ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

মালয়েশিয়া

সময়কে অতিক্রম করা সৌন্দর্য

মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৫
সময়কে অতিক্রম করা সৌন্দর্য ছবি : ডেভিড চুয়াহ

কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া: নৃত্যশিল্পীরা যেন আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছিলেন এক পায়ে ভর দিয়ে। বাতাসকে বন্দি করে খেলা শুরু।

পুতুলের মতোই নাচতে থাকেন তারা, সময়কে আটকে রাখতে চান।

১২ সেপ্টেম্বর। শনিবার সন্ধ্যায় পৌছাই কুয়াশা থিয়েটার হলে। সঙ্গে বাংলাদেশি যুবক সাইফুল ইসলাম, যিনি এখানে একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। প্রথমে হয়তো কিছুটা বিরক্ত হচ্ছিলেন আমার ওপর। বাঙালির পক্ষে বার্মিজ তারকাদের মঞ্চ পরিবেশনায় খুব আকর্ষণ বোধ না করাটাই স্বাভাবিক।

তবে শূন্যে ওড়া বার্মিজ শিল্পীদের পরিবেশনায় হাঁ হয়ে যেতে থাকে সাইফুল ভাইয়ের মুখ। করতালির শব্দে অন্যদেরও পেছনে ফেলেন তিনি।

কুয়ালালামপুর সময় সন্ধ্যা সাড়ে আটটায় শুরু হয় প্রদর্শনী। প্রথমে মঞ্চে আসেন যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পীরা। তাদের বিচিত্র সব বাদ্য যন্ত্র মুগ্ধ করে দর্শক-শ্রোতাদের।
বাদ্য যন্ত্র শিল্পীরা রাতটিকে অসাধারণ করে তোলেন। তারা সারাক্ষণ সুরের মূর্চ্ছনায় ভাসিয়ে রাখেন মিলনায়তন। কাঁসার তৈরি বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি আর বাঁশির সুর যেন নিয়ে যায় মায়ানমারের গভীর কোন রাতে।

মায়ানমারের বিশেষ এ নৃত্য শিল্পকে বলা হয় 'জাত পো' (Zat Pwe)। পুসাকার (PUSAKA) আয়োজনে মালয়েশিয়ার ভিন্ন সংস্কৃতি উপস্থাপনের জন্য কুয়ালালামপুর আর্ন্তজাতিক শিল্প প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছে মায়ানমারের বিখ্যাত এই নৃত্য দল সাউ মান থাবিন (Shwe Mann Thabin)। বৌদ্ধের উপাসনা থেকে শুরু করে, রামায়নের রাম-সীতার শৈল্পিক উপস্থাপন ছিল 'জা পো' নামের এই নৃত্যানুষ্ঠানে।

'জাত পো' মায়ানমারের ঐতিহ্যবাহী একটি শৈল্পিক উপস্থাপনা। আঠারশ’ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে এর প্রচলন শুরু হয়। এটি মূলত বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের জীবন-চরিত সম্পর্কিত অভিনয়, অপেরা, সঙ্গীত ও নাচের সংমিশ্রণ। জাত পোয়ের মাধ্যমে মায়ানমারের ঐতিহ্যবাহী লোককথাকে উপস্থাপন করা হয়।

জাত পো, হানা পা থাওয়া ( hna pa thwa) এর বিশেষায়িত পারফরমেন্স। হানা পা থাওয়া হচ্ছে ক্রমানুসারে সাজানো গল্পের অভিনয়, গান ও কৌতুকের সংমিশ্রণে এক সমগ্র নৃত্য।

শিউ ম্যান থাবিন এ পরিবেশনার এক অবিচ্ছিন্ন অংশ ( Shwe Man Thabin)। ১৯৩৩ সালে বিখ্যাত বার্মিজ শিল্পী শিউ ম্যান তিন মং এই দলটি গঠন করেন।

যাই হোক কিছুক্ষণের মধ্যেই কয়েক প্রজন্মের সম্মিলিত একটি দল দর্শকদের মায়ানমারের সংস্কৃতির একটি ব্যতিক্রমী স্বাদ দিতে মঞ্চে পরিবেশনা শুরু করে।   শুধু নৃত্য পরিবেশনা নয়, গান, অভিনয় আর ভাঁড়ামি দিয়েও দর্শকদের অভিভুত করেন তারা।

