ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মনোকথা

দুর্যোগ ও মানুষ: সামাজিক জীবনে প্রভাব

ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৭ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০১৩
দুর্যোগ ও মানুষ: সামাজিক জীবনে প্রভাব

দুর্যোগের পর শুধু ব্যক্তি জীবনেই নয়, বরং তার সামাজিক, পারিবারিক এমন কি অর্থনৈতিক জীবনেও নিয়ে আসে হাজার রকমের পরিণতি। সরাসরি শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি ছাড়াও অনেক সময় সেই ব্যক্তিটিকেই থাকার জায়গা, চাকরি, পরিচিত পরিবেশ, সামাজিক বন্ধনসহ নানা ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়।

সব মিলিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিটিকে ভেতরে ও বাইরের আমূল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যার ধাক্কা লাগে মানুষটির প্রায় প্রতিটি স্তরে ও বিভাগে।

যেভাবে সমস্যাগুলি ঘটে থাকে
3201
দেখা যায় দুর্ঘটনা ঘটার পরপরই বিভিন্ন সাহায্যকারী সংস্থা, সামাজিক সংগঠন, সরকারি বা বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, সেই সঙ্গে মিডিয়া, আগ্রহী মানুষের ভিড়, এমন কি সাহায্যপ্রার্থী হিসেবে ভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন এসে সেখানে জায়গা করে নেয়। খুব স্বাভাবিক কারণেই সেখানে তখন সেই গোষ্ঠী বা আক্রান্ত এলাকার মানুষের ভেতর চালু থাকা নিজস্ব নিয়ম পদ্ধতি বা রীতিনীতি কিছুই বজায় থাকে না। আক্রান্ত গোষ্ঠী তার নিজস্ব প্রথা, গতিবিধি ও চরিত্র হারিয়ে ফেলে। মানুষগুলো স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে এক অন্য জীবনাচরণের ভেতর ঢুকে যায়। পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিনের অভ্যস্ত জীবনের বাইরে, প্রতিদিন প্রতিক্ষণে নতুন নতুন মানসিক চাপের সম্মুখীন হতে হয় সে ব্যক্তিটিকে।

যদিওবা কোথাও কোথাও নিজস্ব সামাজিক গঠন ঠিক থাকে, কিন্তু অনেক সময়ই মানুষগুলোর নিজেদের ভেতর যোগাযোগের ধরন পরিবর্তন বা ক্ষতি হওয়ার কারণে কিংবা পারিবারিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে জীবন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

আমার জানি, স্বাভাবিকভাবেই মানুষ তার বিপদে আপদে কার কাছে যাবে, কোথায় যাবে, কোথায় সাহায্য পাবে, কিভাবে পাবে, কি করবে এসব একটা নির্দিষ্ট নিয়মের ভেতর নিজের অজান্তেই চলে আসে। যেসবই আসলে সামাজিক জীবনের মূল ভিত্তি।
42014201
হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা বা দুর্যোগ এমন নিয়মের কাঠামোকে একেবারে তছনছ করে দেয়। পরষ্পরের ভেতর যোগাযোগ মারত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই সমান্য বিপদেই হাপিয়ে ওঠে মানুষ। অনেক সময়ই ঠিক করতে পারে না কি করা উচিৎ বা কিভাবে করা উচিৎ।

কাছের মানুষ যার সঙ্গে সুখ দুঃক্ষের আলাপ বা সহযোগী হিসেবে সব সময় পাওয়া যেতো, এমন মানুষের মৃত্যু বা শারীরিক আঘাত ব্যাক্তিকে আরো অসহায় করে তোলে। যার সব হিসেবই শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তি জীবেন প্রভাব ফেলে।

সাধারণত যেসব অসুবিধা হয়ে থাকে

দুর্যোগ-উত্তর প্রভাব পরিবার, প্রতিবেশী, গোষ্ঠী বা সামাজিক জীবনে বিভিন্নভাবে পড়তে পারে। যাতে করে-
-    পরিবারের নিজস্ব গতি, নিয়ম বা কর্মপদ্ধতি নষ্ট হয়ে যায়।

-    একজনের মৃত্যু বা পঙ্গুত্ব অন্য সদস্যকে প্রভাবিত করে। তা কাজের পরিবেশগত দিকই হোক কিংবা নির্ভরশীলতাই হোক।

-    সমাজ বর্হিভূত লোকের আনাগোনা, শিশু প্রতিপালনের নিজস্ব পদ্ধতি এবং নারী-পুরুষের চলতি গঠন নীতি পরিষ্কারভাবে ব্যহত করে। এতে অগোছালো একটি পরিবেশ তৈরি হতে পারে।

-    অনেক সময় দেখা যায়, দুর্যোগ ঘটার সপ্তাহে পারিবারিক বা বিবাহিত জীবনের কলহ ও চাপ বেড়ে যায়। যে সমস্ত কলহ থেকে পরবর্তী মাসের ভেতর ডিভোর্সের সম্ভাবনাও বেশি দাঁড়ায়।
2013
-    বাবা-মা ছেলে-মেয়েদের ভেতর নিজস্ব ভুল বোঝাবুঝি আরো বাড়তে থাকে।

-    পারিবারিক সহিংসতাও বাড়তে থাকে। যেমন শিশু নির্যাতন বা স্বামী স্ত্রীর ভেতর বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা আরো তীব্র হয়।

-    অনেক সময় দুর্যোগের কারণে সামাজিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যাতে করে সামাজিক জীবনে কুপ্রভাবের পরিধি আরো বাড়তে থাকে। স্কুল কলেজ, মসজিদ, উপাসনার স্থান ধ্বংস হওয়া। এমনকি সেসব প্রতিষ্ঠান যাদের দায়িত্বে সরাসরি পরিচালিত হয়, যেমন শিক্ষকসহ সরাসরি যারা প্রতিষ্ঠানের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের ক্ষতিও কিন্তু এক ধরনের বিপদ ডেকে আনে ও পরিবেশের ওপর নতুন চাপ তৈরি করে।

