ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

মনোকথা

মানসিক রোগ নিয়ে যত ভুল ধারণা- পর্ব ১

ডা. পঞ্চানন আচার্য্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৪
মানসিক রোগ নিয়ে যত ভুল ধারণা- পর্ব ১

মানসিক রোগের চিকিৎসা এবং চিকিৎসক সম্পর্কে আমাদের মাঝে অনেক রকম ধারণা প্রচলিত আছে। কথা-বার্তায়, গল্পে-উপন্যাসে-চলচ্চিত্রে, এমনকি অন্য বিষয়ের চিকিৎসকদের লেখালেখিতেও এসবের প্রতিফলন ঘটে প্রায়ই।

এর কিছু কিছু বেশ মজাদার। আসুন আজ সেরকমই কিছু প্রচলিত ও জনপ্রিয় কিন্তু ভুল ধারণা সম্পর্কে জেনে নেই।


মানসিক রোগের চিকিৎসার কোনো দরকার নেই, প্রয়োজনে কাউন্সিলিং বা সাইকোথেরাপিই যথেষ্ট:
এটি একটি দীর্ঘদিনের প্রচলিত ধারণা। মজার বিষয় হচ্ছে, সাধারণ মানুষের মতো মাঝে মাঝে অনেক চিকিৎসককেও এমন ধারণা পোষণ করতে দেখা যায়। ফলে, বিভ্রান্তিটা অনেক সময় চরমে পৌঁছে।

সত্যিকার অর্থে, রোগ মাত্রেরই চিকিৎসা দরকার। কোনো একটা বিষয় বা সমস্যাকে যখন রোগ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়, তখন তার চিকিৎসা দরকার নেই এ রকম ধারণা অনেকটা বিপরীতার্থক এবং হাস্যকর।

তবে চিকিৎসার পদ্ধতিতে ভিন্নতা থাকতে পারে। কাউন্সিলিং বা সাইকোথেরাপিটাও মানসিক রোগের চিকিৎসার একটা অংশ। উদাহরণ হিসেবে ধরুন ‘বিষণ্নতা’র কথা। যেটা সম্পর্কে আমরা প্রায় সবাই কমবেশি, কিছু না কিছু জানি। কিন্তু মাত্রা বা গভীরতার ওপর বিষণ্নতার চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ভর করে।

কেউ শুধু আশ্বস্ত হলেই বা সাইকোথেরাপি নিলেই ভাল হয়ে যেতে পারে, আবার কারো ক্ষেত্রে প্রয়োজন হতে পারে দীর্ঘদিন ওষুধ সেবন। তাই, যথাযথ উপলব্ধি না থাকার কারণে, সাধারণ ধারণা বা অল্প অল্প জ্ঞান থেকে, মানসিক রোগের জন্য চিকিৎসার দরকার নেই বলা চলে না।

শুধু ভুল ধারণার জন্য বা ভুল জানার জন্যে রোগ নিয়ে একজন মানুষের আজীবন কষ্ট পাওয়াটা সত্যিই অনভিপ্রেত এবং দুঃখজনক।


মানসিক রোগের চিকিৎসা যে কেউ করতে পারে:
আমাদের আরেকটি ভুল ধারণা হলো, আমরা অনেকেই ভাবি মানসিক রোগের চিকিৎসা যে কেউ করতে পারে। বিষয়টিকে কিছুটা সচেতন সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে দেখা যাক।

এ শ্রেণির মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী বিভিন্ন ব্যক্তি সম্পর্কে জানেন, কিন্তু বুঝতে পারেন না কার ভ‍ূমিকা কি। যে কারণে তারা একজন কাউন্সিলর বা সাইকোথেরাপিস্টের কাজের সঙ্গে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাজের পার্থক্য বুঝতে পারেন না। ভাবেন সবার কাজ এক, তাই সবাই চিকিৎসা করতে পারেন।


চিকিৎসা করে লাভ নেই, মানসিক রোগ কখনই ভালো হয় না:
ধারণাটি যে সঠিক নয়, তা একটু ভালোভাবে চিন্তা করলেই বুঝতে পারা যায়। স্বাভাবিক ভাবেই, এমন কিছু মানসিক সমস্যা বা রোগ আছে, যেগুলো পুরোপুরি দূর করা সম্ভব নয়। অনেকটা হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস, হাঁপানি, সোরিয়াসিস, SLE, আরথ্রাইটিস এরকম অনেক রোগের মতো সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। শতভাগ নির্মূল সম্ভব নয়। তবে অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ থাকা সম্ভব।

