ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

মনোকথা

অটিস্টিক শিশু লজ্জার নয়, ভালোবাসার

হাবীব ইমন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ৯, ২০১৪
অটিস্টিক শিশু লজ্জার নয়, ভালোবাসার ছবি: লেখক

অটিস্টিক শিশুদের কেউ কেউ মানসিক প্রতিবন্ধি বলে থাকেন। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এ ধরনের কথার সাথে একমত নন।

তারা বলেন, অটিজমে আক্রান্ত কোনো কোনো শিশু বা অটিস্টিক শিশু কখনো কখনো বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অত্যন্ত পারদর্শিতা প্রদর্শন করতে পারে। তবে এই পারদর্শিতা প্রদর্শনের জন্য তাদের বিশেষ শিক্ষার একান্ত প্রয়োজন। আর এ কারণে অটিজমে আক্রান্ত শিশুকে বিশেষ প্রয়োজন সম্পন্ন শিশু বা বুদ্ধিবৃত্তিক চাহিদাসম্পন্ন বলা হয়।

অটিজমে আক্রান্ত শিশুকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে তাদের অনেকেই স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারে। আর ওদের জন্য প্রয়োজন পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশিদের নিবিড় ভালোবাসা।  

অটিজম শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ আউটোস থেকে। অর্থাৎ আত্ম বা নিজ। বিশেষ ধরনের স্নায়ুবিক (ডিসঅর্ডার অব নিউরাল ডেভেলপমেন্ট) সমস্যাই হলো অটিজম।

অটিস্টিকরা নিজস্ব একটা মনোজগত তৈরি করে। তারা সেখানে বসবাস করে। চারপাশ থেকে আলাদা তাদের এ জগৎ। তাই আচরণও স্বাভাবিক হয় না। ১৯১১ সালে সুইস মনোবিজ্ঞানী অয়গেন ব্লয়লার প্রথম অটিজমকে এক ধরনের মনোরোগ হিসেবে চিহ্নিত করেন। কয়েক দশক পরে রোগটি নিয়ে গবেষণা বিস্তৃত হয় পশ্চিমের বহু দেশে।

অটিজম রোগ সম্পর্কে জনসম্মুখে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপিত হয় ১৯৪৩ সালে। প্রায় একই সাথে জন হপকিনস হাসপাতালের ডা. লিও কান্নের এবং জার্মান বিজ্ঞানী ডা. হ্যান্স এসপারজার এ রোগ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করেন। তার আগেও এ রোগ ছিলো তবে বিস্তারিত তথ্য কারো জানা ছিল না।

অটিজম কেন হয় তার সঠিক কারণ আজ পর্যন্ত উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মনোবিকাশের প্রতিবন্ধকতার কারণ হিসেবে মস্তিস্কের অস্বাভাবিক জৈব রাসায়নিক কার্যকলাপ, মস্তিস্কের অস্বাভাবিক গঠন, বংশগতির অস্বাভাবিকতা প্রভৃতির কথা বলে থাকেন।



অটিজমের লক্ষণ
অটিজমের লক্ষণগুলো একদম শৈশব থেকেই প্রকাশ পেতে থাকে। মা-বাবা একটু সতর্ক হলে তা সহজেই ধরতে পারেন। স্বাভাবিক একটি শিশু এক বছর বয়সে অর্থবহ অঙ্গভঙ্গি করতে পারে, ১৬ মাস বয়স থেকে একটি শব্দ বলতে পারে এবং ২ বছর বয়সে ২ শব্দের বাক্য বলতে পারে কিন্তু অটিজম আক্রান্ত শিশুর মধ্যে এ সব আচরণ দেখা যায় না। তার সমবয়সী শিশুদের সাথে বন্ধুত্ব করতে চায় না। এই রোগে আক্রান্ত শিশু কারো সাথেই, সে সমবয়সী হোক কিংবা অন্য যে কোনো বয়সী হোক তার সাথে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে না। কিছু কিছু বাচ্চা আবার ১ থেকে ২ বছর বয়স পর্যন্ত খেলাধুলা কথাবার্তা সব ঠিক থাকে কিন্তু হঠাৎ করে কথা ও সামাজিক মেলামেশা বন্ধ করে দেয়। এটাকে বলা হয় রিগ্রেসিভ অটিজম।