-    ভেঙে যাওয়া সামাজিক রীতির সুযোগ নিয়ে অনেক সময় পরিচিত ও নিয়ন্ত্রিত প্রতারক গোষ্ঠী বা দুষ্কৃতিকারীরা তাদের কার্যক্রম বাড়িয়ে দেয়।

-    বিভিন্ন গবেষণা বা জড়িপে দেখা গেছে, দুর্যোগ পরবর্তী সপ্তাহ থেকে, আক্রান্ত গোষ্ঠীর ভেতর বিভিন্ন সন্ত্রাস, উত্তেজনা, নেশা, বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন, এমনকি আইনসিদ্ধ জেল জরিমানাও বেড়ে যায়।

-    আক্রান্ত সমাজটির নিজস্ব এবং প্রথাগত আনন্দ প্রকাশ, কাজ, বিনোদন, শিশুদের ভেতর উদ্দিপনাসহ বিভিন্ন প্রথাগত কার্যক্রম থেমে যায়। স্থবিরতা আসে প্রায় সবধরনের আনন্দদায়ক কাজের ভেতর। মানুষ যেন স্থির ও জড়সড় হয়ে যায়।
6201
-    কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষতির বিষয়টি হয়ে থাকে সাময়িক, কোনো ক্ষেত্রে আবার স্থায়ী। দুক্ষেত্রেই এর প্রভাব ভিন্ন ভিন্ন। চাকরি বা নিজের উপার্যনের একমাত্র অবলম্বনও অনেক সময় শেষ হয়ে যায়। সেসব ক্ষেত্রে অসহায়ত্ব প্রায় স্থায়ী রূপও নিতে পারে।

-    অনেকে তার নিজস্ব অর্থনৈতিক বা সামাজিক পরিচয় নিয়েও শঙ্কিত হয়ে যান। যা তার বা সেই মানুসটির জন্য তীব্র কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

-    সামাজে চলতে থাকা নিজস্ব পদ্ধতি বা লিডারশিপ পরিবর্তিত হতে পারে যা নতুন করেও সমস্যা তৈরি করতে পারে। যেমন, সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানের পদ্ধতিই দুর্যোগ পরবর্তী কার্যক্রমের ক্ষেত্রে পযোজ্য হতে পারে, যা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সামাজিক নিয়ম বা নেতৃত্বকে পরিবর্তিত করতে পারে। নতুন নেতৃত্ব তৈরি হতে পারে, যা একধরনের অন্তর্গত সমস্যা তৈরি করতে পারে।

-    বিভিন্ন সাহায্যকারী সংস্থার ওপর নির্ভরতা এক ধরনের শিথিলতা আনতে পারে পরবর্তী পেশাগত জীবনেও। এখানে বিষয়টি শুধুমাত্র মানসিক ডিপেন্ডেন্সিই নয়, অন্য একটি টেকনিকের সমস্যাও তৈরি হয়। যেমন, আক্রান্তা এলাকায় উৎপাদন পদ্ধতি ধ্বংস হবার কারণেও সেটি হতে পারে। এছাড়া দেখা যায় সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠানের দেওয়া বিভিন্ন খাদ্য সামাগ্রীর সঙ্গে পরবর্তীতে নিজস্ব উৎপাদিত খাদ্যের একধরনের তুলনা তৈরি হয়, সেটা মূল্য কিংবা মান সবক্ষেত্রেই। সেখান থেকেও কাজের চাহিদা ও পরিধি কমে আসতে দেখা গেছে।
72013
-    ঐ নির্দিষ্ট কমিউনিটিতে ঘটে থাকা পূর্ববর্তী কোনো দুর্যোগের অভিজ্ঞতাও অনেক সময় ফিরে আসতে পারে। তাই সমান্য সমস্যাও তীব্র আকার নিতে পারে। আবার অনেকসময় এর বিপরীতটিও ঘটে। অর্থাৎ বিষয়গুলিতে একধরনের অভ্যস্ততা তৈরি হওয়া।

-    বারবার আক্রান্ত কমিউনিটির বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই দুর্যোগ নিয়ে নিজস্ব মিথ ও প্রথা, বিশ্বাস আচরণ তৈরি হতে দেখা যায়। আমাদের উপকূলীয় এলাকায় এমন অনেক বিশ্বাসও প্রথা প্রচলিত আছে।

-    অনেক সময় প্রথাগত বিশ্বাস ভঙ্গের কারণে নতুন নতুন অস্বস্তি ও চাপের উৎস তৈরি হতে পারে। সাধারণত সাহায্যকারী মানুষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যখন নিজস্ব বিশ্বাসের সঙ্গে কনফ্লিক্ট করে তখনই সেটা হতে দেখা যায়।

ব্যক্তি, সমাজ কিংবা পরিবার, পতিটি প্রতিষ্ঠানই একে অন্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। কোনটিকে বাদ দিয়ে কোনটির কথা ভাবা যায় না। সমস্যা যখন আসে তখন এ তিন দিক থেকেই আসে। সমাধানের ক্ষেত্রেও তাই তিনটি দিকই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সবকিছুই কিন্তু শেষ পর্যন্তু ব্যক্তি মানুষটির মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়।

পরবর্তী সংখ্যায় থাকবে দুর্যোগে বিশেষ শ্রেণির ওপর প্রভাব
    
ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব
সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১২১০ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০১৩
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মনোকথা এর সর্বশেষ