ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

মনোকথা

আপনার সমস্যা-আমাদের সমাধান

নিজেকে গ্রহণ করুন, তাহলেই অন্যরা আপনাকে বুঝবে

মনোকথা ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫২ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০১৫
নিজেকে গ্রহণ করুন, তাহলেই অন্যরা আপনাকে বুঝবে

ঢাকা: মনোকথা আপনাদের ‍পাতা। আপনার মনস্তাত্ত্বিক নানা সমস্যা সমাধানে আমরা রয়েছি আপনার পাশে।

সমস্যা জানিয়ে জেনে নিন সম্ভাব্য সমাধান। মনোকথার এক পাঠক জানিয়েছেন তার সমস্যার কথা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সমাধান জানানো হলো।

আপনার সমস্যা
আমার নাম বলতে চাই না। আমার বয়স ২৫ বছর। আমি ইমোশনাল একটা ছেলে। আমি গ্রাজুয়েশন শেষ করলাম গত মাসে। আমি অনলাইন এ কিছু কাজ করি তাই দিন এর বেশির ভাগ সময় বাসায় কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকি। আমি অনেক দিন ধরে মানসিক সমস্যায় ভুগছি। আমি ছোট বেলা থেকে একটু একা থাকতে পছন্দ করতাম।

অভ্যাসটা এখনও আছে। আমি সব সময় নিজের জগতে থাকতে পছন্দ করি। তবে বেপারটা খুব বেশিও না। আমি অতিমাত্রায় চিন্তা করি, কোনো বিষয় আমি খেয়াল করলে ওটা আমার মাথা থেকে আর বের হয় না, বারবার ওই বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে থাকি নিজের অনিচ্ছা সত্বেও। কোনো বিষয় চিন্তা করতে না চাইলে আরও বেশি চিন্তা করতে থাকি, এটা হলো প্রধান সমস্যা। উদাহারণ- দুই বছর আগে আমার এক বন্ধু আমার কাছ থেকে ৫,০০০ টাকা ঠকবাজি করে নিয়ে ফেলে ছিলো, তারপর থেকে আমার মাথা থেকে বিষয়টি একদিন-এর জন্যও বের হয় নাই, অনেকবার চিন্তা করেছি প্রতিশোধ নিব, অনেকবার মাফও করে দিয়েছি, পরে আবারও বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করতে থাকি।

এক বছর পর তার সামনা-সামনি হই, সে আমাকে দিয়ে দেবে বলে, আমি তাকে বলি, আমি আর টাকা নিব না। তারপর থেকে আমি তার সঙ্গে আর কথা বলি না। এটাও আমার আর একটা বদঅভ্যাস, কারও সঙ্গে কোনো ঝামেলা হলে, ওই মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। আমার বন্ধুদের মধ্যে ৪ জন এর সঙ্গে কথা বলি না, ওরাও বলে না, তাই আমিও বলি না।

গত বছর শুরুর দিকে একটি গ্রামের মেলায় আমার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাই, মেলা থেকে একটু দূরে নিরিবিলি জায়গায় বসে কথা কথা বলছিলাম, দুটো লোক আমাদের দিকে এসে, আমাদের দেখে চলে
যায়, একটু পর তারা আরও লোকজন নিয়ে আসে।

আমার বন্ধুকে ওরা মারধর করে টাকা-মোবাইলও নিয়ে নেয়। আমার বন্ধু আমাকে কিছু করতে বলে, আমি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। ওকে বাসায় পৌঁছে দেবে বলে বাইকে করে নিয়ে যায় তারা।

রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আরও হেনস্থা করার চেষ্টা করলে ও চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। পরে ওরা তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।

তখন থেকে আমার মধ্যে একটা অপরাধ বোধ কাজ করতে শুরু করে। আমার মন বারবার বলতে থাকে, আমার জন্য একটা মেয়ের ক্ষতি হতে পারত। আমি কেন একটু সাহস করে ওইদিন মোকাবেলা করলাম না। কেন ওইদিন মেয়েটাকে তাদের সঙ্গে যেতে দিলাম।