নাম ধরে ডাকলে সাধারণ শিশু সাড়া দেয়, কিন্তু অটিজমে আক্রান্ত শিশু নাম ধরে ডাকলেও সাড়া দেয় না। এ ধরণের শিশু আপন মনে থাকতে পছন্দ করে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এরা কারো চোখের দিকে তাকায় না। কারো দিকে তাকিয়ে হাসে না কিংবা আদর করলেও ততটা সাড়া দেয় না।

সাধারণভাবে অটিস্টিক শিশুরা একই কথা বারবার বলে এবং একই কাজ বারবার করতে পছন্দ করে। অটিজমে আক্রান্ত বাচ্চাদের কেউ কেউ বেশিরভাগ সময় শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ ইত্যাদিতে বেশি সংবেদনশীল থাকে। অটিস্টিক বাচ্চারা তাদের রুটিন মাফিক কাজ না হলে রেগে যায়। তাদের বিভিন্ন জিনিসের প্রতি অতি দুর্বলতা দেখা যায়। অনেক সময় তারা একই শারীরিক ভঙ্গি বা অঙ্গ সঞ্চালন করতে থাকে।

ভাব বিনিময় বা যোগাযোগের সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে কাউকে দেখলে কথা বলতে সমস্যা। অনেক সময় তারা কথা বলার পরিবর্তে আকার ইঙ্গিতে বোঝাতে চায়। অনেকেই অনেক দেরি করে কথা বলে আবার অনেকে একেবারেই কথা বলতে পারে না। অন্যরা যে দিকে তাকিয়ে থাকে সেই দিকে তাদের দেখাদেখি। অনেক সময় আবার আঙ্গুল দিয়ে কোনো দিকে নির্দেশ করলেও সেদিকে তাকায় না। যারা কথা বলতে পারে তারা অনেক সময় একই কথা, শব্দ, পছন্দের টিভি বিজ্ঞাপনের কথা বা গান বার বার বলতে থাকে।



অটিজমের রকম
অটিজমের কয়েকটি ধরন রয়েছে। এর মধ্যে ক্লাসিক অটিস্টিক ডিসঅর্ডার বা ক্যানার সিনড্রোমটাই বেশি লক্ষ্য করা যায়। যাকে ‘আর্লি ইনফ্যানটাইল অটিজম’ ও বলা হয়।

সাধারণত তিন বছর বয়স হওয়ার আগেই এর লক্ষণ দেখা যায়। এতে বাচ্চার মধ্যে এক সাথে অনেক দিক দিয়ে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। যেমন, কথা বলার সমস্যা, যোগাযোগ ও বোঝার অসুবিধা ইত্যাদি।

অটিজমের আর একটি ধরন ‘অ্যাসপারজার্স সিনড্রোম’। এ ক্ষেত্রে স্বাভাবিক কথা বলার ক্ষমতা থাকলেও কারো সঙ্গে মিশতে পছন্দ করে না আক্রান্তরা। বিশেষ কোনো বিষয়ে পারদর্শী হয়, অন্য দিকে আরেকটি বিষয় হয়তো বুঝতেই পারে না। যেমন অঙ্কে দক্ষ হলেও ভাষায় একেবারে কাঁচা।



চিকিৎসা
অনেক ক্ষেত্রে অটিস্টিক বাচ্চাদের চিকিৎসায় ভালো ফল পাওয়া যায়, যদি তা দ্রুত নির্ণয় করা যায়। এই চিকিৎসা হচ্ছে একটি সম্বন্নিত চিকিৎসা যা পেডিয়াট্রিক বিশেষজ্ঞ, নিউরো রিহ্যাবিলিটেশন বিশেষজ্ঞ, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট এবং ক্ষেত্র বিশেষে ফিজিওথেরাপিস্টের সহযোগিতায় প্রতিটি অটিস্টিক বাচ্চার জন্য আলাদা আলাদাভাবে ডিজাইন করা হয়।

