ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

ফিরে দেখা : বাবরি মসজিদ

তুহিন শুভ্র অধিকারী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৫৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১০
ফিরে দেখা : বাবরি মসজিদ

এলাহাবাদের হাইকোর্ট অযোধ্যার বাবরি মসজিদ মামলার রায় ঘোষণা করবেন বৃহস্পতিবার। এর আগে এ মামলায় রায় ২৪ সেপ্টেম্বর ঘোষণার কথা ছিল।

তবে নিরাপত্তা বিবেচনায় কমনওয়েলথ গেমস পযর্ন্ত রায় ঘোষণা স্থগিত রাখার জন্য সাবেক এক আমলার আবেদনের প্রেক্ষিতে কিছুটা বিলম্ব হয়। ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট তার আবেদন খারিজ করে নতুন দিন বৃহস্পতিবার ধার্য করেন।

দীর্ঘকাল থেকেই মসজিদের স্থানে রামমন্দির নির্মাণের জন্য হিন্দু জনগোষ্ঠীর দাবি এবং মুসলমানদের মসজিদ টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টার দ্বন্দ্বে ভারতে বেশ কয়েকবার রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে উপমহাদেশের রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক পরিবেশ। বৃহস্পতিবারের রায় দীর্ঘকালের এই সমস্যার সমাধান এনে দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এ রায়ের পর সম্ভাব্য উত্তেজনা মোকাবেলার জন্য এরই মধ্যে ভারতের বড় শহরগুলোতে নিরাপত্তা ব্যাবস্থা জোরদার করা হয়েছে।

ভারতের ক্ষমতাসীন ইউপিএ জোট নেত্রী ও কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধী অযোধ্যা মামলার রায় মেনে নেওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

ফিরে দেখা
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধারণা অযোধ্যার বাবরি মসজিদের স্থান তাদের অন্যতম অবতার রামচন্দ্রের জন্মস্থান। এ কারণে হিন্দুরা জায়গাটিকে পবিত্র তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচনা করে।

এ কারণে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার ঘটনা বেশ পুরোনো। ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর ১৫২৭ সালে চিত্তগড়ের হিন্দু রাজা রানা সংগ্রাম সিংকে ফতেহপুর সিক্রির যুদ্ধে পরাজিত করেন। এরপর তিনি সেখানকার শাসনভার তুলে দেন তার সেনাপতি মির বাকির হাতে। ১৫২৮ সালে বাকি অযোধ্যায় মসজিদটি নির্মাণ করেন। সম্রাট বাবরের শাসনামলে মসজিদটি নির্মাণ হয় বলে পরে এটি বাবরি মসজিদ নামে পরিচিতি পায়।

১৮৫৩ সালে প্রথম এ মসজিদ নিয়ে হিন্দু-মুসলিম সরাসরি বিরোধ শুরু হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার সেখানে দেওয়াল তৈরি করে হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য আলাদা আলাদা উপসনার স্থান নির্ধারণ করে দেয়।

১৮৮৫ সালে প্রথম মহন্ত রঘুবর রাম নামে এক ব্যক্তি বাবরি মসজিদের চত্বরে আলাদা মন্দির নির্মাণের জন্য আদালতের শরণাপন্ন হন। কিন্তু আদালত তার আবেদন নাকচ করে দেয়।

১৯৪০ সালের পূর্ব পর্যন্ত এ মসজিদ ‘মসজিদ-ই-জন্মস্থান’ নামে পরিচিত ছিল।

১৯৪৭ সালে সরকার একটি আদেশের মাধ্যমে মুসলমানদের মসজিদে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং মসজিদের সদর দরজা বন্ধ করে দেয়। তবে আরেকটি দরজা দিয়ে হিন্দুদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।

১৯৮৪ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) নামে একটি কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ওই জায়গা পুনরুদ্ধরের ঘোষণা দেয়। বাবরি মসজিদের স্থানে রামমন্দির স্থাপনের দাবি জানায় তারা। এর ফলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।

