ঢাকা, সোমবার, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

পে-অর্ডারেও ঘুষ নেন সাব রেজিস্ট্রার!

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৫, ২০২৩
পে-অর্ডারেও ঘুষ নেন সাব রেজিস্ট্রার!

রংপুর: পীরগাছায় মন্থনা জমিদার বাড়ির একটি চিলেকোঠা ভাড়া নিয়ে চলছে উপজেলা সাব রেজিস্ট্রার অফিসের কার্যক্রম। ১৯৬৭ সালে স্থাপিত এ অফিসের নেই নিজস্ব কোনো ভবন।

তাই জরাজীর্ণ টিনশেডই ভরসা। ভন জরাজীর্ণ হলেও তার কর্তা-কর্মীর অবস্থা আঙুল ফুলে কলা গাছ।

জানা গেছে, সাব রেজিস্ট্রার অফিসের অবকাঠামোগত কোনো উন্নতি না হলেও ঘুষ বাণিজ্যে ফুলে ফেঁপে উঠেছেন সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। খোদ সাব রেজিস্ট্রার তিথী রাণী ঘুষ গ্রহণের মাস্টারমাইন্ড। মানুষের কথার বাণ থেকে বাঁচতে তিনি ঘুষ নেন পে-অর্ডারে!

অভিযোগ আছে, সাব রেজিস্ট্রার অফিসে প্রকাশ্যে ঘুষ গ্রহণ, ক্রেতা-বিক্রেতাদের হয়রানি, সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে দলিল সম্পাদন, টাকার বিনিময়ে জমির শ্রেণি পরিবর্তন ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে থাকেন কর্তা-কর্মীরা। অভিযোগগুলোও দীর্ঘদিনের। আর তিথী রাণীর পে অর্ডারে ঘুষ গ্রহণের ‘সিস্টেম’ চালু হয়েছে অতি সম্প্রতি।

স্থানীয় লোকজন ও সাব রেজিস্ট্রার অফিসে সেবা নিতে যাওয়া বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে এমন দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেছে। পরে অনুসন্ধান করে জানা যায়, ২০২২ সালের ১৬ অক্টোবর বাণিজ্যিক শ্রেণির একটি জমির দলিল সম্পাদনের জন্য সোনালী ব্যাংকে পে-অর্ডার করেন মোজাফ্ফর হোসেন মিশন নামে এক ব্যক্তি। এর একটি উৎস করের ৪২ হাজার ও অপরটি ভ্যাটের ২১ হাজার টাকা। এরপর তার দলিল সম্পাদন করেন সাব রেজিস্ট্রার তিথী রাণী।

উৎসকরের জন্য দেওয়া মিশনের পে-অর্ডারের ৪২ হাজার টাকা তুলতে সাব রেজিস্ট্রার অফিসের নৈশ প্রহরী নজরুল ইসলাম সাজু নামে এক দলিল লেখক সহকারীকে সোনালী ব্যাংকে পাঠান। পে-অর্ডারটি তিথী রাণী অবমুক্ত করলেও সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হয়। তাই সেখানকার কর্মকর্তারা টাকা দেওয়ার থেকে বিরত থাকেন। এ ঘটনাটি পরে ফাঁস হয়।

এরপর জানা যায়, বাণিজ্যিক শ্রেণির জমির কথা বলে উৎসকরের ৪২ হাজার টাকা নিলেও কৃষি শ্রেণির দেখিয়ে দলিল সম্পাদন করেন তিথী রাণী। শ্রেণি কৃষি দেখালে উৎসকরের প্রয়োজন নেই। এখানে কৌশল অবলম্বন করেন উপজেলা সাব রেজিস্ট্রার। মূলত ঘুষের টাকা কৌশলে ব্যাংক থেকে পে-অর্ডারের মাধ্যমে তোলার চেষ্টা করেন তিনি।

