ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

মনোকথা

বাড়ছে বয়স, অসুখী কি তাই!

সৃজনী আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৩ ঘণ্টা, জুলাই ২০, ২০১৩
বাড়ছে বয়স, অসুখী কি তাই!

‘সুখ তুমি কি?’ প্রশ্নটির উত্তর এক রকম অধরাই রয়ে গেছে। সুখ কি একটা সার্বজনীন সন্তুষ্টির বহিঃপ্রকাশ, নাকি জীবনে পরিতোষের অনুভূতি তা নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে।

তবে সুখ বলে যে একটা বিষয় আছে এবং তা যে সবারই কাম্য এবিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই।   সাধারণভাবে ভালো থাকার অনুভূতিকেই সুখ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

জীবনের সব পর্যায়ে সুখের বিস্তার এক রকম নয়। মানুষের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যেমন মানুষের বাহ্যিক কাঠামোর পরিবর্তন হয় তেমনি নানা বয়সে মানুষের সুখান‍ুভূতিরও তারতম্য দেখা দেয়। মনে করা হয় বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সুখের পরিমানও কমতে থাকে।   আর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সুখের অনুভূতির পরিবর্তন নিয়েও আছে নানা মত। প্রচলিত ভাবে একজন বয়স্ক মানুষকে আমরা খিটখিটে, রাগী এভাবেই চিত্রায়ন করি। বাচ্চার ক্ষেত্রে ছবিটা থাকে ভিন্ন- অল্পতেই হাসি-খুশি, লাফ-ঝাঁপে মত্ত। আবার কিশোর বয়স্কদের ক্ষেত্রে ও তাদের উচ্ছ্বলতা আর প্রাণবন্ততার ছবিটাই ঐ বয়েসের প্রতিনিধিত্ব করে। মধ্যবয়স্কদের ক্ষেত্রে জীবন যেন কিছুটা থিতিয়ে আসা ভাব থাকে।

তবে গবেষকরা দেখেছেন সুখের এবং বয়সের সম্পর্ক কতকটা ‘U ’ অক্ষরের মতো। শিশুকাল থেকে কৈশোর-তারুণ্য পার হয়ে মধ্যবয়সে আসতে আসতে সুখের পারদটা নিচের দিকে নেমে যেতে থাকে।

মধ্যবয়সে একটা সময় পার হয় যে সময়টা কে মনোবিদরা ‘Middle life crisis’  নামেই বর্ণনা করেন। ৪০ থেকে ৬০ বছর বয়সের এই সময়টাতে উপলব্ধিগুলোতে একটা পরিবর্তন আসে, নিজের গুরুজনদের হারানো, চাকরি এবং সামাজিক অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কমে যাওয়া বা পরিবর্তিত হওয়া, পরিবারে সন্তানদের তাদের নিজেদের জীবনের গণ্ডিতে প্রবেশ এবং ফলস্বরূপ তাদের সাথে আপাত দূরত্ব তৈরি হওয়া- সব মিলিয়ে এই সময়টাতে তাই অনেকে জীবনের পাওয়া ‍না পাওয়ার হিসেব কষতে বসেন। অনেকের কাছেই  ‘জীবনের অর্ধেকটা শেষ হয়ে গেল-কি পেলাম কি পেলাম না’ এই হিসেবই প্রতিদিনের যাপিত জীবনকে অস্থির করে তোলো। এর পাশাপাশি মনে স্থান করে নেয়, জীবনে না পাওয়া জিনিসগুলোর জন্য দুঃখ-বোধ। মৃত্যু চিন্তাও তীব্রতর হয় এসময়ই। এমনকি তীব্র হতাশায়ও আক্রান্ত হন অনেকে। খুব  সহজেই এ সময়টাতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন বিষণ্নতায়।

প্রখ্যাত মনোবিদ Erik Erikson মধ্যবয়সের দুইটি ফলাফল বর্ণনা করেছেন তাঁর ‘Theory of personality’ মতবাদে। তা হল নতুনভাবে কর্মোদ্যম অথবা স্থবিরতা।

এরপর আসে বৃদ্ধ বয়স। এই বয়সে জীবনীশক্তি কমে আসলে ও সুখের সংজ্ঞাটা অনেকখানি পরিবর্তিত হয়ে আসে। তরুণ বয়সে যে কাজগুলোকে অলসতা বা নিতান্ত অর্থহীন মনে হতো তাই হয়ে ওঠে সুখের উপাদান। অর্থাৎ সুখের রেখাটা ওপরের দিকে ওঠে।

