ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

মনোকথা

দুর্যোগ ও মানুষ: বিজ্ঞান ভিত্তিক বিশ্লেষণ

ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৫ ঘণ্টা, মে ১৪, ২০১৩
দুর্যোগ ও মানুষ: বিজ্ঞান ভিত্তিক বিশ্লেষণ

প্রতিনিয়ত ঘটে যায় নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা। ঘটনার আকস্মিকতায় হত-বিহ্বল হয়ে যায় মানুষ।

কখনোবা আক্রান্ত হয় মানসিক জটিলতায়ও। কখনো তাৎক্ষণিক ভাবে আবার কখনোবা মনের অবচেতনে থেকে যাওয়া দুর্ঘটনার রেশ থেকে দীর্ঘদিন পর। যা-ই হোক বা যখনই হোক তা যেমন আক্রান্ত ব্যক্তিটির সমস্যা তেমনি তা তার চারপাশের মানুষেরও ভোগান্তির কারণ।

দুর্ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া
এমন কোনো ঘটনা, যা দেখে বা যার বর্ণনা শুনে কিংবা যার ভেতর দিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের মনে প্রচণ্ড ভয় ধরিয়ে দেয়, অন্যভাবে বলতে গেলে, যে ঘটনা আমাদের মৃত্যু থেকে বাঁচিয়ে দেয় বা শরীরের কোনো অংশের জন্য ক্ষতিকর হয় বা হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়, এমন ঘটনার সরাসরি ভুক্তভোগী বা পর্যবেক্ষণকারীদের মাঝে অনেকসময় মানসিক প্রতিক্রিয়া হয় বা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

এমন ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে অথবা শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে সাধারণত বুক ধরফর করতে শুরু করে, মুখ শুকিয়ে আসে, সমস্ত শরীর টান টান উত্তেজনায় শক্ত হয়ে আসে, উদ্বিগ্নতায় তটস্থ হয়ে আসে মন, ভয়ে কুঁচকে আসে শরীর, বুকের ও পেটের ভেতর এক ধরনের অদ্ভুত শিহরণ তৈরি হয়।

অনেক সময় ঘটনার আকস্মিকতা ও ভয়াবহতা অনুভব করতে না পারার কারণে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া না হয়ে একটু দেরিতেও শুরু হতে পারে। আকস্মিত এমন ঘটনা সাধারণত মনের ভেতর বসে যায় এবং মন থেকে কোনোভাবেই সরতে চায় না।

তবে এক্ষেত্রে একটা কথা মনে রাখতে হবে তা হল, এসব ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া কমে আসার পর অনেক সময় দেখা যায় দূরবর্তী প্রতিক্রিয়া বা সমস্যা। অনেক মানুষ তার নিজের ওপর বিশ্বাস ও ভরসা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলতে পারেন।
savar-rubal2-12
মানুষ স্বভাবগত ভাবেই নিজের পৃথিবীকে শান্তিপূর্ণ ভাবতে চায়। জীবনের অর্থকে পরিপূর্ণ করে তুলতে চায়। জীবনের নীল-সাদা স্বপ্নকে স্পর্শ করতে চায়। শেষ পর্যন্ত জীবনের অর্থকে ব্যর্থ ভাবতে চায় না কেউই। অথচ জীবনের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এমন সব ঘটনা অনেক সময় মানুষের এসব বিশ্বাসকে নাড়িয়ে দিতে পারে। নিজেকে অসহায় ও আশাহীন মনে হতে পারে। সাধারণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও হয়ত তখন লোপ পেতে পারে। অনেক বড় হয়ে আসতে থাকে মনের ক্ষত, যখন মনে হয় ‘আমি বেঁচে আছি অথচ, আমার কাছের এতোগুলো মানুষ আর জীবিত নেই’। নিজের বেঁচে থাকার বিষয়টিকে তখন অপরাধের মতো মনে হতে পারে। আর যাদের খুব কাছের মানুষ মারা যায়, তাদের ক্ষেত্রেতো কথাই নেই।