পরে অনেক চেষ্টা করেও মূল অপরাধীকে ধরা যাইনি। আমার মধ্যে সেই ক্ষোভটা এখনও রয়ে গেছে। অনেক বার মনে মনে মাফও করেছি, আবার ক্ষোভ চলে আসে। এরকম আরও অনেক কিছু মাথায় ঘুরতে থাকে।

আমি ধূমপান বা অন্য কোনো নেশা করি না, তবে ইদানীং মনে হচ্ছে ধূমপান করলে হয়তো টেনশেন কমবে। তবে আবার মনে হয়, যতক্ষণ করব ততক্ষণ টেনশেন থাকবে না, আবার তো আসবে।

মাঝে মাঝে মন ভাল থাকলে, খুব মজা করি এবং নিজেকে কনফিডেন্ট মনে হয়। এখন পর্যন্ত ডাক্তারের কাছে যাইনি। যাব চিন্তা করছি এক বছর ধরে।

আমার সমস্যা:
•    আমি একই কথা বারবার চিন্তা করি, যখন একা বা কিছু করার থাকে না তখন পুরোনো কথা গুলো হাজার বার মনে করি। মনে করতেই থাকি।
•    আমার আর একটি সমস্যা হলো আমার যখন রাগ হয় আমি ওটা সরাসরি সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ করতে পারি না, প্রকাশ করতে গেলে কথা আটকে যায়। মনে মনে বকা দিই। পরে চিন্তা করি কি কি বলতে পারতাম।
•    কোনো কিছু চিন্তা করতে না চাইলে আরও বেশি চিন্তা চলে আসে।
•    মাঝে মাঝে নোংরা চিন্তাও আসতে চায়, এমনকি পরিবার এর লোকজন সম্পর্কেও, আমি নিজেকে কন্টোল করি।
•    কোনো কাজ করতে বললে ভুলে যাই।
•    সব সময় কনফিউশন-এর মধ্যে থাকি।

আমার রোগটা কোন স্টেইজ এ আছে? আমার কি করা উচিত?

আমাদের সমাধান
সাহস করে এই চিঠি লেখার জন্য প্রথমেই আপনাকে ধন্যবাদ। যেকোনো সমস্যা শনাক্তকরণ অর্থ হলো সমাধানের দিকে ইতিবাচকভাবে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া।

১ম সমস্যা: আপনি লিখেছেন, ছোট বেলা থেকে ভুগছেন। কাজেই অনেকদিন থেকে আপনি আপনার চিন্তার একটা প্যাটার্ন তৈরি করেছেন। এই প্যাটার্নটা কেমন? এটা হলো (১) একই জিনিস নিয়ে বারবার চিন্তা করা। ঠিক যেন একটা বৃত্তবন্দি ভাবনা। যেখানে শুরু আবার ঘুরে ফিরে সেইখানে ফিরে আসছেন। চিন্তার এই প্যাটার্ন আপনাকে একই ভাবনা নিয়ে বারবার নিজের অপছন্দ সত্ত্বেও ভাবতে বাধ্য করছে। আপনাকে সচেতনতার সঙ্গে এই বৃত্ত ভাঙতে হবে।

