ঢাকা, রবিবার, ২৬ শ্রাবণ ১৪৩২, ১০ আগস্ট ২০২৫, ১৫ সফর ১৪৪৭

জাতীয়

‘শয়তানের নিশ্বাস’ মাদকের নেপথ্যে ইরানিরা (ভিডিও)

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:৩৫, আগস্ট ২০, ২০২৩
‘শয়তানের নিশ্বাস’ মাদকের নেপথ্যে ইরানিরা (ভিডিও)

ঢাকা: স্কোপোলামিন। এক ভয়ঙ্কর মাদকের নাম।

অপরাধজগতে এ মাদকটি ‘ডেভিল ব্রেথ’ বা ‘শয়তানের নিশ্বাস’ নামে পরিচিত। এটি প্রয়োগ করে যেকোনো মানুষকে বশীকরণ বা হিপনোটাইজ করে যেকোনো কাজ করানো সম্ভব। কয়েকবছর ধরে এ মাদক প্রয়োগ করে সাধারণ মানুষের সর্বস্ব লুটের মতো ঘটনা ঘটছে। অনেকেই এ মাদকের সংস্পর্শে পড়ে নিজের মূল্যবান জিনিসপত্র তুলে দিয়েছেন প্রতারকদের হাতে।

স্কোপোলামিন নামে এ মাদকের এমন অবাধ ব্যবহারে আতঙ্ক জন্মেছে জনমনে। কিছু ইরানি নাগরিকের সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্র শয়তানের নিশ্বাস ব্যবহারের মাধ্যমে হিপনোটাইজ করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাত্রী ও পথচারীদের সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে।

তথ্য বলছে, গত আট মাসে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এ মাদক ব্যবহার করে প্রতারণায় জড়িত থাকায় ৬ ইরানি নাগরিকসহ মোট ৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

রাজধানীর পল্লবীর ১২ নম্বরের ডিওএইচএস কমপ্লেক্সের পি অ্যান্ড জেড ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করেন জিসান নামে এক যুবক। চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি বিকেলে বিমানের টিকিট কিনতে পি অ্যান্ড জেড ট্রাভেল এজেন্সিতে আসেন দুই বিদেশি। তারা জিসানের সঙ্গে কথা বলেন। আলাপনের এক পর্যায়ে এজেন্সির ক্যাশ বাক্সে হাত দিয়ে সাড়ে ৪ লাখ টাকা লুটে নেন। এর কয়েক মিনিট পর জিসান বুঝতে পারেন তার দোকানে চুরি হয়েছে।

জিসান জানান, আমার চোখের সামনেই ক্যাশ থেকে টাকা বের করল। আমি সবই দেখছিলাম। কিন্তু তাদের থামাইনি। এমন মনে হচ্ছিল যে আমিও তাদের একজন। এজন্য তাদের সহযোগিতা করছি। কিন্তু এটি কীভাবে হলো তা আজও আমি বুঝতে পারিনি।

এ ঘটনার পর পল্লবী থানায় লিখিত অভিযোগ করেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক রাকিব মিয়া। শুরু হয় তদন্ত। প্রথমে আশপাশের এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে পাওয়া যায় প্রতারকদের গাড়ি নম্বর। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই গাড়িটি উত্তরার ‘গাড়ি ভাড়া ডট কম’ নামে একটি রেন্ট-এ কারের। সেখান থেকে এক বিদেশি ইরানি পাসপোর্ট জমা দিয়ে গাড়িটি সাত দিনের জন্য ভাড়া নিয়েছেন। পরে সেই রেন্ট-এ কার ও আশপাশের এলাকায় নজরদারি শুরু করে পুলিশ।

আটদিন পর অর্থাৎ ২৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায় গাড়ি পরিবর্তনের জন্য সেখানে আসেন মাইশাম গোরহানি নামে এক ইরানি নাগরিক। তাকে আটক করে পুলিশ। তবে কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে দেশত্যাগ করেন মাইশামের সহযোগী পারভিজ মোহম্মাপুর। পরে এ বিষয়ে পল্লবী থানায় আটক মাইশাম ও তার সহযোগী পারভিজ মোহাম্মপুরের বিরুদ্ধে মামলা করেন পি অ্যান্ড জেড ট্রাভেল এজেন্সির মালিক রাকিব মিয়া।

এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পল্লবী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) চিন্ময় সরকার বলেন, দুই ইরানি নাগরিক মাইশাম ও তার সহযোগী পারভিজ মোহাম্মপুরের সঙ্গে টঙ্গির কিছু লোকও চুরির কাজে জড়িত। এরকম চুরির ঘটনায় আমি সর্বপ্রথম ইরানি এক নাগরিককে গ্রেপ্তার করি। কিন্তু তখন স্কোপোলামিন ব্যবহারের বিষয়টি বুঝে উঠতে পারিনি। পরে যখন দেশের বিভিন্ন স্থানে একইরকম চুরির সঙ্গে ইরানি নাগরিকদের গ্রেপ্তার করা হয়, তখন বিষয়টি আমার কাছে স্পষ্ট হয়। আসামি মাইশাম তার পাসপোর্ট ফিরে পেতে বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন করাচ্ছেন। বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করছেন। এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন শিগগরই দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

মামলার বাদী রাকিব মিয়া বলেন, শয়তানের নিশ্বাস প্রয়োগ করে চুরি ও প্রতারণার অভিযোগে কয়েকজন ইরানি নাগরিক গ্রেপ্তারের সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখার পর বুঝতে সমস্যা হয়নি যে তারাও এ একই চক্রের সদস্য। এর মধ্যে ইরান থেকে আমার ফোনে বেশ কয়েকটি ফোন কল আসে। তারা আমার করা মামলায় গ্রেপ্তার মাইশামের সঙ্গে আপস করার জন্য অনুরোধ করছেন। এদের মধ্যে একজন ইরানি নাগরিক মাইশামের টাকা চুরির বিষয় স্বীকার করে সেটা ফেরত দিতে চেয়েছেন।

এ ঘটনার ছয় দিন পরই একই কৌশলে প্রতারণার শিকার হন মোহাম্মদপুর বিজলী মহল্লার এ-ব্লকের বাসিন্দা মাহবুবা আক্তার। গত ২৭ জানুয়ারি তার বাড়ির পঞ্চম তলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার জন্য আসেন সেলিম আহমেদ নামে এক ব্যক্তি। ফ্ল্যাট দেখে মোটামুটি পছন্দও হয় তার। পরদিন তিনি তার স্ত্রী ও মা পরিচয়ে দুই নারীকে নিয়ে আবার ওই বাড়িতে আসেন। তারা ড্রয়িংরুমে বসে কথা বলছিলেন। একসময় মাহবুবা ওই দুই নারীকে নিয়ে তার শোবার ঘরে যান। একে একে তাদের হাতে তুলে দেন তার নিজের পরিধেয় হাতের চুড়ি, কানের দুল, আংটিসহ প্রায় ৭ ভরি স্বর্ণালংকার।

কিছুক্ষণ পর ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে আসারা ওই বাসা থেকে বিদায় নেন। তাদের গেট পর্যন্ত এগিয়েও দেন মাহবুবা আক্তার। প্রায় আধাঘণ্টার পর সব ঘটনা মনে পড়ে মাহবুবার। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।

তবে গত ২৯ জানুয়ারি ইরানি নাগরিক মাইশাম গ্রেপ্তার হওয়ার পর মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে এরকম চুরির খবর আর পাওয়া যায়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৮ মে ডেভিল ব্রেথ বা শয়তানের নিশ্বাস নামে পরিচিত প্রতারণা চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে যশোর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এদের মধ্যে তিনজন ইরানি নাগরিক। খালেদ মাহবুবী, সালার মাহবুবী ও ফারিবোর মাসুফি নামে তিন বিদেশির কাছ থেকে ডলারসহ বিভিন্ন দেশের মুদ্রা জব্দ করা হয়।