মানুষের মৃত্যুতো অবশ্যই, অনেকের জন্য ঘরবাড়ি, মূল্যবান ডকুমেন্ট যা আর কখনোই কালেক্ট করা সম্ভব নয় এমন সব জিনিস, আশপাশের অনেক স্মৃতি জড়িত জায়গা, স্থান বা বিষয়াবলী যেকোনো বিষয়ই বিশাল কষ্টের পাহাড়ের মতে এসে সামনে দাঁড়াতে পারে। এর এসব বিষয় থেকে দেখা দিতে পারে মানসিক জটিলতা। অনেকসময় তা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে পারে।

সপ্তাহ খানেক পর
সাধারণত ঘটনার সপ্তাহ খানেক পর থেকেই আবেগ জনিত সমস্যাগুলির তীব্রতা বাড়তে থাকে। মনের ভেতর প্রতিনিয়ত যুদ্ধ চলতেই থাকে। আশপাশের মানুষের জন্য শোক, বিষণ্নতার তীব্রতর অনুভূতিগুলি অস্থির করে তোলে। অস্থিরতা-উদ্বিগ্নতা, বিভিন্ন ধরনের অনুশোচনা মনের ভিতর স্থায়ী আসন পেতে বসতে চায়। অনেকে মেজাজ ধরে রাখতে পারেন না, যখন-তখন রেগে যায়, সন্দেহ পরায়ন হয়ে ওঠেন। এমনকি অনেককে আক্রমনাত্মক হয়ে উঠতেও দেখা যায়। সাভারে রানা প্লাজা দসের পর এর ভেতরে দু-তিনদিন আটকা পড়ে থাকা অনেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে এমন আচরণ দেখা গেছে। উদ্ধারকারীরা তাদের কাছে গেলে তাদের উদ্ধারকর্মীদের দিকে তেড়ে আসতে দেখা গেছে।

তবে এ ক্ষেত্রে ঘুমের সমস্যা, খাওয়া দাওয়ার সমস্যা, ঘুমের ভিতর দুঃস্বপ্ন দেখা এসম ছাড়াও সবচেয়ে বড় কষ্ট হলো ঘটনাটি আবার ঘটছে তেমন অনুভূতি বারবার ফিরে আসা।

সাভারের ঘটনার পরও হাসপাতালে ভর্তি হওয়া অনেককেই চিৎকার করতে বলতে শোনা গেছে- ‘আপনারা সরে যান, সরে যান। বির্ল্ডি ভেঙে পরছে’। শিশুদের মতো অনেকে আবার কেঁদেও উঠেছেন।

যদিও বলা হয়, মানুষের আবেগ, আচরণ, চিন্তা এসবের অনেক কিছুই জায়গা বা সংস্কৃতি-অর্থনীতি, শিক্ষাসহ অনেক বিষয়ের ওপর নিভর করে। তারপরও দেখা গেছে দুর্যোগের পর মানুষের আচরণ, মানসিক প্রতিক্রিয়া সারা পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই প্রায় একই রকম।

যারা ভুক্তভোগী হতে পারেন
শুধু এমন নয় যে, যারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত তারাই ভুক্তভোগী হবেন। এখানে বিষয়গুলো দু’ভাবে ঘটে। এক. যারা সরাসরি আক্রান্ত হন তারা। যাদের বলা হয় ‘প্রাইমারি ভিকটিম’ বা ‘প্রাইমারি সারভাইভর’। দুই. যারা তাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হন তারা। যাদের ‘সেকেন্ডারি ভিকটিম’ বা ‘সেকেন্ডারি সারভাইভর’ বলা হয়।