এ ধরনের বাচ্চাদের জন্য এখন বাংলাদেশেই বিশেষায়িত কয়েকটি স্কুল আছে, যেখানে তাদের জন্য বিশেষ পাঠদানের ব্যবস্থা করা হয়। তবে এটা নির্ভর করবে তার অকুপেশনাল থেরাপিস্ট এর পরামর্শের ওপর। তিনি বাচ্চার সক্ষমতা বুঝে সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত দেবেন কোন স্কুল তার জন্য ভালো হবে।

অনেক অটিস্টিক শিশুর কিছু মানসিক সমস্যা যেমন অতি চঞ্চলতা, অতিরিক্ত ভীতি, মনোযোগের সমস্যা, ঘন ঘন মনের অবস্থা পরিবর্তন হওয়া, বিষণœতা, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি থাকে। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় সাইকিয়াট্রিস্ট ওষুধের ব্যবহার করে থাকেন।

অটিস্টিক শিশুদের কোনো ‘মিরাকল চিকিৎসা’ নেই। পরিবার, আত্মীয়-পরিজন, সমাজ, শিক্ষক-শিক্ষিকা, চিকিৎসকসহ সকলের সম্বন্নিত সাহায্য সহযোগিতায় একটি অটিস্টিক শিশুর জীবন হয়ে উঠতে পারে আনন্দময় ও অর্থবহুল।



বিশ্বব্যাপী অটিজম দিবস
প্রতিবছর ২ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী অটিজম সচেতনতা দিবস পালন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেন্টার টু ডিজিস কন্ট্রোল’ মনে করে, ১৯৭০ সালে প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে একজন শিশু অটিজমে আক্রান্ত হলেও বর্তমানে প্রতি ৫০ জনের মধ্যে একজন শিশু অটিজমে আক্রান্ত হচ্ছে।


মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রায় চার গুণ বেশি। প্রতি ৫৪ জন ছেলের মধ্যে একজন এবং ২৫২ জন মেয়ের মধ্যে একজন অটিজমে আক্রান্ত। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজেস (আইসিডি ১০) এবং আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের বিভিন্ন রোগ শনাক্তকরণের পদ্ধতিতে (ডিএসএম ৪) এ অটিজমকে একটি ব্যাপক বিকাশজনিত সমস্যা হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে।



এই সব মূঢ় ম্লান মুখে দিতে হবে ভাষা
বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে অটিজম নিয়ে তেমন কোনো সমীক্ষা হয়নি। তবে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, শুধুমাত্র ঢাকা বিভাগেই অটিস্টিক শিশুর হার শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ (০.৮৪%)। তবে আরেকটি বেসরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখ শিশুর মধ্যে ২৫০ জন অটিস্টিক।

‘এই সব মূঢ় ম্লান মুখে দিতে হবে ভাষা’র কবি রবীন্দ্রনাথ সাত দশক আগেও শিশুদের অস‍হায়তার কথা ভেবেছেন। তারই অনুপ্রেরণায় ১৯৩৩ সালে ভারতের মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রামে ‘দুর্বল মস্তিষ্ক শিশুদের আশ্রম’ স্থাপন করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ এর নামকরণ করেছিলেন ‘বোধনা নিকেতন’।

বাংলাদেশে অটিজম নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম শুরু হয়েছে কয়েক বছর হলো। ঢাকায় ‘অটিজম রিসোর্স সেন্টার’, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সেন্টার ফর নিউরোডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অটিজম ইন চিলড্রেন’ এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ‘চাইল্ড গাইডেন্স ক্লিনিক’-এ অটিজমের বিষয়ে বিশেষ পরামর্শ ও চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, ২০০৯ সাল থেকে অটিজম নিয়ে আমরা কার্যক্রম শুরু করি। ২০১০ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দুই দফায় প্রায় সাড়ে ৪শ’ চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ৯টি ব্যাচে ৭০ জনকে নতুন করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। আমরা অটিস্টিক শিশুদের মায়েদের নিয়ে একটি ফোরাম গঠন করেছি। প্রাথমিক পর্যায়ে যাতে এটি শনাক্ত করা যায় সে লক্ষ্যে সরকার এবং বিএসএমএমইউ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