অভিযোগ আছে আরও। উপজেলা সাব রেজিস্ট্রি অফিসের কর্তা-কর্মচারীরা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে ঘুষের টাকা আদায় করেন। অফিসে নেই কোনো সিটিজেন চার্টার। তিনশ টাকার হলফ নামা দিয়ে কথিত দলিল লেখক সমিতির নামে নেওয়া হয় অতিরিক্ত টাকা। সাফ কবলা দলিলের সরকারি ফি’র বাইরে সেরেস্তা বাবদ ১৫৪০ টাকা ও হেবা দলিলে ১৯৪০ টাকা ঘুষ দিতে হয় অফিসে। এস ঘুষ সংগ্রহ করেন মোহরার রফিকুল ইসলাম ও কান্ত চন্দ্র। আর টিপ বাবদ দাতা একজন হলে ১০০, একাধিক দাতা হলে জোরপূর্বক ৫০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করেন নুরু মিয়া। দলিল প্রতি ঘুষ গ্রহণে রয়েছে নিজস্ব কিছু সাঙ্কেতিক চিহ্নের ব্যবহার। দলিলের শ্রেণি ভেদে পাঁচটি সাঙ্কেতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। যার প্রতিটির মান দাঁড়ায় একহাজার থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।

ঘুষ যে শুধু দলির সম্পাদনেই নেওয়া হয়, তাও নয়। জাবেদা (নকল) কপিসহ অন্যান্য কাগজপত্র তুলতে গেলেও মোহরানা দিতে হয় সেবাগ্রহীতাদের। সরকার নির্ধারিত ফি’র বাইরে সমিতির নাম ভাঙিয়ে প্রতি জাবেদার কপিতে ১ হাজার থেকে আড়াই হাজার পর্যন্ত অতিরিক্ত টাকা নেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ অর্থ প্রকাশে আদায় করেন নকল নবিস সমিতির সম্পাদক আসাদুল ইসলাম। তাকে সহযোগিতা করেন অফিস সহকারী মাসুদা বেগম। মাসুদা আবার অফিসে নিজে কোনো কাজ করেন না।

বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আদায়কৃত ঘুষ যোগ করে একেকজনের পকেটে লাখ টাকা পর্যন্ত থাকে। ঘুষের সবচেয়ে বেশি অংক পান সাব রেজিস্ট্রার তিথী রাণী। জেলা রেজিস্ট্রারও এসব ঘুষের হকদার বলেও বলেও গোপন সূত্রে জানা গেছে।

আব্দুল কুদ্দুস নামে এক ভুক্তভোগী জানান, ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বিভিন্ন অভিযোগের ঘটনায় পীরগাছা সাব রেজিস্ট্রি অফিসে অভিযান চালায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ সময় কপিরাইটার আব্দুর রহিমের কাছে ঘুষের ১২ হাজার টাকা ও টিপ গ্রহীতা নুরু মিয়ার কাছ থেকে দেড় হাজার টাকা জব্দ করে দুদক টিম। যদিও তার পর আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এমন দুর্নীতির বিরুদ্ধে।

ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নৈশ প্রহরী নজরুল ইসলাম বলেন, আমি দৈনিক ৬০ টাকা হাজিরায় কাজ করি। একটি পে-অর্ডার হারিয়ে যাওয়ায় নতুন করে ব্যাংকে আমার ব্যক্তিগত টাকা জমা দিয়েছি। তিনি কোনো ঘুষ নেন না বলেও দাবি করেন।

অফিস সহকারী মাসুদা বেগম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি টাকা নিয়ে কোনো কাজ করি না। অফিসে কাজ ভাগ করে দেওয়া আছে। কেউ টাকা নিলে আমি কি করতে পারি?

ঘুষ নয়, তবে সেবা গ্রহীতাদের থেকে টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেন নকলনবিস সমিতির সম্পাদক আসাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমরা নকল নবিস পদে কাজ করলেও বেতন পাই না। তাই কাজের বিনিময়ে চা-নাস্তা খাওয়ার টাকা নেই। সবার কাছে জোর করে টাকা নেই না। বোঝেন তো এসব টাকার ভাগ সবাইকে দিতে হয়।

এ ব্যাপারে সোনালী ব্যাংকের পীরগাছা শাখার ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার) আসাদুজ্জামান বলেন, উৎসকরের ৪২ হাজার টাকার পে অর্ডারে সই না মেলায় টাকা দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া আর কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি তিনি।  

ঘুষ নেওয়ার বিষয়ে জানতে উপজেলা সাব রেজিস্ট্রার তিথী রাণীকে অফিসে পাওয়া যায়নি। পরে তার মোবাইলে ফোন করা হয়। একাধিকবার তাকে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৫, ২০২২
এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।