ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

মৃত্যুর সঙ্গে বসবাস

সাঈদুর রহমান রিমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১০
মৃত্যুর সঙ্গে বসবাস

ঢাকা: রাজধানীতে রেললাইন ঘেঁষা বস্তিবাসীর জন্য ট্রেন যেন ‘মৃত্যুদূত। ’ প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাসকারীরা প্রায়ই কাটা পড়েন ট্রেনের চাকায়।

কারো ঘটে অকালমৃত্যু। কাউকে বরণ করতে হয় অনাকাঙ্ক্ষিত পঙ্গুত্ব।

তবুও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রেললাইনেই জীবন কাটান হাজার হাজার মেহনতি মানুষ। লাইন ঘেঁষা বস্তিতে কাটে রাত। পাথরময় লাইন ও স্লিপারের ওপর আলগা চুলায় চলে রান্না, খাওয়া, আড্ডা। এমনকি নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে অনেককে জীবিকা নির্বাহ করতেও দেখা যায়।

কিন্তু ট্রেন এলেই খালি হয়ে যায় রেলরাস্তা। লাইনের দু’পাশে অগণিত মানুষের কোলাহল চাপা পড়ে ট্রেনের যান্ত্রিক আওয়াজে। ট্রেন চলে গেলে আবারো সরগরম হয়ে ওঠে রেললাইন। শুরু হয় নানা শ্রেণী পেশার মানুষের হাঁকডাক, হট্টগোল। শোনা যায় নবজাতকের কান্না, জীবনের আওয়াজ।

আবার হুট করেই আওয়াজ থামে জীবনের। সময়মতো রেললাইন থেকে সরতে না পেরে অথবা ক্ষণিকের বেখেয়ালে ট্রেনের চাকায় কাটা পড়ে শিশু, নারী, বৃদ্ধ বা তরুণ-যুবা।

রেল লাইন ঘেঁষা বস্তিগুলোতে এভাবেই চাকা ঘোরে হাজার হাজার জীবনের। পার হয় দিন-মাস-বছর। বছরের পর বছর।

গেন্ডারিয়া রেলক্রসিং সংলগ্ন বস্তিতে বাস করেন প্রায় আড়াইশ’ পরিবারের সহস্রাধিক মানুষ। তাদেরই একজন জমিলা বেগম। গেন্ডারিয়া এলাকাতেই ঠিকা ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালান তিনি। কাজ শেষে ঘরে ফিরতে রাত ১০টা পার হয় প্রায়ই।

প্রতিরাতেই ঘরে ফেরার সময় উৎকন্ঠায় হাঁটার গতি বেড়ে যায় জমিলার। পঙ্গু স্বামী ও সন্তানদের সুস্থ দেখার প্রার্থনা আওড়াতে আওড়াতে ছুটে চলেন রেললাইন লাগোয়া ঝুপড়িতে।

জমিলা বেগমের মতো জীবন-মৃত্যুর অনিশ্চয়তায় উদ্বিগ্ন বাসিন্দারা রেললাইনের উপর লাল ব্যানার টানিয়ে রাখেন নিত্যদিন। লাল কাপড় দেখে চালক একটু ধীরে ট্রেন চালাবেন-এ বিশ্বাস থেকেই তাদের এ উদ্যোগ। তবুও দুর্ঘটনা জীবন ছাড়ে না তাদের। মাঝেমধ্যেই চাক্ষুষ করতে হয় ট্রেনের চাকায় মর্মান্তিক মৃত্যুর বীভৎসতা।

পাঁচ বছরের মেয়ে আকলিমা। রেল লাইনের তিন হাতের মধ্যেই এক খুপড়ি ঘরে মা-বাবার সঙ্গে থাকে সে। তার পরিবার গত সাত বছর ধরে বসবাস করছে গেণ্ডারিয়ার রেলবস্তিতে।

২০০৯ সালের আগস্টের এক সকালে খেলতে গিয়ে রেল লাইনের উপর উঠে পড়ে আকলিমা। এ সময় চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী ট্রেনের চাকায় দুই হাত কাটা পড়ে তার।

প্রায় আড়াই মাস হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে জীবন বাঁচে আকলিমার। কিন্তু হাত দু’টি ছাড়াই তাকে ফিরে যেতে হয় অভিশপ্ত সেই রেল বস্তিতেই। এখন অন্যের ওপর নির্ভরশীল দু:সহ জীবন কাটছে তার। চুকে গেছে স্কুলের পাটও।

খিলগাঁও রেলক্রসিং সংলগ্ন বস্তিতে বসবাস করেন পাঁচ শতাধিক মানুষ। ট্রেনের চাকায় কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনা অনেকটা সয়েই গেছে তাদের জীবনে। সম্প্রতি এখানে ট্রেনে কাটা পড়ে সোহাগ নামে ছয় বছরের এক শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে।

রেললাইন ঘেঁষা বস্তিঘরে মা-বাবার সঙ্গেই বাস করতো সোহাগ। লাইনের অপর পাশে থাকতো তার ফুফু খোদেজা বেগম।