এছাড়া ঢাকা শিশু হসপিটাল, মাতুয়াইলে ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড অ্যান্ড মাদার হেল্থ, সাভারে সিআরপি, মহাখালীতে সোসাইটি ফর অ্যাসিসটেন্স হিয়ারিং ইমপেয়ারড চিলড্রেন, মিরপুর-১৪ এ বাংলাদেশ জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজ, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, অনুমোদিত বিশেষায়িত স্কুলেও অটিজমের পরিচর্যার বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক পরামর্শ দেওয়া হয়। শ্যামলীতে অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে প্রয়াস, লালমাটিয়ায় সোসাইটি ফর ওয়েলফেয়ার অব অটিস্টিক চিলড্রেন, মিরপুর কালশীতে অটিস্টিক চিলড্রেন’স ওয়েলফেলার ফাউন্ডেশন, উত্তরায় বিউটিফুল মাইন্ড, রমনায় স্কুল ফর ইন্টেলেকচুয়ালি ডিসঅ্যাবলড চিলড্রেন, পশ্চিম মালিবাগে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন, ধানমন্ডিতে স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেনসহ আরো কয়েকটি বিশেষ স্কুল পরিচালিত হচ্ছে।

পাঠ্য বইয়েও অটিজম সম্পর্কে সচেতনমূলক একটি পাঠ রয়েছে। শিশুর শারীরিক বা মানসিক বৃদ্ধি যেমনটা হওয়া উচিৎ ছিল তেমনটা হচ্ছে না, তাহলে দেরি না করে অটিস্টিক চাইল্ড হেল্প লাইন (০১৯৩১৪০৫৯৮৬) এ যোগাযোগ করলে জানিয়ে দেবে কোথায় যেতে হবে বা কি করতে হবে।

শিশুকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা যাদের আছে তাদের মধ্য থেকে মূলত অটিজমের রোগী চিহ্নিত হচ্ছে। এখনো বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে এ রোগ সম্পর্কে কোনো সচেতনতা সৃষ্টি হয় নি। অটিজমে আক্রান্ত শিশুকে প্রথম চিকিৎসাই হলো তার রোগ সনাক্ত করা। কোনো রকম ওষুধ দিয়ে অটিজমের শিশুকে সারিয়ে তোলা সম্ভব নয়। বরং তাকে বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এই শিক্ষা ছাড়া তার চিকিৎসার আর কোনো বিকল্প নেই। এই শিক্ষার মাধ্যমে তাকে স্বাধীনভাবে চলার উপযোগী করা সম্ভব। অথচ বর্তমানে ঢাকা ছাড়া বাংলাদেশের আর কোথাও এই অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্থা নেই।

অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন ডা. রওনক হাফিজ জানিয়েছেন, ভালো শিক্ষার মাধ্যমে অনেক অটিজম আক্রান্ত শিশু শেষ পর্যন্ত সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছেন। তাই অটিজম আক্রান্ত শিশুদের শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়া গেলে তারা সমাজের জন্য দায় হবে না বরং সম্পদ হয়ে উঠতে পারে।

ডা. রওনক হাফিজ মনে করেন, অটিজম এবং প্রতিভা একসাথে চলে বলে অনেকে মনে করেন।

অটিজম সমস্যার নিরসন ও প্রতিরোধে জাতীয় কৌশলপত্র প্রায় চূড়ান্ত বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা বলেন। তিনি বলেন, খুব শীঘ্রই অটিজম বিষয়ক একটি জাতীয় কৌশলপত্র চূড়ান্ত করা হবে। প্রস্তাবিত কৌশলপত্রের খসড়ার ৮০ শতাংশ কাজ হয়ে গেছে। ২০ শতাংশ কাজ বাকি আছে।

অটিস্টিক শিশুর প্রতিভা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার অধ্যাপক আবুল বারক আলভী বলেন, সাধারণের চোখে এরা স্বাভাবিক নয়। কিন্তু আর দশটা স্বাভাবিক বাচ্চার মতোই এদের পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা, সবকিছু খুঁটিয়ে দেখার প্রবণতা, আর কল্পনাশক্তি অসাধারণ। প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া প্রায় প্রতিটি ছবিই কিন্তু এ কথাই বলছে।