•    চিন্তা করে দেখুন কোন কোন কমন প্যাটার্ন আছে যা আপনাকে একই চিন্তার আর্বতে ঘুরপাক খেতে ট্রিগার করে।
•    ট্রিগারিং ঘটনাগুলি চিহ্নিত করুন। গত মাসে হয়তো এটা মায়ের সঙ্গে কোনো কথা থেকে হয়েছে, গত সপ্তাহে এটা কোনো বন্ধুর সঙ্গে হয়েছে, গত কাল হয়তো কোনো দোকানদারের সঙ্গে হয়েছে। বিভিন্ন সময় পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে, মানুষ বদলে যাচ্ছে কিন্তু প্রতিটি ঘটনাই একই নেতিবাচক অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে। তাহলে এই প্রতিটি ক্ষেত্রে ট্রিগারিং পয়েন্টগুলো কি কি?
•    যেহেতু আপনি একা থাকতে পছন্দ করেন তাই ধরে নিচ্ছি, আপনার ভুবনে পরিচিত মানুষের আনাগোনা কম। আবার লিখেছেন, অনলাইনে আপনার দীর্ঘ সময়ের বিচরণ ক্ষেত্র। ভার্চুয়াল জগতের আসক্তি তৈরি হয়নি তো? একটু খেয়াল করে দেখেন। দিনে কতটা সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে কাটান? দীর্ঘ সময় ইন্টারনেটে থাকা আসক্তির জন্ম দেয়। আমরা নিজের অজান্তেই এর শিকার হই।
•    যেহেতু আপনি লিখেছেন ছোটবেলা থেকেই এক থাকতে পছন্দ করেন এবং সেই আসক্তিটা এখনও আছে তাই, সম্ভবত আপনার মানুষের সঙ্গে কমিউনিকেশন সিম্বলগুলোতে কিছুটা পরির্বতন আনতে হবে। আপনি এতদিন যেভাবে মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন, সেই আচরণগত জায়গায় কিছু পরির্বতন আনুন। দেখবেন, আপনার প্রতি মানুষের রেসপন্স বদলে যাবে। আচরণ পরির্বতনের জন্য প্রথেমেই কাগজ-কলম নিয়ে বসে বসে লিখুন কি কি আচরণ আপনি আন্যদের সঙ্গে ভিন্নভাবে করতে চান। এক সিটিং এ সব মনে পড়বে না। তবে ধীরে ধীরে যখন মনে পড়বে লিখুন। আস্তে আস্তে লিস্ট বড় হোক কচ্ছপের গতিতে। খরগোশ আর কচ্ছপের গল্পের মত। শেষে কিন্তু কচ্ছপেরই জয় হয়।

২য় সমস্যা: আপনার নিজেকে এবং অন্যকে একটি সীমানা নির্ধারণী সীমান্ত রেখা দ্বারা আলাদা করতে হবে। সোজা কথায় বাউন্ডারি সেট করতে হবে। যে যখন চাইলো আপনার ঘরে ঢুকে পড়লো এটা যেমন কাম্য নয়, অন্য কেউ এমন কিছু আপনার কাছে চাইলো যেটা দেওয়াটা আপনার জন্য কষ্টকর সেটা দিয়ে দেওয়াও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। নীতি হওয়া উচিৎ আমি কারও ক্ষতি করবো না, কাউকে আমার ক্ষতি করতে দেবো না। “অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা তারে যেন তৃণ সম দহে। ” এক্ষেত্রে বন্ধুকে টাকা ধার দেওয়া যেতেই পারে, যদি তাতে আপনার সমস্যা না হয়। আবার প্রয়োজনে ফেরত চাইতে সমস্যা নেই। সে ফেরত দিতে চাইলে অবশ্যই নেবো।

অভিমান তার উপরই করা যায় যারা কাছের, যে অভিমান বা যদি শেষে কেউ আমাকে বুঝলো না এটা ভাবাটাই অনর্থক। বলুন তো এমন ভাবনাতে আপনার কি লাভ হলো? কাকে কতটুকু দেবেন বা নেবেন তার সীমা রেখা তৈরি করুন। এক দিনে হবে না। সময় নিন, আস্তে আস্তে হবে। তবে হতাশ হবেন না।

নিজেকে লেবেল করবেন না যে আমি অপদার্থ। শুধু একটা জিনিস ভাবুন এই কষ্ট-রাগ-লজ্জা ইত্যাদি অনুভূতি কি আপনাকে আরও খারাপের দিকে ঠেলে দিচ্ছে? তাহলে এই আনুভূতি রেখে কি লাভ?