এক্ষেত্রে একটা ব্যাপার লক্ষণীয় যে সুখের মাত্রা নয় বরং বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সুখের বোধটাতেই উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তনটা ঘটে। The Atlantic পত্রিকাতে প্রকাশিত মনোবিদ Heidi Grant Halvorson এর একটি নিবন্ধনে সমীক্ষার ফলাফল থেকে দেখানো হয়েছে বয়সের সাথে সাথে সুখের অনুভূতিতেও পরিবর্তন ঘটে।

তবে বয়সের কোন পর্যায়ে এই পরিবর্তনগুলো ঘটে সেটা নিয়ে মতভেদ রয়েছে, যেমন David Blanchflower, Professor of Economics at Dartmouth College ৭২টি দেশের ওপর গবেষণায় দেখেছেন যে, ইউক্রেইনিয়ানরা তাদের জীবনে সবচেয়ে খারাপ সময় হিসেবে ধরেন ৬২ বছর বয়সকে। আবার সুইডেনে এই সময়টা হচ্ছে ৩৫ বছর। তবে বেশিরভাগ দেশে জীবনের সবচেয়ে অসুখী সময় হিসেবে ৪০ থেকে ৫০ বছর সময়কে ধরা হয়।

বয়সের সাথে সুখের মাত্রার এবং সুখের সংজ্ঞার এই পরিবর্তন শুধু মানুষ নয় দেখা গেছে বনমানুষের মধ্যেও। University of Warwick এ Professor Andrew Oswald তার দলসহ ৫০৮টি বনমানুষের ওপর গবেষণা চালিয়ে তাদের লালনকারীদের থেকে প্রাপ্ত উপাত্তে উপরিউক্ত ফলটি পেয়েছেন।

গবেষকদের মতে ফ্রন্টাল লোব নামক মস্তিষ্কের অংশটি এই পরিবর্তনের জন্য দায়ী।   সামাজিক মনোবিদদের মতে তরুণ বয়সে Promotional motivation অর্থ্যাৎ প্রাপ্তির এবং উন্নতির প্রতি ঝোঁক এবং বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে Prevention motivation অর্থ্যাৎ মসৃন পরিচালনা এবং ক্ষতি এড়ানোর দিকে ঝোঁক এই পরিবর্তনটা সুখের এ রূপ রূপরেখার পিছনে ভূমিকা রাখে।

শিক্ষা, আয় এবং বৈবাহিক অবস্থার ভিন্নতার ক্ষেত্রেও এই ‘U’ আকারটি সুখের মাত্রা আর বয়সের পরিবর্তনের সম্পর্কের রূপরেখাটি বজায় থাকে।

আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে গবেষণাটির যথেষ্ট মূল্য রয়েছে। মধ্যবয়সের সময়টাতে সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে সহযোগিতা এবং সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে আমরা এই সময়টায় তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পারি। বৃদ্ধ বয়সে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়, এই বয়সে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকাটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, কেননা মানসিক ভাবে সুস্থ থাকলে শারীরিক অবস্থার উন্নতি এবং উন্নতির চেষ্টা দুইটাই বজায় থাকে। আর আমাদের দেশে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় থাকায় আমরা পরিবারের মধ্যেই তাদের আনন্দের বা সুখের উপাদানগুলো নিশ্চিত করতে পারি।

যেমন ছোট্ট নাতি-নাতনি যখন প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিন বা পরীক্ষার আগে দাদা-দাদি বা নানা-নানিকে সালাম করে বা অন্তত গলা জড়িয়ে আহ্লাদ করে, তখন পাওয়া আনন্দটুকু তাদের অনেকখানি সজীব করে তোলে।

এছাড়া এ বয়সে যেহেতু তাদের মনে অনেক পুরোনো স্মৃতি ভর করে সেহেতু তাদের কাছে গিয়ে একটু বসে তাদের শৈশব-কৈশরের গল্প শুনতে চাওয়া বা তাদের একটু সময় দেওয়াটাও অনেক জরুরি। এতে  তাদের মন অনেক হালকা হয়ে যায়। মোটকথা তাদের বোঝানো যে তারা আমাদের বোঝা নন বরং আমাদের মাথার ওপর তাদের ছায়া থাকাটা জরুরি।

আর কেউ যদি এই  সময়টাতে কোনো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হন, যেমন- বিষণ্নতা তখন আমরা সেই লক্ষণগুলো পৃথকও করতে পারবো যদি বয়স বৃদ্ধির সাথে মানসিক পরিবর্তনের এই ধারাটি আমরা মনে রাখি।

সৃজনী আহমেদ
এম ডি, ফেজ এ, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বি এস এম এম ইউ
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, জুলাই ২০, ২০১৩
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মনোকথা এর সর্বশেষ