ভোর পাঁচটার মতো হবে। সকালের আলো তখনো স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি।
এর আগে হুজুরের এক ভক্তের মাধ্যমে হুজুরের সাথে দেখা করেছে পরিবারটি। ভক্তের অনুরোধে হুজুর একটু বেশি সময় দিয়েছেন এবং বিষয়টিকে তাড়াতাড়ি করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। হুজুরের কাছ থেকে বের হয়ে ভক্তটি বাকি বিষয়গুলো বাবা মাকে বুঝিয়ে বলেছে। মেয়েটিকে এমনকি অন্য কাউকেও এসব কথা জানানো যাবে না। তাতে করে, জ্বীনেরা মেয়েটির উপর ক্ষেপে গিয়ে কি করে তা বুঝা মুশকিল। তাই বাবা মা, সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথেই এই ব্যবস্থা করেছে। কেউ টের পাবার আগেই মেয়েটিকে হুজুরের বাড়িতে নিয়ে আসতে পেরেছে। এখন অপেক্ষা কখন জ্বীন মেয়েটিকে ছেড়ে যাবে।
মেয়েটি কয়েকদিন সেখানে থাকার পর সত্যিই জ্বীন তাকে ছেড়ে চলে গেছে। মেয়েটি এখন অনেক দুর্বল, বেশ কয়েক দিনের ধকল গেছে মেয়েটির উপর দিয়ে। জ্বীনেরা যত রকমের অত্যাচার করা যায় সবই করেছে মেয়েটির উপর।
মেয়েটি মুখ দিয়ে খাবার খেলেও খাবারগুলো গেছে জ্বীনেদের পেটে। ঘুম সব জ্বীনেরা কেড়ে নিয়েছে। ভাগ্যিস জ্বীন হুজুরের খবর আগে ভাগেই তারা পেয়েছিল এবং সেই মতো দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পেরেছে। তা না হলে, আরো কয়েকদিন যদি এভাবে চলতো তবে মেয়েটির যে কি হতো।
যাহোক জ্বীন এখন চলে গেছে। কিন্তু মুশকিল হয়েছে অন্য জায়গায়। জ্বীন চলে যাবার সময় মেয়েটির মাথায় বেশকিছু ক্ষতি করে গেছে। সেসব ঠিক করতে হলে, ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা সেটা ঠিক করতে পারে।
মা বাবা আবার অসহায় বোধ করছেন, কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে দেখা করবে। হুজুর মা বাবাকে চিন্তা করতে বারণ করেন। তার পালিত জ্বীনদের আবার ডাকলেন। এবার হুজুরের পালিত জ্বীনরা বলে দিলেন, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাতে হবে। একজন নামও জ্বীন বলে দিলো। বাবা মা হাফ ছেড়ে বাঁচলো, যা হোক হুজুরের সব ব্যবস্থাই করে দিয়েছে। এখন মাথার সমস্যা সারলেই চলে।
এখানে আরো অনেক কথা আছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কি ওষুধ দিয়েছে সেটা হুজুরকে দেখাতে হবে। হুজুর বললে, মেয়েকে ওষুধ খাওয়ানো হবে। না করলে ওষুধ বন্ধ।