সর্বশেষ গত ১১ আগস্ট বগুড়ার শিবগঞ্জ থেকে শয়তানের নিশ্বাস দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে প্রায় লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে দুই ইরানি নাগরিক আজাদ নুবাহার ও আরশাদ আমনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

শয়তানের নিশ্বাস নামে এ ওষুধের উৎপত্তি হয় কলম্বিয়ায়। ১৮৮০ সালে সর্বপ্রথম জার্মান বিজ্ঞানী আলবার্ট লাদেনবার্গ ‘সত্যের সিরাম’ অর্থাৎ সত্যের সন্ধানে এর ব্যবহার নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯২২ সালে এটি কারাবন্দিদের ওপর প্রয়োগ করা হয় ‘ড. রবার্ট হাউস’ নামে একজনের সন্ধানে তথ্য বের করতে।

বর্তমানে এ মাদকটি প্রতারক চক্রের সদস্যরা অপরাধের কাজে ব্যবহার করে। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোয়; বিশেষ করে কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, আর্জেন্টিনা, পেরু, চিলি প্রভৃতি দেশে এটি মাদক হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। অপরাধীরা বিভিন্ন বয়সিদের যৌনমিলনে বাধ্য করতে এ মাদকটি ব্যবহার করে থাকে। পর্নোগ্রাফিক ভিডিও তৈরি করতে বা নগ্ন ছবি তোলার জন্যও এটি ব্যবহার করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আ ব ম ফারুক বলেন, এ ড্রাগটি অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশে আছে। ক্লিনিকোলজিক্যাল কাজে এটি ব্যবহার করা হতো। এগুলো আগে সবার হাতের নাগালে ছিল না। তবে এখন সমাজের বখে যাওয়া কিছু লোক এ ড্রাগটিকে মাদক হিসেবে ব্যবহার করছে, যা খুবই ভীতকর সংকেত।

এ ড্রাগ অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমকে নষ্ট করে দেয়। এটি খুবই বিষাক্ত। এ ড্রাগের অতিরিক্ত ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকিও রয়েছে বলে জানান তিনি।

এর আগে গত বছরের ২১ নভেম্বর দেশে প্রথমবারের মতো ‘ক’ শ্রেণির মাদক ডাইমেথক্সিব্রোমো অ্যাম্ফেটামিন (ডিওবি) খুলনা থেকে জব্দ করে ডিএনসি। গ্রেপ্তার করা হয় আসিফ আহমেদ, অর্ণব কুমার শর্মা ও একটি কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী মামুনুর রশীদকে। ডার্ক ওয়েবসাইটে ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে পোল্যান্ড থেকে ২০০ ব্লট ডিওবি অর্ডার করেন খুলনার যুবক আসিফ আহমেদ শুভ। অর্ডারের পর ইন্টারন্যাশনাল কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদকের চালানটি সরাসরি তার বাসায় পৌঁছায়। ওই ঘটনায় ঢাকার নিউমার্কেট থানায় মামলা হয়।

রাসায়নিক বিশেষজ্ঞরা জানান, ডিওবি সেবনের পর সেবনকারীকে যেকোনো দিকে প্রভাবিত করা যায়। ডিওবির মতোই কিন্তু এর চেয়েও আরও ভয়ঙ্কর ড্রাগ হলো স্কোপোলামিন বা শয়তানের নিশ্বাস। এর ফলে সেবনকারী নির্দেশিত কাজ করতে উদ্যোমী হন। এজন্য নির্দিষ্ট মাত্রায় সেবন করতে হয়। বেশি পরিমাণে সেবন মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

স্কোপোলামিনের মতো ভয়ংকর কেমিক্যাল ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের সর্বস্ব লুটে নেওয়ার মতো প্রতারণায় বিদেশিরা জড়িত থাকায় তাদের গ্রেপ্তারে কোনো আইনি জটিলতা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, বিদেশি কেউ যদি এ দেশের মাটিতে অপরাধ করে, তাহলে দেশে প্রচলিত আইনানুযায়ী তাদের বিচার হবে। এরকম অপরাধে কাউকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।

বাংলাদেশ সময়: ২১৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০২৩
এমএমআই/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।