ঢাকা, শনিবার, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, ২৭ জুলাই ২০২৪, ২০ মহররম ১৪৪৬

জাতীয়

ভাড়া করা গাড়িতে যাত্রী বেশে উঠে লুট করতো ‘মামা পার্টি’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৪
ভাড়া করা গাড়িতে যাত্রী বেশে উঠে লুট করতো ‘মামা পার্টি’

ঢাকা: ভাড়া করা প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাসে নিয়ে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী নির্বাচিত রুটের ১-২ কিলোমিটার পর পর যাত্রী বেশে নিজেদের সদস্য ওঠাতো। পরে নির্জন স্থানে গাড়ি থামিয়ে অস্ত্র ও চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহার করে যাত্রীদের কাছে থাকা মূল্যবান সামগ্রী ছিনিয়ে নিতো ‘মামা পার্টি’।

নির্জন রুট নির্বাচন করে রাত ৩টা থেকে সকাল ৭টার মধ্যে অপরাধকর্ম সংঘটিত করতেন ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা।

সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত মধ্যরাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানাধীন শনিরআখড়া এলাকায় একাধিক অভিযান চালিয়ে মামা পার্টির ছিনতাইকারী চক্রের মূলহোতাসহ ৫ জনক গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তাররা হলেন—মো. রানা ওরফে মো. শাহীন ওরফে শাহীন রানা (৪৯), মো. মফিজুল ইসলাম ওরফে মো. ইসলাম ওরফে ইসলাম মিয়া (৪৮), মো. সাগর ওরফে হাবিবুর রহমান শেখ ওরফে মো. হাবিব (৫১), মো. ফারুক আহমদ ওরফে মো. ফারুক মিয়া ওরফে মো. ফারুক (৩৪) ও মো. আবুল কালাম (৫৩)। তাদের কাছ থেকে একটি মাইক্রোবাস ও একটি প্রাইভেটকার, একটি হাতকড়া, চেতনানাশক ওষুধ (চার পাতার মোট ৪০টি), ২টি সুইচ গিয়ার চাকু, ২টি স্টিলের চাকু, একটি ক্ষুর, ৬টি স্মার্ট ফোন, ৫টি পুরনো বাটন মোবাইল ফোন ও ১ হাজার ৬০০ টাকা জব্দ করা হয়েছে।

মঙ্গলবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‍্যাব-১০ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দীন।

তিনি বলেন, গত বছরের ২৬ জুন ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা এলাকায় মো. শাহিন রানা, মফিজুল ইসলামসহ অন্যান্য আসামিরা যাত্রী সেজে সাদ্দাম শেখ নামের একজন ইজিবাইক চালকের ইজিবাইকটি ভাড়া করেন। তারা ইজিবাইক চালক সাদ্দামকে মারধর করেন এবং এক পর্যায়ে চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে অচেতন করে একটি মেহগনি বাগানে সাদ্দামকে অচেতন ও আহত অবস্থায় ফেলে রেখে ইজিবাইকটি ছিনতাই করে পালিয়ে যান।



ওই দিন আনুমানিক রাত সাড়ে ৮টার দিকে ভুক্তভোগী সাদ্দাম ফরিদপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। আসামিরা নিহত সাদ্দামের পরিবারের কাছে ছিনতাই করা ইজিবাইকটি ফেরত দেওয়ার কথা বলে প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন বিকাশ নম্বরে ৩৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্তকালে ‘মামা পার্টি’ নামে একটি চক্রের সম্পর্কে জানা য়ায়। এই মামা পার্টির মূলহোতা শাহিন রানা ওরফে তজ্জম এবং এই পার্টির সক্রিয় সদস্য ১০ জন।  

