‘লোকটি খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন’ কিংবা ‘লোকটি ব্যক্তিত্বহীন’ প্রাত্যহিক আলাপচারিতায় প্রশংসা বা নেতিবাচক দু’ অর্থে আমরা এসব কথার মুখোমুখি হই।
গঠন প্রক্রিয়ার দিক থেকে বাক্যগুলোতে কোনো ঝামেলা না থাকলেও মনোরোগবিদরা কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে ‘ব্যক্তিত্বহীন’ শব্দটির আদতেই কোনো অর্থ নেই বলে মনে করেন।
‘পারসোনা’ শব্দটির বিবর্তনে ‘পারসোনালিটি’ বা ‘ব্যক্তিত্ব’ কথাটির উদ্ভব। ল্যাটিন শব্দ ‘পারসোনা’র আভিধানিক অর্থ ‘মুখোশ’। প্রাচীনকালে মঞ্চ নাটকে ব্যক্তির চারিত্রিক রূপ ফুটিয়ে তোলার জন্য নানা ধরনের মুখোশ ব্যবহৃত হত। অর্থাৎ মানুষটির ভেতরের মানুষকে তার মুখোশের মাধ্যমেই প্রকাশ করার চেষ্টা করা হতো।
অতীতে গ্রিক দার্শনিক হিপোক্রেটিস এবং রোমান চিকিৎসক গ্যালেন প্রাকৃতিক চারটি উপাদান যেমন- মাটি, বায়ু, আগুন ও পানি’র সঙ্গে তুলনা করে মনমরা, আশাবাদী, বদরাগী, উদাসীন ব্যক্তিত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা তাদের নিজস্ব গবেষণা কেন্দ্রিক ব্যক্তিত্বের ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
ফ্রয়েড যেমন শৈশবের বেড়ে ওঠার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, শৈশবে বাবা মা বা অভিভাবকের সন্তানকে বড় করে তোলার ধরনের ওপর তার ব্যক্তিত্ব নির্ভর করে।
আবার কেউ কেউ ব্যক্তিত্বের ওপর পরিবেশের প্রভাবের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। আমরা যেমনটা বলে থাকি ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’। অর্থাৎ কারো ভালো আচরণ দেখে আমরাও নিজেদের উন্নত করতে পারি, আবার অবনতির শেষ প্রান্তেও পৌঁছুতে পারি।
তবে ‘আলেমের ঘরে জালেম’ হওয়ার দৃষ্টান্তও ভুরি ভুরি। আধুনিক এ সময়ের হিউম্যানিস্টিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী বলা হয়ে থাকে ‘প্রত্যেক মানুষই আসলে ভালো’। তার মাঝে থাকে অফুরন্ত সম্ভাবনা। জীবনের বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন অনুসঙ্গের ঘাটতি বা প্রাচুর্যের কারণে কেউ হন সাধু সন্ন্যাসী আর কেউ হন ধূর্ত শেয়াল কিংবা অপরাধ চক্রের গড ফাদার।
ব্যক্তির কতিপয় সুনির্দিষ্ট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাবলী যখন তার নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য সঙ্কটের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন মনোরোগবিদরা বিষয়টির দিকে মনোযোগী হন। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হয় ওই ব্যক্তির যুগপদ ভাবে কোনো শারীরিক বা মানসিক সমস্যা আছে কিনা।
কেননা, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অন্য কোনো রোগের উপসর্গ হিসেবে ব্যক্তিত্বের নানান সমস্যা প্রকাশিত হয়। মনোরগবিদ্যা ব্যক্তিত্বের সমস্যা বা PERSONALITY DISORDER কে ৩টি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন।