আবার, রোগের সাথে সম্পর্কিত কিছু পূর্ব নিয়ামকেরও অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে, যাদের সমাধান না হলে রোগমুক্তির ক্ষেত্রে শতভাগ সফলতা পাওয়া যায় না। ধরুন, একজন নারী বিয়ে হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছেন তার শ্বশুরবাড়ির পরিবেশ মোটেই আন্তরিক না বরং প্রতিকূল মনোভাবাপন্ন। তার স্বামী আর্থিকভাবে দুর্বল, বাপের বাড়িতেও সাহায্য করার কেউ নেই। ফলে, তিনি না পারছেন শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে, আবার না পারছেন শ্বশুর বাড়ির পরিবেশ পাল্টাতে। সেক্ষেত্রে ওই নারী যদি বিষণ্নতায় আক্রান্ত হন, তবে তার এই অবস্থানের পরিবর্তন না করে, শুধু চিকিৎসার মাধ্যমে শতভাগ সফলতা অর্জন সম্ভব নাও হতে পারে।


চিকিৎসা করালে ভালোর চেয়ে খারাপ বেশি হয়:
এটিও একটি প্রচলিত ধারণা। যদি সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করে, সঠিক পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হয়, তাহলে খারাপ কিছু ঘটার কোনো সম্ভাবনাই নেই। আর যেকোনো ওষুধের ক্ষেত্রেই গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছেই।

তবে মানসিক রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধগুলোতে কিছুটা ঘুম ঘুম ভাব, অনেক সময় একটু অস্থিরতা জাতীয় লক্ষণ দেখা দেয়। যে কারণে সাধারণ মানুষ ধরে নেয়, ওষুধগুলো শরীরের কোথাও, বিশেষ করে মস্তিস্কে, কোনো একটা মারাত্মক খারাপ প্রভাব ফেলছে, তাই এমন ঘটছে। আসলে তা নয়, আর তাই এই রকম ধারণা করাটাও ঠিক নয়।   

মানসিক রোগের চিকিৎসা করাতে হলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়, বাড়িতে চিকিৎসা সম্ভব নয়: 


বিশেষ কিছু ক্ষেত্র বাদে মানসিক রোগের চিকিৎসা বর্তমানে বাড়িতে রেখেই করা হয়। হাসপাতালে ভর্তি করানোর কিছু সাধারণ কারণ হিসেবে বলা যায়, যখন রোগীকে বাড়িতে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, ঠিকমতো ওষুধ খাওয়ানো সম্ভব হয় না, রোগীর শারীরিক অবস্থা ভালো নয়, একটা আলাদা পরিবেশে রেখে চিকিৎসার (বিশেষত, সাইকোথেরাপির) দরকার হয়। তাই, ধারণাটি সম্পূর্ণ ঠিক নয়।


মানসিক রোগের চিকিৎসককে রোগীর সম্পূর্ণ জীবনকাহিনী অবশ্যই জানতে হবে:
সাধারণত একজন মনোরোগ চিকিৎসক চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগীর বলা কথার ওপরেই বেশি জোর দিয়ে থাকেন। সেহেতু, প্রায় সবাই মনে করেন, তার উচিত রোগীর সব কথা শোনা। তদুপরি, গল্প-উপন্যাসে-চলচ্চিত্রে দেখা যায়- রোগীর কথা দক্ষ গোয়েন্দার মতো শুনতে শুনতে পূর্বের কোনো ঘটনা থেকে চিকিৎসক বের করে ফেলেন রোগের মূল কারণ। তারপর তা সমাধান করেই সুস্থ করে দেন রোগীকে।

এই সব পড়ে বা দেখে মানুষের মনে এরকম ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়। মূলত, গল্পে বা উপন্যাসে যা লেখা হয় তার ভিত্তি হচ্ছে ‘ফ্রয়েডিয়ান সাইকোএনালাইসিস পদ্ধতি’, যেটা এখন আর সবক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় না।

যাই হোক, মনোরোগ চিকিৎসককে রোগীর অনেক কথাই শুনতে হয়, জানতে হয়, তবে অবশ্যই অপ্রয়োজনীয় কথা বাদ দিয়ে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে একজন চিকিৎসক জানেন, আপনার সমস্যার সাথে আপনার বলতে চাওয়া কোন কথাটা সম্পর্কিত, আর কোনটি অপ্রয়োজনীয়।

ধরা যাক, আপনি উদ্বিগ্নতা জনিত রোগে ভুগছেন, আর তাই বলতে চাচ্ছেন, কবে কোথায় কি ধরনের উদ্বিগ্নতায় ভুগেছিলেন, কখন কোন ঘটনাকে আপনি এর কারণ হিসেবে মনে করেন বা এরকম আরও অনেক কিছুই। কিন্তু, আপনার চিকিৎসকের কাছে শুধু কয়েকটা উদাহরণই যথেষ্ট- আপনি কি ধরনের উদ্বিগ্নতায় ভুগছেন তা বুঝতে। আর বুঝতে পারলেই তিনি আপনার চিকিৎসা পদ্ধতি কেমন হবে- তা সহজেই নির্ধারণ করতে পারবেন। অতএব, আপনার কথা তাকে শুনতেই হবে, কিন্তু আপনি যতটা মনে করছেন ততটা হয়ত না।