তিনি আরো বলেন, মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরা যা কল্পনা করে তা প্রকাশের ধরনটা ভিন্ন। যেহেতু সমাজ এখনো এদের স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না সেহেতু এরা নিজেরাই নিজেদের ভিতরে একটা আলাদা জগৎ তৈরি করে নেয়। তাই এদের সূর্যের রং হয় সবুজ, আর ছবির টিয়েপাখিটা সবুজের বদলে হয়ে যায় লাল।

পঞ্চাশটি শিশু-কিশোরের আঁকা ছবি নিয়ে এক চিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধনকালে তিনি এসব কথা বলেন। রাজধানীর দৃক গ্যালারিতে ২২ থেকে ২৮ জুন হয়ে গেল নানা রঙে, নানা ঢঙে আঁকা মনোরম সব ছবির প্রদর্শনী। কেউ এঁকেছে নদী-নৌকো, দুই ধারে কাশবন। কেউবা ফুলের ছবি, পাখির ছবি। আয়োজক প্রতিষ্ঠান ‘হ্যালো অ্যাসোসিয়েশন ফর নিওফাইট স্টুডেন্টস (হ্যান্স)’।

কথা হলো হ্যান্সের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য কায়েস আহমেদের সঙ্গে। বললেন, ‘আমাদের এক বন্ধুর ভাই ছিল অটিস্টিক। সমাজে তার অবস্থানটা খুব কাছ থেকে দেখেছি। দেখতাম সবাই, এমনকি নিকটাত্মীয় পর্যন্ত তাকে প্রতিবন্ধি বা পাগল হিসেবে বিবেচনা করত। সবার ধারণা, এরা আসলে কিছু পারে না। কিন্তু ওরাও যে নানামুখী সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারে, মূলত এটা মানুষের সামনে নিয়ে আসা এবং পাশাপাশি সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করার জন্য আমরা এ সংগঠনটি করার কথা ভাবি।

অনন্ত-দুরন্ত দুই যমজ ভাই। ওদের ভালো নাম ফারহান সাঈদ ও রায়ান সাঈদ। দুজনেই ছবি আঁকতে খুব ভালোবাসে। অনন্তর প্রিয় রং লাল আর দুরন্তর প্রিয় হলুদ ও সবুজ। বাকি সবকিছুতেই ওদের ভারি মিল! মাঝেমধ্যে অবশ্য দুজনের খুনসুটি লাগে, আবার নিমেষেই ভাবও হয়ে যায়। এছাড়া ওদের কম্পিউটারে গেম খেলতে ভালো লাগে, সিনেমা দেখতে ভালো লাগে, ভালো লাগে খেতে আর বেড়াতে। দু’জনের অনেক ভালো না লাগাও আছে। কেউ হয়তো জোর করে ওদের সঙ্গে মেশার চেষ্টা করল বা কথা বলতে চাইল-এটা ওদের একেবারেই ভালো লাগে না। কেউ আদর করলে বা হুট করে ছুঁয়ে দিলে খুব রেগে যায়। সবার সামনেই জোরে চেঁচিয়ে ওঠে। ওদের এই ভালো না লাগা আর রেগে যাওয়ার উপসর্গগুলো সাধারণত অটিজমের আওতায় পড়ে। সবে ১৪-এ পা দেওয়া অনন্ত-দুরন্ত দুই অটিস্টিক শিশু।

কথা হলো অনন্ত-দুরন্তর সঙ্গে। বলা ভালো, অনন্তর সঙ্গে। দুরন্ত তো কথাই বলবে না, অনন্তকে তবু বলে-কয়ে রাজি করানো গেল! কিন্তু সে শুধু কেমন আছো জিজ্ঞেস করেই আর কথা না বলার গোঁ ধরল। শেষে তাদের মা নাসরিন আহমেদকেই বলতে হলো বাকি কথা। বললেন, দেখলেন তো, এ রকমই করে ওরা। তবে একবার যদি বুঝতে পারে যে কেউ ওদের সঙ্গে খুব আন্তরিকভাবে মেশার চেষ্টা করছে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই তাকে আপন করে নেয়। সাড়ে পাঁচ বছর থেকেই ওদের এসব প্রবণতা স্পষ্ট হতে থাকে। একদম কথা বলত না। ইশারায় সবকিছু চাইত। প্রথমদিকে আমি ইশারাগুলো ধরতে পারতাম না। ওরা তো ভয়ংকর রেগে যেত। আমারও খুব কষ্ট হতো। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ওদের আচার-আচরণ নিয়ে নানা খারাপ কথা বলত। আমার খুব খারাপ লাগত, কিন্তু কিছুই কানে নিতাম না। সব সময় ওদের পাশে থেকেছি। ওদেরকে ওদের মতোই বড় হতে দিয়েছি।

