ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

মনোকথা

বয়স্কদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সমস্যা: প্রথম পর্ব

ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০১৩
বয়স্কদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সমস্যা: প্রথম পর্ব

পৃথিবী ছুটছে, আপন গতিতে, অন্ধের গতিতে। পথে প্রান্তরে উষ্ণ রক্ত আর গতির খেলা যেনো আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে গিলে খাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

কি দেশ, কি বিদেশ, কি উন্নত, কি অবনত, কোথাও এর ব্যতিক্রম নেই। গতি, গতি আর গতি। গতির প্রয়োজনে টগবগে সজীবতা, তারুণ্য দীপ্তি ছড়াচ্ছে প্রতিক্ষণে। কিন্তু এ টগবগে তারুণ্যেও ভাটা পড়ে একদিন।

বয়স, সময়ের সাথে সাথে ব্যক্তি মানুষের পরিবর্তনের একটি সাধারণ প্রক্রিয়া। জন্ম হতে যার শুরু এবং জীবনের সাথে বয়ে চলা যার স্বভাব। বেঁচে থাকলে বৃদ্ধ হতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। বয়স বাড়া একটি অতি সাধরণ পরিণতি, অত্যাবশ্যকীয় শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া।

তারুণ্যের জোয়ারে ভাটা পড়লে চির পরিচিত মানুষটিও তখন আমাদের কাছে বড়ো অচেনা হয়ে যায়। আমরা তখন আর তার মনটি দেখি না। দেখি বৃদ্ধ হয়ে আসা কিংবা নুইয়ে যাওয়া একটা শরীর। জবুথবু চামড়া, কুঁচকে যাওয়া চোখ, থেমে যাওয়া গতির মানুষটির মন কেমন, কে জানে? কে রাখে তার মনের খবর!!

যৌবন যেমন গতি দেয়, বার্ধক্য দেয় পূর্ণতা। মানুষ চাক বা না চাক বয়সের কূলে মাথা রাখতেই হবে। কিন্তু আজকের এই গতির ভিতর তার জায়গা কোথায়? পরিবারে, সমাজে, উপার্জনে, সিদ্ধান্তে কিংবা পলিসি মেকিংয়ে দ্রুত কি অবহেলার খাতায় নাম চলে আসছে আপাত গতিহীন এই মানুষগুলোর!

এবারের বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে সেই গুরুত্ব বোঝাতেই প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে ‘ওল্ড এইজ কনসেপ্ট’ নিয়ে। বয়স্কদের মনের উন্নতিকল্পে, কিংবা কেমন থাকবে তারা, কেমন রাখতে চাই তাদের। নিজেরা নিজেদের জন্য কি করতে পারবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে প্রতিপাদ্য নির্বাচন ও বিশ্ব পরিস্থিতি: ওল্ড এইজ কনসেপ্ট

পৃথিবীর বহু উন্নত দেশেই দেখা যায় মানুষ তার অবসরের অনেক পরেও কর্মক্ষম থাকেন। তারা নিজেদের কার্যক্ষেত্রে সচল রাখেন, বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্মসহ পারিবারিক জীবনে নিজেদের ভালোভাবেই ব্যস্ত রাখতে সমর্থ হন। এমনকি ৮০, ৯০ বছর বয়সেও অনেকে কর্মক্ষম থাকেন। সেই দিক বিবেচনা করে, অনেক দেশে ‘ওল্ড এইজ’ একটা কনসেপ্ট দাঁড় করিয়েছেন। অর্থাৎ তারা কি করবেন, কিভাবে করবেন, কিভাবে নিজেদের ভালো রাখবেন এসব নিয়ে।

