জীবনে চলার পথে প্রতিদিনই আমরা ভুল-শুদ্ধ, ঠিক-বেঠিক কিংবা ন্যায় অন্যায় ইত্যাদি নির্ধারণ করি যুক্তির আশ্রয়ে। আজ যাকে গগনবিদারী হুংকারে ‘মহান’ বলে দেবতার আসনে বসাই কয়েকদিন পরেই হয়ত তাকে আবার পাল্টা যুক্তির আশ্রয়ে ‘শঠ’ বলে টেনে-হিঁচড়ে নিচে নামাই।

কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট নিয়ে যেসব বিজ্ঞানী গবেষণা করেছেন তাদের মধ্যে জ্যা পিয়াজে (Jean Piaget), কোহেল বার্গ (Kohleberg) প্রমুখের অবদান অনস্বীকার্য। আর কগনিটিভ ডেভেলপমেন্টের একটি অংশ হলো নৈতিক বিকাশ বা Moral development।

সাত থেকে ১১ বছর বয়সেই মূলত শিশুরা যৌক্তিক চিন্তা-ভাবনা করতে শেখে। কোনো বিষয়ের কার্যকারণ সম্পর্কে বুঝতে শেখে। তারা বুঝতে শেখে নিয়ম মানেই অবধারিত বিষয় নয় বরং সামাজিক রীতি হিসেবেই এসব বিধি নিষেধের আরোপ।

এক্ষেত্রে ব্যক্তিত্ত্ব বা Personality সম্পর্কে ধারণা থাকাটা প্রাসঙ্গিক। বিজ্ঞানী ফ্রয়েড’র ব্যাখ্যা অনুযায়ী প্রতিটি ব্যক্তির ব্যক্তিত্ত্বের ছাঁচ গড়ে ওঠে ছোট বেলার অভিজ্ঞতার আলোকে। আর এই ‘ব্যক্তিত্ত্বের’ কেন্দ্রে থাকে ইড (id), তার চারপাশ ঘিরে থাকে ইগো (ego) আর সবার বাইরে মৌনভাবে বসে থাকে সুপার ইগো (super ego)। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিস্কার হবে। ধরা যাক তাজিন’র আজ স্কুলে যেতে মোটেই ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু সে ভাবছে স্কুলে না গেলে বার্ষিক পরীক্ষায় উপস্থিতির ঘাটতির কারণে সে পিছিয়ে পরবে। আর নিয়মিত স্কুলে যাওয়া তো প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীরই কর্তব্য। তাই শেষ পর্যন্ত তাজিন স্কুলে গেলো।

একজন নিম্নবিত্তের ক্রোধান্বিত হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করাটাই সহজাত প্রতিক্রিয়া, আবার অসাম্যকে যুক্তির মাধ্যমে চিহ্নিত করে বিনম্রভাবে উপস্থাপন করাটাই ভদ্রতা মনে করেন মধ্যবিত্ত সমাজ। নৈতিকতা বা সুপার ইগোর প্রশ্নে ব্যক্তির আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, ভৌগলিক সীমানাও প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
তবে শিশুর জীবনে বাবা মায়ের আচরণ অভিব্যক্তি, অভিরুচি এবং সহপাঠী বা খেলার সাথীদের সঙ্গে কথোপকথন, ভাব বিনিময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অসুস্থ না হয়েও প্রায়ই অসুস্থতার কথা বলে সামাজিক অনুষ্ঠানে বারবার যাওয়া থেকে বিরত থাকা দেখে সন্তানের মাঝে বিষয়টি প্রভাব ফেলতে পারে। হয়তো পরবর্তিতে সেও শিখে নেয় নিজস্ব উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মিথ্যা বলা একটা ভালো কৌশল এবং এতে সহজে উদ্দেশ্য সাধিত হয়।

সময় স্বল্পতার জন্য আজকাল সদুপদেশ দেওয়াটা অনেকটাই লোপ পেয়েছে আমাদের সমাজে। ‘গুরুজনে করো নতি’, ‘শিক্ষককে সম্মান করো’, ‘ছোটকে স্নেহ করো’, ‘দুর্জন বিদ্বান হইলেও পরিত্যাজ্য’, কিংবা ‘খলের ছলের অভাব হয়না’ ইত্যাদি আমরা সেই ছোটবেলায় পড়েছি। হয়তো নতুন করে সেগুলো রপ্ত করে সন্তানদের শেখানোর সময় এসেছে।
শিশুরা প্রথম দিকে শুধু অনুকরণ করে তার অনভিজ্ঞতার কারণে। তার দৃষ্টি বা শ্রবণ সীমাই তার পৃথিবী। ক্রমান্বয়ে সে ভাষা, ভঙ্গি, অভিব্যক্তি রপ্ত করে। বিধি নিষেধের বোধের ডালপালা ধীরে ধীরে প্রসারিত হয় তার ছোট্ট মনে। সে যুক্তির অস্তিত্ত্ব টের পায় একসময়। উৎসাহী অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে যুক্তির আঘাতে সীমানা প্রাচীর ভাঙার খেলায় মেতে ওঠে। সবুজ স্নায়ু কোষগুলোই তার হাত ধরে নিয়ম ভাঙ্গার পথ দেখায়। তাই মিথ্যুক, দুষ্টু , অবাধ্য বা বেয়াড়া বলে বেদম প্রহার বা গাল মন্দের আগে ভাবা উচিত ‘আমরা কি তাদের সঠিক পথ দেখাচ্ছি?’
ডা. মো. সালেহ উদ্দীন
এম ডি, ফেইজ এ (সাইকিয়েট্রি)
ডিপার্টমেন্ট অফ সাইকিয়েট্রি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১০০০ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৩
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর-[email protected]