অনন্ত-দুরন্ত পড়াশোনার বেলায়ও খুব লক্ষ্মী। ওরা পড়ছে ঢাকার স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেন স্কুলে। ছবি আঁকায় দুটো পুরস্কার পেয়েছে দুরন্ত। বিভিন্ন জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায়ও অংশ নিচ্ছে এরা।

১৩ বছর বয়সী আকিবের আঁকা মাছ আর জলপরির ছবি দেখতে দেখতেই কথা হলো মা শারমিন ইসলামের সঙ্গে। এবার আর আকিবকে পাওয়া গেল না। সে ঢাকার অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র। তার কাছ থেকেই জানলাম, আকিব বাউলের ছবি আঁকতে খুব পছন্দ করে, এ জন্য ওর প্রিয় রংও হলুদ।

উপদেষ্টা কায়েস বলছিলেন, ঢাকায় অটিস্টিক স্কুল আছে প্রায় ১০টি। আমরা সব স্কুল ঘুরে ঘুরে প্রায় ৭০টির মতো ছবি সংগ্রহ করেছি।

সৃষ্টিশীলতায় এগিয়ে চলছে এমএইচ স্কুল
এমএইচ স্কুল। মোজাম্মেল হক বুদ্ধি প্রতিবন্ধি শিশু কল্যাণ পরিষদের পরিচালিত একটি অটিজম শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ২০০৬ সালে বনানীর পিটারপ্যান স্কুলের একটি শ্রেণিকক্ষে এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। মাত্র চার জন শিক্ষার্থী ও তিন জন শিক্ষক নিয়ে এ স্কুলটি যাত্রা শুরু। ২০০৭ সালে রেজিস্ট্রেশন লাভ করে এ স্কুলটি। প্রাথমিক অবস্থায় অর্থায়নের সমস্যা থাকলেও এখন শিক্ষার্থীদের বেতন ও চিত্র প্রদর্শনীর আয় থেকে এ স্কুলটি চলছে।

শিক্ষার্থীরা নাচ, গান, ছবি আঁকাতে বেশ উৎসাহী। ২০১০ সোনার গাঁ-এ স্কুলের শিক্ষার্থী আহমেদ রুবাইয়াত ও ফারহান নাভিদ-এর আঁকা ছবি নিয়ে প্রদর্শনী হয়। ভবিষ্যতে সবার সহযোগিতা পেলে স্কুলটি বড় করা ও আবাসিক স্কুলে পরিণত করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন এ স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবলী আহমেদ।    

আমার সন্তান অটিস্টিক, এটা আমার লজ্জার নয়, ভালোবাসার   
রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আলী আমজাদ বাবুল। তার একমাত্র সন্তান মঈন আমজাদ কিশোর। অটিস্টিক শিশু।   মিরপুরের কল্যাণী-বাংলাদেশ প্রতিবন্ধি ফাউন্ডেশনের শিক্ষার্থী। তার বয়স ১৪ বছর। পড়ালেখায় সে মেধাবী। সৃষ্টিশীল বাবার সাথে কিশোর বাবার কাজে সহযোগিতা করে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় তারা হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে বাবার বন্ধুদের সাথে দেখা হয়। সে আন্তরিকভাবে কথা বলে তাদের সাথে। বাবার সব বন্ধুদের চেনে সে। কারোর নাম একবার শুনলে তার মনে থাকে সবসময়। বাবার বন্ধুরাও কিশোরকে ভালোবাসে। আদর করে।

আলী আমজাদ বাবুল বলেন, আমার সন্তান অটিস্টিক, এটা আমার লজ্জার নয়, ভালোবাসার।    

হাবীব ইমন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কবি, গণমাধ্যমকর্মী


বাংলাদেম সময়: ০০০৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মনোকথা এর সর্বশেষ