এবারের প্রতিপাদ্য বিবেচনার যে বিষয়গুলো আলোচনায় এসেছে
১.    উন্নত স্বাস্থ্য সেবা ও জীবন চর্চার কারণে আনুপাতিক হারে বেড়ে যাওয়া বয়স্ক মানুষের সংখ্যা
২.    বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী ৬০ উর্ধ্ব বয়সের ব্যক্তির সংখ্যা ২০০০ সাল থেকে ২০৫০ সালে গিয়ে দ্বিগুণ হবে। (যা মোট জনসংখ্যার ১১% থেকে বেড়ে হবে ২২%)।
৩.    বয়োবৃদ্ধদের মাঝে ৮০ থেকে ৯০ বছর বয়সের মানুষের সংখ্যা বেশি হবে।
৪.    বয়স্ক নারীদের সংখ্যা বেশি হবে।
৫.    বয়স্ক মানুষের অন্যান্য শারীরিক সমস্যার কারণে মানসিক রোগ বা সমস্যা বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৬.    বয়স্কদের নেশা বিষয়টি অনেক সময় উপেক্ষিত থেকে যায়।
৭.    দিন দিন ডিমেনশিয়ার (স্মৃতিভ্রম রোগ) সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, অধিক বছর বেঁচে থাকার কারণে।

বিষয়টি খুব সাধারণ ভাবেই বোধগম্য যে, সারা পৃথিবীতেই মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাচ্ছে। অনেক বয়সেও মানুষ তাদের নিজেদের কর্মক্ষমতাও ধরে রাখছে। তাই গুরুত্ব দেওয়াটাই স্বাভাবিক।

আমাদের দেশে সাম্প্রতিক একটি সরকারি উদ্যোগেও বিষয়টি চলে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি করে ৬৫ বছর করা হয়েছে।

বয়স ও বাংলাদেশ পরিস্থিতি
বর্তমান অর্থাৎ ২০১২ সালের হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বা বয়সসীমা আশা করা হয়, ৭০.০৬ বছর।
-    ছেলেদের গড় বয়স ৬৮.২১ বছর।
-    মেয়েদের গড় বয়স ৭১.৯৮ বছর।

২০০৩ সালে যা ছিলো ৬১.৮০ বছর।

সুতরাং বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, এটা চোখ বন্ধ করেই বলা যায়।

মন ও মানসিক স্বাস্থ্য
‘মন’ কোথায় থাকে? যা দেখি সেতো একটা শরীর! তাহলে ‘মানুষ’ মানে কি শুধুই একটা শরীর! শরীরের ভালো-মন্দ, সুন্দর-অসুন্দর, সুস্থ-অসুস্থ এসব আমরা বুঝি। ‘মন’ দেখি না, তাই এর কিছুই বুঝি না! কিন্তু ‘মন’ যদি থাকে তাহলে নিশ্চয়ই তারও ভালো থাকা, খারাপ থাকা কিংবা সুবিধা, অসুবিধা, অসুখ বিশুখ সবই আছে! শরীরের যেমন আছে বা থাকে।

যদি মন না থাকে, তবে এসবের কোনো কিছুই নেই বা থাকার কথাও নয়! যদি মন থাকে, তবে এর সাথে সবইতো থাকতে হবে, ভালো লাগা, খারাপ লাগা, ভালো থাকা, খারাপ থাকা, সুস্থতা, অসুস্থতা। তখনই কিন্তু একটা দায়িত্ব আপনার কাঁধে চলে আসে- জেনে শুনে বুঝে- মনকে ভালো রাখা, সুস্থ রাখা, সুন্দর রাখা বা স্বাভাবিক রাখা।

আপনার ‘মন’, কখন সুস্থ কখন অসুস্থ, সব কিছুই আপনার নখদর্পণে থাকতে হবে। যেমন থাকে শরীরের ব্যাপারে।

‘মন’কে না জানা থাকলে, আপনার অজান্তেই দিনগুলো হয়ে যেতে পারে অসুন্দর, অস্বাভাবিক কিংবা অনর্থক। অনেকেই মনের অসুস্থতাকে বুঝে কিংবা না বুঝে লুকানোর চেষ্টা করি। আপনিও নিশ্চয়ই এটি করবেন না! আপনার দায়িত্ব হবে, আপনার মনের স্বাস্থ্যকে যথা সময়ে সঠিক ভাবে বুঝা এবং সেইমতো কাজ করা।

