দেখে খুব খারাপ লাগে। নুরের বাঁধন খুলে দিলে স্থানীয়দের ওপর হামলা করে। তাই তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। টাকার অভাবে পরিবারটি চিকিৎসা করাতে পারেনি। যদি তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় বা তার চিকিৎসার জন্য কেউ তার পরিবারটির পাশে দাঁড়ায় তাহলে নুর আলম আবারও সুস্থ হয়ে উঠবে বলে মনে হয়।

তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফজলে রাব্বি বাংলানিউজকে বলেন, উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে এর আগেও বিষয়টি অবগত হয়েছি। সে এতটাই ভারসাম্যহীন যে এলাকায় নৈরাজ্য সৃষ্টি হতে পারে বলে স্থানীয়রা ও জনপ্রতিনিধিদের সিদ্ধান্তে পরিবারটি তাকে শিকলবন্দি করে রেখেছে। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। যতটুকু সম্ভব দরিদ্র পরিবারটির পাশে থেকে চিকিৎসার সহায়তা করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০৬ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০২৪
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।