৩য় সমস্যা: আপনার বন্ধুর ঘটনাটা আপনার মধ্যে প্রচণ্ড অপরাধী ভাবার অনুভূতি জন্ম দিয়েছে। ঠিকই বলেছেন, কেন সাহস করে মোকাবেলা করতে পারলেন না? কারণ এখানে আপনার এথিকাল বাউন্ডারিটা দুর্বল ছিলো। এতে আপনার বা আপনার বন্ধু উভয়েরই চরম ক্ষতি হতে পারতো। কাজেই কি কি কাজ মন চাইলেও করা যাবে এবং যাবে না তার একটা লিস্ট তৈরি করুন। দেখবেন, ভবিষ্যতে এমনটি হবে না।

আপনার প্রধান সমস্যা হলো আপনার নিজের কাছেই নিজে গ্রহণযোগ্য নন। তাই আপনি ধরেই নিয়েছেন, আপনার রোগ হয়েছে। রোগটার স্টেজ জানতে চেয়েছেন। আপনি নিজেকে আগেই লেবেল করে ফেলেছেন রোগী হিসেবে। কথায় আছে না? ‘বনের বাঘে খায় না মনের বাঘে খায়’। অনেক সময় আমরা তাৎক্ষণিক অনেক অনুভূতি প্রকাশ করতে পারি না, অনেক ভালো-মন্দ চিন্তা আসে, কনফিউশন আসে। এই সময় যদি নিজেই বিচারকের ভূমিকায় বসে নিজেকে শুরুতেই রোগীভাবতে শুরু করি তাহলে ইতিবাচক পরির্বতনটা কিভাবে আসবে!

প্রথমেই দরকার বদলানোর ইচ্ছা। তারপর দরকার সাহস। ভেবে দেখুন, সেই ইচ্ছা আপনার আছে কিনা? তাহলে সাহস করে নেমে পড়ুন কি কি বদলাতে চান সেই তালিকা করতে। আমরা আপনার সঙ্গে আছি। মনে রাখবেন, “ife is a matter of choice. Either you choice to suffer or you choice to enjoy”। আপনি নিজেই যদি নিজেকে গ্রহণ করতে না পারেন তবে বাইরের মানুষ কিভাবে বুঝবে আপনাকে?

প্রিয় পাঠক, ‘মনোকথা’ আপনাদের পাতা। আপনারা জানাতে পারেন বাংলানিউজের ‘মনোকথা’ পাতায় আপনি কি ধরনের প্রতিবেদন দেখতে চান। মনোরোগ নিয়ে যে কোনো মতামত ও আপনার সমস্যার কথা জানাতে পারেন আমাদের।

আমরা পর্যায়ক্রমে অভিজ্ঞ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে আপনাদের প্রশ্নের জবাব জানিয়ে দেবো। আপনি চাইলে গোপন রাখা হবে আপনার নাম-পরিচয় এমনি কি ঠিকানাও।

সমস্যার কথা জানানোর সঙ্গে সমস্যার বিস্তারিত বিবরণ, আপনার নাম, বয়স, কোথায় থাকেন, পারিবারিক কাঠামো এবং এজন্য কোনো চিকিৎসা নিচ্ছেন কি না এ বিষয়ে বিস্তারিত আমাদের জানান। শুধুমাত্র সেক্ষেত্রেই সমস্যা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা জানানো সম্ভব হবে।

এছাড়া মানসিক সমস্যা সংক্রান্ত বা এ বিষয়ে বিশেষ যে কোনো লেখা যে কেউ পাঠিয়ে দিতে পারেন আমাদের।

আপনার সমস্যা, মতামত বা পরামর্শ ও লেখা পাঠানোর জন্য আমাদের ইমেইল করুন- [email protected]


প্রফেসর  ডা. সানজিদা শাহরিয়া

কাউন্সিলর, বিসিআর পেইন অ্যান্ড ওয়েলনেস সেন্টার



বাংলাদেশ সময়: ১৯৫২ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০১৫
এটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মনোকথা এর সর্বশেষ