ঢাকা, বুধবার, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ মে ২০২৪, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘অপারেশন খারচা খাতা’ শহীদদের গণকবর অযত্নে-অবহেলায়

ডিষ্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০২২
‘অপারেশন খারচা খাতা’ শহীদদের গণকবর অযত্নে-অবহেলায়

নীলফামারী: ‘খারচা খাতা’, মানে খরচের খাতা। নীলফামারীর বাণিজ্যিক শহর সৈয়দপুরে একাত্তরে পাক বাহিনী ও অবাঙালিরা নির্বিচারে যে গণহত্যা চালিয়েছিল তার নাম ছিল অপারেশন খারচা খাতা।

শহরের অসংখ্য মানুষ হয়েছিলেন এ খাতার শিকার। তাদের গণকবর এখন পড়ে আছে অযত্নে-অবহেলায়।

জানা গেছে, একাত্তরে পাক বাহিনী ও অবাঙালিরা নির্বিচারে যাদের মেরে ফেলত তাদের নাম উঠত ওই খরচের খাতায়। হাজার হাজার মানুষকে গুলি ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছিল সে সময়। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আর সাধারণ বাঙালিদের রক্তে স্নাত বধ্যভূমিগুলো ওই এলাকার মানুষের কাছে স্বজন হারানোর বেদনা জাগানো স্মৃতি।

১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল জলঢাকায় গোলনা ইউনিয়নের কালীগঞ্জ এলাকায় রাজাকার আলবদরের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা তিন শতাধিক নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে সরে যেতে থাকা মানুষগুলোকে হত্যার পর সেখানেই মাটিচাপা দেয়া হয়। স্থানটি কালীগঞ্জ বধ্যভূমি বলে পরিচিতি পায়।

কালীগঞ্জ হত্যাকাণ্ডের শহীদদের স্মরণে সেখানে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিসৌধ। বর্তমানে ওই বধ্যভূমির চারপাশের দশা বেহাল। ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকে যেখানে সেখানে। এ নিয়ে এলাকাবাসীর ক্ষোভ ব্যাপক। তারা বলেন, জেলা শহর থেকে কালীগঞ্জ বধ্যভূমির দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। জলঢাকা উপজেলা পরিষদের আর্থিক সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কালীগঞ্জ বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে। বধ্যভূমির চারপাশ বছরের একদিন পরিষ্কার করা হলেও বাকি দিনগুলো পড়ে থাকে চরম অবহেলায়।

নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বালাগ্রাম ইউনিয়নের পশ্চিম বালাগ্রামের বাসিন্দা অমর কৃষ্ণ অধিকারী। অপারেশন খারচা খাতার একটি ঘটনা বাংলানিউজকে জানান তিনি। বলেন, আমার বাবা-মাসহ ১৩ জন ভারতের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। ওই দিন বিকেলে কালীগঞ্জ বাজারে যেতেই পাকিস্তানি সেনাদের তিন-চারটি গাড়ি আসে। আমাদের সবাইকে দাঁড় করায়। তারপর গুলি করে হত্যা করে। আমার ডান হাতে একটি গুলি লাগে। আরেকটি পিঠের ওপর দিয়ে চলে যায়। ঘটনাটি ছিল অপারেশন খারচা খাতার অংশ। আমি বেঁচে গিয়েছিলাম। স্থানীয় রাজাকার, আলবদর, আল শামসদের সহযোগিতায় পাক হানাদাররা এ ঘটনাটি ঘটিয়েছিল।

জলঢাকা উপজেলার ৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমের ছোট্ট বাজার। যার বর্তমান নামকরণ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু হাট’। এখানে হত্যা করা হয়েছিল কাঁঠালি, বালাগ্রাম ও জলঢাকার তিন শতাধিক সনাতন ধর্মের মানুষকে। তারাও খারচা খাতার হত্যাকাণ্ডের শিকার। সেখানকার বাসিন্দা তপন কুমার দাস। তিনিও আক্রান্ত হয়েছিলেন পাকিস্তানী দোসরদের দ্বারা।

ওই দিনের কথা স্মরণ করে তপন বলেন, ১৩ জুন ১৯৭১, আমাদেরকে ভারতে নেওয়ার উদ্দেশ্যে সকাল ৬টায় রেলস্টেশনে এনে ৪টি বগিতে ঠাসাঠাসি করে তোলা হয়। আমরা তখন অনুমান করলাম কি হতে যাচ্ছে। ট্রেন এসে গোলাহাট মাঠের মধ্যে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে থেমে পড়ল। ওরা কিল ঘুষি মেরে বলে, নামো সবাই। আমরা তখন বললাম, আমাদের গুলি করে মারো। তখন তারা বলল, গুলির অনেক দাম। তখন তারা একে একে নামিয়ে তলোয়ার দিয়ে কাটতে শুরু করল।

আমরা মেয়েদের বললাম, তোমরা গায়ে আগুন লাগাও। আমি জানালার সাটার ভেঙে লাফিয়ে পড়লাম ট্রেনের পূর্ব পাশের নিচু জায়গায়। হত্যা চলছিল পশ্চিম পাশে। প্রায় ১০-১৫ ফিট নিচে পড়ে দেখি, অনেকেই আমার মতো লাফিয়ে পড়তে গিয়ে গুলি খেয়েছে। আমরা বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ে পালিয়ে ২১ জন বেঁচে যাই। সেদিন ৪১৩ হিন্দু মাড়োয়ারি নারী ও মুসলিম পুরুষকে গোলাহাট বধ্যভূমিতে আনা হয়েছিল।

এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সৈয়দপুরে অনেক বাঙালি সেদিন হত্যার শিকার হন। একই অবস্থা ছিল নীলফামারীতেও।

মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হামিদুল ইসলাম বলেন, দিনটির কথা শুনলে গা শিউরে ওঠে। পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালীদের ওপর যে বর্বরতা চালিয়েছে, তা ভুলবার নয়। নতুন প্রজন্মের কাছে অপারেশন খারচা খাতার ইতিহাস তুলে ধরার আহ্বান জানান তিনি।

সৈয়দপুরে শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্য নির্মিত স্মৃতিসৌধ ও স্মৃতিস্তম্ভের কাজ শুরু হলেও অর্থাভাবে শেষ হয়নি। স্থানীয়রা আগামী ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সরকারের প্রতি স্মৃতিসৌধ ও স্মৃতিস্তম্ভের কাজ শেষ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বীর মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সন্তান মহসিনুল হক মহসিন বলেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এ অঞ্চলে বিহারীদের প্রতাপ ছিল ব্যাপক। প্রতিটি কাজ তাদের নেতৃত্বে হতো। পাক বাহিনী তাদের নির্দেশে বাঙালি গণহত্যা চালিয়েছিল। এর নাম দেওয়া হয়েছিল অপারেশন খারচা খাতা। যে দাগ এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে সৈয়দপুরবাসী।

শহীদদের গণকবর অযত্নে-অবহেলায় পড়ে আছে। এ বিষয়ে ব্যবস্থা কবে নেওয়া হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো। যত দ্রুত সম্ভব গণকবর এলাকা পরিস্কার ও স্মৃতিসৌধ ও স্মৃতিস্তম্ভের বাকি কাজ শেষ করার চেষ্টা করবো।

বাংলাদেশ সময়: ২০০৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০২২
এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।