এছাড়া, ১৯৮৯ সালের এলাহাবাদ হাইকোর্ট হিন্দুদের জন্য মন্দিরের দরজা খোলা রাখার যে আদেশ দেয় তা ভিএইচপির কর্মসূচিকে আরও উস্কে দেয়।

৯০ দশকের শুরুতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা আবার শুরু হয় যখন হিন্দুরা ওই স্থানে মন্দির নির্মাণ শুরু করে। মুসলিম সম্প্রদায় এ বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। তখন সরকার আইনগতভাবে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হয়।

১৯৯২ সালে পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ নেয় যখন উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির সমাবেশ থেকে ৬ ডিসেম্বর মসজিদে হামলা করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক মুম্বাই-দিল্লিসহ বড় শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। যাতে প্রায় ২ হাজার মানুষ মারা যান, যাদের বেশিভাগই ছিল মুসলিম।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ১৯৯২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিচারপতি লেবারহানের নেতৃত্বে লেবারহান কমিশন গঠন করে। কমিশনের ল্য ছিল ঠিক কী পরিস্থিতিতে বাবরি মসজিদে হামলা করা হয় তা উদঘাটন করা। এই কমিশন ছিল ভারতের ইতিহাসে দীর্ঘকালীন কমিশন, যা বিভিন্ন সময় ৪৮ বার রির্পোট প্রদানের সময় বাড়িয়ে নেয়।

অবশেষে কমিশন প্রায় ১৬ বছর পর ২০০৯ সালের ৩০ জুন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কাছে তদন্ত রির্পোট জমা দেয়। এই রিপোর্টে তৎকালীন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতাদের দোষী করা হয়। রিপোর্টে কমিশন ওই হামলার জন্য হিন্দু ধর্মীয় স্বেচ্ছাসেবকদের (কর সেবক) দায়ী করে। কমিশনের দাবি, স্বেচ্ছাসেবকদের হামলার সময় সেই স্থান থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরে অবস্থান করছিল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) দুই প্রভাবশালী নেতা লাল কৃষ্ণ আদভানী (পরবর্তী সময়ে ভারতের উপ-প্রধানমন্ত্রী) ও মুরালি মনোহর জোসি। এ সময় তারা স্বেচ্ছাসেবকদের থামানোর কোনো উদ্যোগ নেননি।

২০০১ সালে ভিএইচপির উদ্যোগে আবারও ওই স্থানে মন্দির নির্মাণের চেষ্টা করলে পরিস্থিতি আবারও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।

২০০২ সালের ২৭ ফেব্র“য়ারি অযোধ্যা থেকে ফেরা একটি তীর্থযাত্রীবাহী ট্রেনে হামলায় ৫৮ হিন্দুধর্মাবলম্বী নিহত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গুজরাটে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। ওই দাঙ্গায় মারা পড়েন প্রায় এক হাজার মানুষ। যাদের বেশিরভাগই ছিল মুসলিম ধর্মাবলম্বী।

এর আগে ২০০৩ সালে আদালতের নির্দেশে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব জরিপ বিভাগ ওই এলাকায় তাদের জরিপ কাজ চালায় এবং আগস্ট মাসে এলাহাবাদ হাইকোর্টে তাদের রিপোর্ট উপস্থাপন করে।

রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, যেখানে মসজিদ স্থাপন করা হয়েছে তার নিচে মন্দির জাতীয় কোনো স্থাপনা ছিল। কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায় ওই রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে।

২০০৫ সালে পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যখন পাঁচ সদস্যের একটি সন্ত্রাসী দল অস্থায়ী রাম মন্দিরে হামলা করে। তবে ওই পাঁচজনই নিরাপত্তারক্ষীর গুলিতে প্রাণ হারান।

বাংলাদেশ সময় : ২২৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।