. চিকিৎসক কথার ওপর ভিত্তি করে ওষুধ দেন, কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন না। তাই, ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অন্তত, ব্রেইনের কিছু পরীক্ষা (CT scan, MRI) তো করা দরকার:
সাধারণভাবে চিন্তা করলে এরকম একটা ভাবনা মনে আসতেই পারে। কিন্তু, এটা কতোটুকু ঠিক?

আসলে, চিকিৎসাশাস্ত্র একটা বিজ্ঞান। এক্ষেত্রে একটা রোগ সনাক্ত করাকে বলতে পারেন একটা ছোটখাটো বৈজ্ঞানিক গবেষণাই। এখানে আছে সুনির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতি, কিছু নিয়ম। আর সেটা অনুসরণ করেই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেন চিকিৎসক। সেই পদ্ধতি অনুসরণ করে তেমন কোনো বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই মানসিক রোগ নির্ণয় করতে পারেন একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।

মনের অসুখ হতে হলে মস্তিস্কে কোনো সমস্যা হতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। সাধারণ মানুষ মনের রোগকে মাথার রোগ ভাবতেই অভ্যস্ত বলেই CT Scan, MRI এসব করার কথা ভাবেন। আসলে, এসব ছাড়াই অধিকাংশ সময়ে চিকিৎসা সম্ভব। তবে, প্রয়োজন হলে এসব করতেই হবে, যার সিদ্ধান্ত দেবেন আপনার চিকিৎসক।


প্রায়ই চিকিৎসক একগাদা ওষুধ দেন। এটা তো ভালো না: 
পৃথিবী জুড়েই বর্তমানে একাধিক ওষুধ লেখার বিপক্ষে সবাই সরব। মনোরোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নেই। তবে, রোগ জটিল হলে চিকিৎসার প্রাথমিক পর্যায়ে একাধিক ওষুধ লাগতেই পারে। আবার, হাসপাতালে (বিশেষত, যেখানে একই সাথে চিকিৎসা শিক্ষা দেওয়া হয়) সাধারণত কম ওষুধ দিয়ে চেষ্টা করা যায়, যেহেতু রোগীকে সার্বক্ষণিক নজরে রাখা যায়। পক্ষান্তরে, ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসার ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব নয় বলে, শুরুতে অনেক সময়ই একাধিক ওষুধ দিতে হয়।

তাছাড়া, আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগীর স্বজনরা ধৈর্য ধরতে পারেন না বলে অনেক চিকিৎসকই একাধিক ওষুধ দিয়ে দেন। তবে, বিনা প্রয়োজনে একাধিক ওষুধ লেখা (আদর্শগত কারণে) কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। এ ব্যাপারে আপনার ধৈর্য এবং যথাযথ সচেতনতাই হতে পারে অপ্রয়োজনীয় ওষুধের হাত থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়।

অতএব, সচেতন হউন। সুস্থ থাকুন, ভাল থাকুন। এমন আরও কিছু ধারণা নিয়ে আগামীতে আলোচনা করার ইচ্ছে রইল।

প্রিয় পাঠক, ‘মনোকথা’ আপনাদের পাতা। মনোরোগ নিয়ে যে কোনো মতামত ও আপনার সমস্যার কথা জানাতে পারেন আমাদের। আমরা পর্যায়ক্রমে অভিজ্ঞ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে আপনাদের প্রশ্নের জবাব জানিয়ে দেবো। আপনি চাইলে গোপন রাখা হবে আপনার নাম-পরিচয় এমনি কি ঠিকানাও।

আপনার সমস্যার কথা জানানোর সঙ্গে সমস্যার বিস্তারিত বিবরণ, আপনার নাম, বয়স, কোথায় থাকেন, পারিবারিক কাঠামো এবং এজন্য কোনো চিকিৎসা নিচ্ছেন কি না এ বিষয়ে বিস্তারিত আমাদের জানান। শুধুমাত্র সেক্ষেত্রেই আপনার সমস্যা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা জানানো সম্ভব হবে।

আপনার সমস্যা, মতামত বা পরামর্শ জানাতে আমাদের ই মেইল করুন[email protected]

ডা. পঞ্চানন আচার্য্য
এম ডি (সাইকিয়াট্রি) ফেইজ-এ রেসিডেন্ট, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ,  বি.এস.এম.এম.ইউ, ঢাকা

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মনোকথা এর সর্বশেষ