ঢাকা, রবিবার, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১, ১২ মে ২০২৪, ০৩ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

ঐতিহাসিক কপিলমুনি মুক্ত দিবস আজ

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০২২
ঐতিহাসিক কপিলমুনি মুক্ত দিবস আজ

খুলনা: মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনির যুদ্ধ খুলনা জেলার মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত ঘটনা। ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর কপিলমুনি হানাদারমুক্ত হয়।

শুধু তা-ই নয়, দেশের ইতিহাসে গণরায়ের মাধ্যমে প্রথম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও হয় এখানে।

মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর একটানা ৪৮ ঘণ্টা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৫৫ জন রাজাকারের আত্মসর্মপণের মধ্যদিয়ে দক্ষিণ খুলনার সর্ববৃহৎ শত্রু ঘাঁটির পতন ঘটে। ওই দিন উপস্থিত হাজার হাজার জনতার রায়ে আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে ১৫১ জন রাজাকারকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে প্রকাশ্যে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।  

তৎকালীন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর দোসররা দেশব্যাপী সাধারণ নিরীহ মানুষের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার ও নির্যাতন চালাতো। আর এ অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার মতো খুলনার পাইকগাছার সর্বত্র প্রতিরোধ দুর্গ গড়ে ওঠে। এ সময় পাকিস্তানি দোসররা বিশাল অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঘাঁটি করে ঐতিহ্যবাহী কপিলমুনিতে। অত্যাচারের শিকার বহু পরিবার সে সময় বিদেশে পাড়ি জমায়। কপিলমুনির পরিত্যক্ত বিনোদ বিহারী সাধুর সুরম্য বাড়িটি পাকিস্তানি দোসররা ঘাঁটি হিসেবে বেছে নেয় এবং এলাকায় নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। এ সময় তারা এলাকার নিরীহ মানুষদের ধরে ক্যাম্পে এনে শরীরের বিভিন্ন অংশে কেটে লবণ দিতো। এমনকি নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে লাশ নদীতে ফেলে দিতো। এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস বেশি থাকায় তাদের ওপর চলতো অমানসিক অত্যাচার ও নির্যাতন। এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে পাইকগাছার রাড়ুলি, বাঁকা, বোয়ালিয়া ও গড়ুইখালিতে ক্যাম্প গড়ে তোলে বীর মুক্তিযোদ্ধারা।

খুলনা অঞ্চলের মধ্যে কপিলমুনির শত্রু ঘাঁটি ছিল সবচেয়ে বড় ঘাঁটি। সাড়ে ৩শ’র বেশি পাকসেনা ও তাদের দোসররা এখানে অবস্থান নেয়। বাড়িটির ছাদে সব সময় তাক করা থাকতো ভারী অস্ত্র, কামান ও মেশিনগান। ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর ক্যাপ্টেন আরেফিনের নেতৃত্বে একদল মুক্তি বাহিনী প্রথমবার কপিলমুনির রাজাকারদের ঘাঁটিতে আঘাত হানে। কিন্তু সুরক্ষিত দুর্গ আর রাজাকারদের শক্ত অবস্থানের কারণে সেই যুদ্ধে কোনো সফলতা আসেনি।

পরবর্তীতে পুনঃরায় পরিকল্পনা করে দক্ষিণ খুলনার বিভিন্ন এলাকার কমান্ডিং অফিসাররা উপজেলার রাড়ুলির বাঁকা ক্যাম্পে এসে একত্রিত হন এবং কপিলমুনিকে রাজাকার মুক্ত করতে পরিকল্পনা নেন। ওই সময় নৌ-কমান্ডার গাজী রহমত উল্লাহ দাদু, শেখ কামরুজ্জামান টুকু, স ম বাবর আলী, গাজী রফিক, ইউনুস আলী ইনু, শেখ শাহাদাত হোসেন বাচ্চু, মোড়ল আব্দুস সালাম, আবুল কালাম আজাদসহ অনেকে কপিলমুনি যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধারা ৫টি ভাগে বিভক্ত হয়ে অবশেষে ৭ ডিসেম্বর রাতে চারদিক থেকে কপিলমুনি শত্রু ঘাঁটি আক্রমণ করেন। দীর্ঘ ৪৮ ঘণ্টার যুদ্ধ শেষে ৯ ডিসেম্বর বেলা ১১টার দিকে অস্ত্র ফেলে সাদা পতাকা উড়িয়ে ১৫৫ জন পাকিস্তানি দোসর রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। সঙ্গে সঙ্গে পতন ঘটে খুলনাঞ্চলের বৃহত্তর শত্রু ঘাঁটির।

এই যুদ্ধে খুলনার আইচগাতির আনোয়ার ও সাতক্ষীরার আশাশুনির গলডাঙ্গা গ্রামের গাজী আনসার আলী নামে দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন। শত্রুদের বন্দি করে নিয়ে আসা হয় কপিলমুনি সহোচর বিদ্যামন্দির ঐতিহাসিক ময়দানে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে, এলাকার হাজার হাজার জনতার ঢল নামে সেখানে। জনগণের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাৎক্ষণিক যুদ্ধকালীন কমান্ডাররা সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজাকারদের প্রকাশ্যে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে জনতার রায় কার্যকর করেন।

এসময় রাজাকার ঘাঁটি থেকে উদ্ধার হয় তাদের হাতে লেখা এক হাজার ৬০১ জন শহিদের তালিকা। পাওয়া যায় দেওয়ালে পেরেকবিদ্ধ সৈয়দ আলী গাজীর ঝুলন্ত মরদেহ। এ খবরে ফুঁসে ওঠে এলাকার আমজনতা। পাশের কপিলমুনি হাই স্কুল মাঠে জনতার আদালতে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ১৫১ জন রাজাকারের। খুলনার পাইকগাছার কপিলমুনিতে যুদ্ধকালীন জনতার আদালতে রায়ের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার এই ঘটনা দেশের ইতিহাসে একমাত্র উদাহরণ।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবময় অর্জনের এই ঘটনা বহুদিন আড়ালে থাকলেও ২০২০ সাল থেকে সরকারিভাবে দিবসটি উদযাপন শুরু হয়েছে।

সর্বশেষ গত ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর কপিলমুনি মুক্ত দিবসের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক কপিলমুনিতে সরকারি জায়গায় মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর এর টেন্ডার ও ওয়ার্ক অর্ডার হলেও নির্ধারিত জায়গাটি দখলে নিয়ে সেখানে একাধিক পাকা ইমারত নির্মাণের কাজ চলমান। অন্যদিকে মামলা হওয়ায় বন্ধ রয়েছে এর সরকারি কার্যক্রম।

এ বিষয়ে পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ বেগম বলেন, স্থানীয়ভাবে আজ কপিলমুনি মুক্ত দিবস পালিত হবে।  

এছাড়া নির্ধারিত স্থানে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন,  মামলা নয়, বরং অধিগ্রহণ জটিলতায় এর কার্যক্রম থমকে গেছে। ইতোমধ্যে অধিগ্রহণের সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন হয়েছে। অচিরেই এর কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১০১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯ , ২০২২
এমআরএম/এনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।