গল্পটি নিতি নামের (ছদ্দ নাম) ১৭ বছরের একটি চঞ্চল-চটপটে মেয়ের। বাবা মায়ের তৃতীয় সন্তান। বাবা সরকারি চাকরিজীবী, মা গৃহিণী। বড় দুই ভাইবোনও এখনো পড়াশুনা করছে। নিতিও এসএসসি পাশ করেছে। বাবা মায়ের ইচ্ছা ঢাকায় কোনো একটি কলেজে পড়বে। নিতিও তাই চায়।
নিতি ঢাকায় মামার বাসায় উঠেছে, এখানে থেকে আপাতত কলেজে ইন্টারভিউ দেবে। পরবর্তীতে ভর্তি হয়ে কোনো একটি হোস্টেলে উঠে যাবে, এমনি ইচ্ছা। মামার বাসায় প্রথম কয়েকদিন ভালো থাকলেও, কয়েকদিন পর থেকেই শুরু হয় সমস্যা। নিতি কারো সাথেই কথা বলে না। বেশিরভাগ সময়ই চুপচাপ বসে থাকে। পড়াশুনাও ঠিক মতো করে না। মামী প্রথমদিকে কিছু বলেনি। মনে করেছে, নিতির মামা বা মা-বাবা মাইন্ড করতে পারে। মনে করতে পারে, মামী তাকে তাদের বাসায় রাখতে চায় না বলেই হয়েতো বদনাম করছে।
কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই অদ্ভুত সব কাণ্ড করতে থাকে নিতি। সবাই যখন কাজে ব্যস্ত থাকে নিতি তখন চুপি চুপি রান্না ঘরে ঢুকে ভাত ভর্তি হাড়িতে পানি ঢেলে দেয়। মামী প্রথমে দুই একবার বোঝার চেষ্টা করেছে, বিষয়টি কি? দিন দিন বাড়তেই থাকে। মামী মামাকে বলেন, মামাও খেয়াল করলেন আগের মতো কথা বলে না নিতি। শুধু তাকিয়ে থাকে। মামার সন্দেহ হলো, মনে হয়ে ঢাকা এসে এখানে ঠিক মতো খাপ খাইয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিলেন, কয়েক দিনের জন্য বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন। তারপর আবার নিয়ে আসবেন।
কিন্তু বাড়িত গিয়ে নিতির পাগলামি আরো বেড়েছে। এবার দিন বা রাতের বেশিরভাগ সমই ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকে। কখনো এমনকি খাটের নিচেও চলে যায়। বাথরুমে যেতে চায় না, পেশাব পায়খানা অন্য কোথাও করবে। বাথরুমে যাবে না। বাবা-মা মুশকিলে পারেছেন। আত্মীয় স্বজন এবং প্রতিবেশী কয়েকজন এসে, দেখে নিশ্চিত হয়েছে নিতিকে জ্বীনে ধরেছে। মানে ঢাকায় যাবার রাস্তায় বা ওখান থেকেই কোনো ভাবে ধরেছে। তারপরই তারা জ্বীন হুজুরের শরণাপন্ন হয়েছেন।
রোগটি আসলে সিজোফ্রেনিয়া
বেশ কয়েকটি ঘটনাই এমন ঘটেছে। জ্বীন হুজুর কোনো একজন বিশেষজ্ঞের নামসহ মনোরোগবিদ্যা বিভাগের আউটডোরে পাঠিয়েছেন। তারা এখান থেকে চিকিৎসা নিয়ে আবার হুজুরের কাছে অনুমতি নিয়ে ওষুধ খাওয়া শুরু করেছেন।
এখানে কিছু প্রশ্ন এসে যায় অবধারিত ভাবেই। যেমন- রোগের সচেতনতা কোত্থেকে শুরু করা দরকার? প্রথম কাদের সচেতন হতে হবে? এমনতর সমস্যার ক্ষেত্রে কারা সিদ্ধান্ত নেবেন? চিকিৎসকদের দায় দায়িত্ব আসলে কতটুকু?
সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত মানুষজন রাগ, সন্দেহ, একা থাকা, একা একা হাসা, একা একা কথা বলাসহ বিভিন্ন ধরনের অসংগতিপূর্ণ আচরণ এবং কাজ করে থাকতে পারে। তারা নিজেরা ভাবতে পারেন না, এটা একটা রোগ। তাই ওষুধ খাওয়া বা চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না।
সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা যেখানে কেউ নেই সেখানেও মানুষের কথা শুনতে পান। সেই অদৃশ্য মানুষটাকে তারা সত্যি মনে করেন এবং তাদের সাথে কথা বলেন। রাস্তায় হাঁটার সময় মনে করেন সব মানুষ তাদের নিয়ে কথা বলছে। এমন অনেক রকমের অসংগতি ও অসংলগ্ন আচরণ তারা করেন। বিভিন্ন ধরনের অদ্ভূত বিশ্বাস তার করেন, যার সাথে বাস্তবতার সম্পর্ক নেই। একেক জন একেক রকমের বিশ্বাস করেন এবং সেই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই চলেন। সাধারনত, ১৫ থেকে ২৫ বছরের বয়সে রোগটা শুরু হয়। তবে অন্য যেকোনো সময়ও হতে পারে।
মেয়েটি হঠাৎ করেই রোগটিতে আক্রান্ত হয়েছে। রোগ হঠাৎও হতে পারে, আবার ধীরে ধীরেও হতে পারে। তবে, যত কম বয়সে হয় চিকিৎসা ততই কঠিন। সিজোফ্রেনিয়াকে বলা হয়, চিন্তার রোগ। সাধারণত ভুল বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। আশপাশের মানুষজন সেটা মেলাতে পারে না। তখনই বিভিন্ন কিছু মনে করেন। জ্বীনের আসর কিংবা বান মারাও এসব চিন্তার মধ্যে থাকে।
রোগকে রোগ হিসেবে দেখতে হবে। মেয়েটির এমনতর অদ্ভুত আচরণের প্রধান কারণ, তার ভ্রান্ত বা ভুল বিশ্বাস। যারা বৈজ্ঞানিক নাম ‘ডিলুশন’।
মেয়েটি বিশ্বাস করতো, ভাতে কেউ বিষ দিয়ে গেছে এবং ভাতগুলো শুধু ওর জন্যই রান্না করা হয়েছে। তাই সে ভাতে পানি ঢেলে দিতো। মনে করতো সবাই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, তাকে বিভিন্ন ভাবে ক্ষতি করতে পারে তাই সে ঘরে বন্দি হয়ে থাকাতো এবং কারো সাথে মিশতো না। তার ধারণা ছিলো বাথরুমে গেলেই তাকে আটকে দেওয়া হবে, সেখানেই তাকে মেরে ফেলা হবে।
সিজোফ্রেনিয়া সম্পর্কে আরো অনেক কথা বলার আছে। তার মধ্যে অন্যতম- রোগটি যত তাড়াতাড়ি বোঝা যাবে, চিকিৎসা যত তাড়াতাড়ি করা যাবে ততই মঙ্গল। আক্রান্ত মানুষটি এবং তার পরিবারের জন্য ততই ভালো।
সিজোফ্রেনিয়াকে ভালো করে জানলে, অন্যান্য অনেক মানসিক রোগ সম্পর্কেও জানা হয়ে হবে।
প্রিয় পাঠক, ‘মনোকথা’ আপনাদের পাতা। মনোরোগ নিয়ে যে কোনো মতামত ও আপনার সমস্যার কথা জানাতে পারেন আমাদের। আমরা পর্যায়ক্রমে অভিজ্ঞ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে আপনাদের প্রশ্নের জবাব জানিয়ে দেবো। আপনি চাইলে গোপন রাখা হবে আপনার নাম-পরিচয় এমনি কি ঠিকানাও।
সমস্যার কথা জানানোর সঙ্গে সমস্যার বিস্তারিত বিবরণ, আপনার নাম, বয়স, কোথায় থাকেন, পারিবারিক কাঠামো এবং এজন্য কোনো চিকিৎসা নিচ্ছেন কি না এ বিষয়ে বিস্তারিত আমাদের জানান। শুধুমাত্র সেক্ষেত্রেই সমস্যা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা জানানো সম্ভব হবে।
এছাড়া মানসিক সমস্যা সংক্রান্ত বা এ বিষয়ে বিশেষ যে কোনো লেখা যে কেউ পাঠিয়ে দিতে পারেন আমাদের।
আপনার সমস্যা, মতামত বা পরামর্শ ও লেখা পাঠানোর জন্য আমাদের ইমেইল করুন
ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব
সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়