র‍্যাব-১০ এর অধিনায়ক বলেন, ‘মামা পার্টি’-খ্যাত একটি ছিনতাইকারী চক্র দীর্ঘদিন ধরে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, মাদারিপুরসহ রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রাইভেটকার/মাইক্রোবাস ভাড়া করে যাত্রী সেজে চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহার করে ছিনতাইসহ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সর্বস্ব লুট করে আসছিল। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ও তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানাধীন শনিরআখড়া এলাকায় একাধিক অভিযান পরিচালনা করে ওই ছিনতাইকারী চক্রের মূলহোতাসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে তিনি জানান, গ্রেপ্তার শাহিন রানা চক্রটির মূল পরিকল্পনাকারী এবং তার নেতৃত্বে চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, মাদারিপুর ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস ভাড়া করে যাত্রী সেজে চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহার করে ছিনতাই করে আসছিল। তাদের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রথমে তারা ছিনতাইয়ের জন্য উপযুক্ত ও নির্জন রুট সিলেক্ট করতো। রাত ৩টা থেকে সকাল ৭টার মধ্যে ছিনতাই করতো।

কখনও মফিজুলের প্রাইভেটকার ব্যবহার করতো আবার কখনও মফিজুলের মাধ্যমে অন্য কোনো প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস ভাড়া নিতো। এরপর মফিজুল এসব গাড়ি চালাতেন এবং শাহিন যাত্রী সেজে মফিজুলের পাশে বসে থাকতেন। অন্যানরা তাদের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী নির্বাচিত রুটের ১-২ কিলোমিটার পর পর যাত্রী বেশে অবস্থান করতেন।

পরে সবাই একত্রিত হওয়ার পর কখনও দেশীয় অস্ত্রের ভয়ভীতি দেখিয়ে মারধর করে আবার কখনও চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহার করে অচেতন করে যাত্রীদের কাছে থাকা সবকিছু লুট করে তাদের সুবিধাজন যে কোনো নির্জন স্থানে ফেলে রেখে যেতেন চক্রের সদস্যরা।

গ্রেফতার শাহিন রানা মামা পার্টি চক্রের দলনেতা। শাহিন ২০০০ সালে একটি চুরির মামলায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে ৫ বছর কারাভোগ করেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতিসহ ৫টি মামলা রয়েছে।

গ্রেপ্তার মফিজুল ইসলাম ওরফে ইসলাম পেশায় একজন ড্রাইভার। তিনি বিভিন্ন কোম্পানিতে গাড়িচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরে তিনি মলম পার্টি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ডাকাতি, ছিনতাই ও মাদক মামলাসহ ৩টি মামলা রয়েছে।

গ্রেপ্তার সাগর ওরফে হাবিবুর রহমান শেখ ওরফে হাবিব রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ড্রাইভার হিসেবে কাজ করতেন। পেশার আড়ালে তিনি মামা পার্টির সক্রিয় সদস্য। তিনি যাত্রীদের চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহার করে ও দেশীয় অস্ত্রে ভয় দেখিয়ে যাত্রীদের কাছে থাকা বিভিন্ন মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনতাই করতেন। তার বিরুদ্ধেও থানায় চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যাচেষ্টাসহ ৪টি মামলা রয়েছে।

গ্রেপ্তার ফারুক আহমদ ওরফে ফারুক মিয়া ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় রেন্ট-এ কারের গাড়ি চালাতেন। পেশার আড়ালে তিনি রাজধানীর সাইনবোর্ড, কদমতলীসহ বিভিন্ন এলাকায় ভোরের দিকে যাত্রীদের গাড়িতে তুলে মলম, চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহার করে ও দেশীয় অস্ত্রে ভয় দেখিয়ে যাত্রীদের কাছে থাকা মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনতাই করতেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাই ও ডাকাতির ২টি মামলা রয়েছে।

গ্রেপ্তার আবুল কালাম পেশায় গাড়িচালক। পেশার আড়ালে তিনি রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন যাত্রীবাহী গাড়িতে উঠে জুস, চিপস বিভিন্ন প্রকার খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে কৌশলে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে যাত্রীদের অচেতন করে তাদের কাছে থাকা টাকা ও মোবাইলসহ মূল্যবান সামগ্রী চুরি করতেন। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর কদমতলী থানায় একটি ছিনতাই মামলা রয়েছে।

গ্রেপ্তার আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান র‍্যাব-১০ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দীন।

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৪
এমএমআই/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।