পরিবারের নির্ভর করা সদস্যটি, যিনি হয়তো প্রাইমারি ভিকটিমের ইনকামের ওপর নির্ভর করেই চলতেন। প্রত্যক্ষ দর্শনকারী, উদ্ধারকর্মী কিংবা রিলিফ দানকারী অনেকের ভেতরও এমন সব মানসিক প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে। এমন আবেগের বহিঃপ্রকাশ আমরা সাভার ট্র্যাজেডিতে দেখেছি। এমনি ভয়বহতাকে অনুভব করতে পারে এমন সব ভিডিও বা জার্নাল দেখা বা পড়ার পরও কেউ কেউ সেকেন্ডারি ভিকটিম হতে পারেন।
Savar-Harun-2201
মেডিকেল, এমনকি মানসিক স্বাস্থ্য কর্মী যারা ‘প্রাইমারি ভিকটিম’ কিংবা ‘সেকেন্ডারি ভিকটিম’র সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করছেন তাদেরও বিভিন্ন মানসিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে যারা কাজ করেন তারা, সাংবাদিক, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মী, মানবাধিকার কর্মীসহ যারাই এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেন তাদের যে কেউ মানসিকভাবে ট্রমার শিকার হতে পারেন।

দূরবর্তী মানসিক প্রতিক্রিয়া বা সমস্যা
দুর্যোগের মানসিক প্রতিক্রিয়া বর্ণনার জন্য ‘দ্বিতীয় দুর্যোগ’ বলতে একটা কথা আছে। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘সেকেন্ড ডিজাস্টার’। মানুষের প্রাথমিক মানসিক সমস্যাগুলি দুর্যোগটি নিজেই করে থাকে। ঘটনাটি ঘটার সময় বা দেখার সময় থেকেই শুরু হয়। কিন্তু তার ঘাত-প্রতিঘাতের সীমা কিন্তু সেখানেই শেষ হয় না। কর্মক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, সামাজিক ক্ষেত্রে, ব্যক্তিগত রিলেশনের ক্ষেত্রে, শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন পর্যায়সহ, বিভিন্নভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে। যাকে বলা হচ্ছে, ‘সেকেন্ড ডিজাস্টার’ বা ‘দ্বিতীয় দুর্যোগ’।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানসিক প্রতিক্রিয়া বা আবেগ জনিত সমস্যাগুলো দেরিতে আসতে পারে। বিশেষ করে যাদের মধ্যে বেঁচে থাকার অনুভূতি প্রাথমিক ভাবে এক ধরনের স্বস্তি তৈরি করে। যাকে আমরা বলছি, ‘হানিমুন স্টেজ’। বেঁচে থাকার আনন্দই হয়তো তাকে অনেক বেশি তাড়িত করে বা প্রাণিত করে রাখে। কিন্তু মাস কিংবা বছর পর হঠাৎ হয়তো একটি অনুভূতি চলে আসতে পারে, বার মনে হতে পারে, ‘আমি যা হারিয়েছি সেটি আর কখনো ফিরে পাবো না। আমার যে ভালোবাসার মানুষ, স্বপ্ন বা সঙ্গিটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেও আর কোনোদিন এমন করে উষ্ণতা ছড়াবে না। আমার ক্ষতিগ্রস্ত ভালোবাসা হয়তো আগের মতো ভালোবাসতে পারবে না। পরিবারটি হয়তো তেমন নেই যেমনটি ছিলো। চাকরি বা কর্মটিও কি আগের মতো হতে পারবে?”

এসব বিষয়ে সর্তকতা অত্যন্ত জরুরি। শুধু মানুষটি নিজে নয়, আশপাশের মানুষেরও দায়িত্ব বর্তায় বিষয়গুলি মনে রাখা এবং প্রয়োজনে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। মনে রাখতে হবে, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার পর হয়তো অনেকেই রিলিফ পাবেন, হয়তো তখন বড় কোনো মানসিক বিপর্যয় নাও হতে পারে। কিন্তু পরবর্তীতে সিভিয়ার ডিপ্রেশন, এনজাইটিসহ বিভিন্ন মানসিক রোগ দেখা দিতে পারে। আত্মহত্যার মতো চিন্তাও কেউ কেউ করে ফেলতে পারেন। পোস্ট ট্রামাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার খুবই কমন একটি রোগ, যা দুর্যোগে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে প্রায়ই দেখা যায়।

এর পরের সংখ্যায় আমরা জানব দুর্ঘটনার পরবর্তীতে কি কি মানসিক রোগ হয় বা হতে পারে।

ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব
সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১২১৫ ঘণ্টা, মে ১৪, ২০১৩
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মনোকথা এর সর্বশেষ