প্রথম শ্রেণির মধ্যে প্যারানয়েড, সিজোয়েড, সিজোটাইপাল পারসোনালিটি উল্লেখযোগ্য। এ শ্রেণির ব্যক্তিরা কারণ ছাড়াই অতিমাত্রায় সন্দেহ প্রবণ হন। কাউকে বিশ্বাস করতে না পারা, খুব তুচ্ছ সাধারণ বিষয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, অনুমান নির্ভর নেতিবাচক মূল্যায়ন, সবকিছুতে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া প্রভৃতি তাদের নিত্যনৈমিত্যিক আচরণ হয়ে দাঁড়ায়।
আবার অনেকে সামাজিক যোগাযোগের বিষয়ে বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন বা আগ্রহী থাকেন না। কারো প্রশংসা বা বিরক্তিতেও তার ভ্রুক্ষেপ নেই। বন্ধু বান্ধবহীন একাকিত্বই যেন তার একমাত্র সঙ্গী।
দ্বিতীয় শ্রেণির মধ্যে এন্টিসোশাল, বর্ডারলাইন, হিস্ট্রিয়নিক, নারসিসিসটিক পারসোনালিটি উল্লেখযোগ্য।
এক্ষত্রে বারবার সামাজিক নিয়ম ভাঙা, উশৃঙ্খল শাস্তিযোগ্য আচরণ, কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ, কারো সমালোচনা সহ্য করতে না পারা, সামাজিক সম্পর্কে স্থিতি না থাকা, শূন্যতা অনুভব করা, নিজের জন্য ক্ষতিকর আচরণে লিপ্ত হওয়া (হাত কাটা, আত্মহত্যা চেষ্টা, নেশা, যথেচ্ছ যৌনাচার), অতি নাটকীয়ভাবে (সবার দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্যে বাচনভঙ্গি, অঙ্গ সজ্জা, ভিত্তিহীনভাবে নিজেকে অন্যদের চাইতে শ্রেয়তর ভাবা) নিজেকে প্রকাশ করার প্রবণতা উল্লেখযোগ্য।
তৃতীয় শ্রেণির মধ্যে রয়েছে অ্যাভোয়ডেন্ট, ডিপেন্ডেন্ট, অবসেসিভ পারসোনালিটি। এদের মাঝে সবকিছুতেই পালানোর স্বভাব যেমন, সবার মাঝে বসে গল্প না করা, সমালোচনার ভয়ে নিজ থেকে কিছু না করা, অন্য কারো পরামর্শ বা সাহায্য ছাড়া কিছু করতে না পারা, সবকিছুতেই অতিমাত্রায় পারফেকশন খোঁজা, অতিমাত্রায় দৃঢ়তা বা নির্দিষ্ট ছক ছেড়ে বেরুতে না পারা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
এসব বৈশিষ্ট্য আমাদের প্রত্যকের মাঝেই যৌক্তিকভাবে কম বেশি থাকে। তবে কি আমরা সবাই পারসোনালিটি ডিজঅর্ডারে ভুগছি? উত্তর হচ্ছে ‘না’।
ব্যক্তিত্বের এসব শাখা-প্রশাখা যখন ধারাবাহিকভাবে ব্যক্তির স্বাভাবিক জীবন চলার পথ আগলে ধরে বাধার সৃষ্টি করে করে তখন বিষয়টা নিয়ে ভাবা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে মনোরোগবিদের সঙ্গে দেখা করা ও সুনির্দিষ্ট ধরন অনুযায়ী পথ্য, তথ্য কিংবা পরামর্শও জরুরি হয়ে পড়ে।
সনাতন ঢঙে কুমোরদের মাটির পাত্র বানানোর দৃশ্য সবাই দেখেছেন। ঘুর্ণায়মান লাজুক কাঁদা মাটির ছাঁচ হাতের আলতো ছোঁয়ায় নিমেষেই ফুলদানি! ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের সেই ছাঁচটিও আসলে জন্মগতভাবে প্রাপ্ত (জেনেটিক) প্রবণতাতেই মোড়ানো থাকে।
প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির স্বাভাবিক ব্যক্তিত্বের সুনির্দিষ্ট ধরন শৈশব থেকে বয়সন্ধি কালের পরিবারিক, সামাজিক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডের নানান অভিজ্ঞতার আলোকে গড়ে ওঠে। অনেকটা কুমোরের সেই শৈল্পিক হাতের ছোঁয়ার মতন। তাতে কেউ হন শান্ত সভ্য রবীন্দ্রনাথ, আর কেউ হন ক্ষ্যাপাটে নজরুল!
ডা. মো. সালেহ উদ্দীন
এম ডি, ফেইজ এ (সাইকিয়েট্রি)
ডিপার্ট মেন্ট অফ সাইকিয়েট্রি,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
বাংলাদেশ সময়: ১২২৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০১৩
এসএটি/এএ/জিসিপি