চলতি বছরের ২২ ফেব্র“য়ারি সকাল এগারোটার দিকে রেললাইন পার হয়ে তার ফুপুর ঘরে যাচ্ছিল সোহাগ। কিন্তু ফুফুর ঘরে পৌঁছানোর আগেই পেছন দিক থেকে আসা ট্রেনের চাকায় দুই পা কাটা পড়ে তার।

আহত সোহাগকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে দিশেহারা বাবা করিম মিয়াকে (৪০) আরো দিশেহারা করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সোহাগ।

খিলগাঁওয়েই ট্রেনের ধাক্কায় আহত নেত্রকোনার সেলিম মিয়ার (৩০) দিন কাটে অর্ধাহারে-অনাহারে।

বছর খানেক আগে রাত এগারোটার দিকে ঘরে ফেরার সময় ট্রেনের ধাক্কায় আহত হন সেলিম। ভেঙ্গে যায় দুই পা।

এ পর্যন্ত প্রায় ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে সেলিমের চিকিৎসায়। শেষ সম্বল গ্রামের ভিটে-মাটি বিক্রি করে ও লোকজনের সাহায্য নিয়ে কিছু টাকা যোগাড় করলেও খেয়ে-পরে বাঁচার তাগিদে তার অনেকটাই ব্যয় করতে বাধ্য হন তিনি। তাই চিকিৎসা ব্যহত হয় তার।

সায়েদাবাদ টার্মিনাল সংলগ্ন রেলবস্তিতে বসবাস করেন চা বিক্রেতা সুলতান মিয়া (৩৫)।

বাংলানিউজকে তিনি জানান, তার ছেলে রবি (৪) তিন মাস আগে বৃষ্টির মধ্যে খেলতে গিয়ে রেললাইনের উপর পা পিছ্লে পড়ে যায়। এ সময় কমলাপুর স্টেশনের দিক থেকে আসা মালগাড়ির ধাক্কায় তার মাথা মারাত্মকভাবে ফেটে যায়।

চোখেমুখে জীবন জয়ের আনন্দ ফুটিয়ে বাংলানিউজকে সুলতান মিয়া বলেন, ‘ভাগ্য ভাল বলে ছেলেটার জীবন রক্ষা পেয়েছে। ’

এমন ঘটনা ঘটেছে পঙ্গু সনু মিয়ার শিশুপুত্র মঞ্জিলের (২) জীবনেও। মাস দুয়েক আগে ট্রেনের বগির ধাক্কায় মাথা ফেটে যায় তার। প্রবল রক্ষক্ষরণে গুরুতর অসুস্থ মঞ্জিলের এখন মুমূর্ষু সময় কাটছে ঘরের মেঝেতে। চিকিৎসা করানোর সাধ্য নেই সনু মিয়ার।

অদৃষ্ট মেনে নেওয়ার অসহায়ত্ব ফুটিয়ে বাংলানিউজকে সনু মিয়া বলেন, ‘১১ বছর আগে আমার বাম পা কাটা পড়ে রেলের চাকায়। তখন থেকেই পঙ্গু আমি। ’

এদিকে রেলের চাকায় কাটা পড়ে হাত, পা, এমনকি জীবন হারানো সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কোনো নজির গড়েনি রেল কর্তৃপক্ষ। বরং নির্মমতার উদাহরণ গড়েছে অনেক। নিহতদের ক্ষতিপূরণ বা আহতদের চিকিৎসার পরিবর্তে উল্টো জিআরপি থানায় সাধারণ ডায়রি (জিডি) করে রাখার মধ্যেই দায়িত্ব শেষ করেন রেলকর্মকর্তারা।

এদিকে প্রতিনিয়িত হতাহতের ঝুঁকি নিয়ে রেললাইনের পাশে থাকতে চান না কেউই। কিন্তু কোথাও থাকার জায়গা না জোটায় তাদের ফিরতে হয় রেল লাইনের পাশে সেই ঘিঞ্জিঘরেই। খেলতে হয় মৃতুর সঙ্গে লুকোচুরি।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা জহুরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘প্রতিমাসেই দু’এক বার বস্তি উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু উচ্ছেদের কয়েক ঘণ্টা পর আবার ঘর তোলে তারা। সহজেই বানানো যায় এসব পলিথিন ও বাঁশের ঘর। ’

রেলওয়ের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক হাবিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘কয়েক দফা অভিযান চালিয়ে রেললাইন ঘেঁষে গড়ে তোলা ঝুঁকিপূর্ণ বস্তিগুলো উচ্ছেদ করা হয়েছে। কাঁটাতারের বেড়া ও দেওয়াল দিয়ে উদ্ধারকৃত জায়গা ঘেরা দেওয়ারও কাজ চলছে। ’

তিনি জানান, কারওয়ান বাজার, মহাখালী, রসুলপুর, তেজকুনিপাড়া, জুরাইন ও সায়েদাবাদ এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ বস্তি ঘরের সংখ্যা সবচে’ বেশি।

হাবিবুর রহমান আরো বলেন, ‘আগে প্রায়ই ট্রেনে কাটা পড়ে হতাহতের খবর পাওয়া যেতো। এখন তা অনেক কমে এসেছে। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১০
এসআরআর/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