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস কেন?
World Federation for Mental Health, সংক্ষেপে WFMH, ১৯৯২ সালে সারা বিশ্বের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কার্যক্রম ও কর্মযজ্ঞকে একটি বিন্দুতে নিয়ে আসা এবং এ বিষয়ে বিশ্বের সব মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিশেষ এই দিবসটি পালন শুরু করে। প্রাথমিক ভাবে, পৃথিবীর সব দেশ, জাতি, গোষ্ঠী, সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং সব ধরনের সামাজিক অর্থনৈতিক মানুষের দৃষ্টি মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে আকর্ষণ করার উদ্দেশ্য হলেও সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য ছিলো, শারীরিক স্বাস্থ্যের একই কাঠামোতে মানসিক স্বাস্থ্যকে নিয়ে আসা এবং সেই মতো সর্বসাধারণের মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা।

এবার দিবসটি পালনের ২১ তম বছর। বিশ্বজুড়েই এজন্য বেশ কিছু বাড়তি কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে বিশ্বের অনেক দেশই, দিবসটি পালনের প্রথম থেকে এর সঙ্গে একাত্ততা প্রকাশ করে আসছে।

শুরুতে অর্থাৎ ১৯৯২ সালে, বিশ্বের ১২৭টি দেশে একই সঙ্গে একটি দুই ঘণ্টার লাইভ টেলিভিশন শো দিয়ে দিবসটি পালন করা হয়। একই ভাবে চলে আরো দু’বছর। পরবর্তীতে WFMH, অতিরিক্ত খরচ কমানোর জন্য এ পদ্ধতি পরিবর্তন করে এবং প্রতি বছরে একটি নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য ঠিক করে, সে অনুযায়ী বিভিন্ন শিক্ষাসূচি তৈরি করে তা সবার কাছে বিলি করার সিদ্ধান্ত নেয়। এবছরে অর্থাৎ ২১তম বছরটিতে, প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে, Mental Health and Older People  বয়স্ক মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে।


বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস: বাংলাদেশ
গত প্রায় বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে দিবসটি ভালো ভাবেই পালিত হয়ে আসছে। মানসিক বিষয় নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোতো অবশ্যই সেই সঙ্গে মিডিয়ারও ভূমিকা দেখা যাচ্ছে মানুষকে মানসিক রোগ বা স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করার জন্য।

একাডেমিক প্রতিষ্ঠান, যেখানে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ হয়। বঙ্গবন্ধু মেডিকের বিশ্ব বিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, মেন্টাল হেল্থ ইনস্টিটিউটসহ অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানই প্রতিপাদ্যকে ভিত্তি করে দিবসটি পালন করে থাকে।

দিবসের মূলে আছেন যারা
বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালনের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন রিচার্ড ডিক হানটার নামের একজন আইনজীবী। ১৯৯২ সালে যিনি World Federation for Mental Health -এর ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। WFMH-এর তত্ত্বাবধানে দিবসটি পালন করা শুরু হলেও, প্রথম থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই প্রজেক্টির কো-স্পনসর হিসেবে কাজ করে আসছিলেন। সে সময়ে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসকে একটি প্রজেক্ট হিসেবে শুরু করা হয়। প্রজেক্টির সহায়তায় কার্টার সেন্টারও এগিয়ে এসেছিলেন এবং তৎকালীন ফার্স্ট লেডি রোসালিন কার্টার (জিমি কার্টরের স্ত্রী) প্রজেক্টির অনারারি চেয়ারপারসন হবার সম্মতি প্রদান করেন।

পৃথিবীর প্রায় সব দেশই দিবসটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পালন করে থাকে। WFMH এর উদ্যোগের পাশাপাশি নিজ নিজ পদ্ধতিতেও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে অনেক দেশই কাজ করে যাচ্ছে।

ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব
সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১ , ২০১৩
এসএটি/এমজেডআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মনোকথা এর সর্বশেষ

welcome-ad
welcome-ad