আমাদের রবীন্দ্রনাথের মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়েই প্রার্থনা নৃত্যের মধ্য দিয়ে শুরু হয় পরিবেশনা। সঙ্গে বার্মিজ শিল্পী মে তিন মং সান উইন। রাখাইন গোষ্ঠীর জনপ্রিয় এ নৃত্যে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে বৌদ্ধকে সন্মান প্রদর্শন করা হয়।

এরপর একে একে আহবান নৃত্য 'লামিনী পু জাও (lamini pu zaw), টু পোট পার প্রিন্সেস (two pote par princes), আধ্যাত্মিক নৃত্য পা খান কিয়ো (pa khan kyaw) পরিবেশন করা হয়।

এরপর একে একে পাঁচ ধরনের বার্মিজ নৃত্য। এটা পুতুল নাচের মতোই। পুতুল নাচ বৌদ্ধ ‘জাতাকা’ উপকথার নাট্যরূপ হিসেবে রাজ আদালতে ব্যবহৃত হতো। এতে বর্ণিত হয় বৌদ্ধদের জীবন। কিন্তু এই পুতুল নাচে পুতুলের পরিবর্তে কলাকুশলীরা অংশগ্রহণ করেন। এখানে তারা পুতুলের মতো করেই নাচ করেন।

এই দলের নারী ও পুরুষ উভয়ের সাজসজ্জা একইরকম। তারা চকচকে জামা ও একইভাবে অলঙ্কার ব্যবহার করেন। শিউ ম্যান চান থার পুরুষ ( মিনথা) ও নারী ( মিনথামি) অভিনয় প্রদর্শন  করেন।

পরে শুরু হয় দর্শনীয় সান মিন অং পর্ব। এটি পাপেট নাচের অনুরণে দ্বৈত পুতুল নাচ। এতে অংশগ্রহণকারী নৃত্যশিল্পী এক পায়ে ভর করে অন্য পা শূন্যে তুলে নাচ করেন।

এছাড়াও পরিবেশন করা হয় তিন মৌসুমের নৃত্য, আপেক্ষিক সময়ের নৃত্য, বাগান (bagan) নৃত্য, ওষুধ মানুষের নৃত্য, গ্রামবাসীর আনন্দ প্রকাশের নৃত্য।
শেষ হয় রামায়ন দিয়ে। সীতার বনবাস, সোনালী হরিণ, অপহরণ আর মোহবিষ্ট করার চেষ্টার মধ্য দিয়েই শেষ হয় পরিবেশনা। ভারতীয় সংস্কৃতিতে রামায়নের প্রভাব পরিচিত। তবে কুয়াশা থিয়েটার হলে দুই শতাধিক দর্শককে মোহবিষ্ট করে রাখে রামায়নের এ পরিবেশনা।

মায়ানমারের এ দলটি তাদের পরিবেশন দক্ষতা আর শক্তিতে পুরো পৃথিবীকে যেন নিয়ে আসে হাতে মুঠোয়। আকাশে ভেসে বেড়াতে থাকেন নৃত্য শিল্পীরা। এ জন্যই নিউইয়র্ক টাইমসে এ নৃত্যকে আখ্যায়িত করা হয়েছে সময়কে অতিক্রম করা সৌর্ন্দয হিসেবে।

সেদিন অনুষ্ঠান শেষে আর বেশি কথা বাড়ানোর সুযোগ হয়নি মায়ানমারের বিশ্বখ্যাত নৃত্য প্রশিক্ষক শাও মান ইউ উইন মংয়ের (Shwe Mann U Win Maung) সঙ্গে।

তবে পরের রোববারই কুয়ালালামপুরের মাদান পেসারে দেখা মেলে এই নৃত্য গুরুর। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, প্রথানুযায়ী অনুষ্ঠানটির সূচনা হয় সন্ধ্যায়। কলাকুশলীদের ঝলমলে নিপুণ পারমন্স দর্শকদের মাতিয়ে রাখে সারারাত। তারপর সূর্যোদয়ের সময় সমাপ্তি ঘটে জাত পোয়ের।

রামায়নে আকৃষ্ট হওয়া সম্পর্কে তিনি জানান, রামায়নে রাধা-কৃষ্ণের ঘটনাপ্রবাহ তাকে মোহিত করে। সব মিলিয়ে রামায়নের ৫৫ টি পর্ব রয়েছে। যার অল্প কিছু অংশই এখানে পরিবেশন করা হয়েছে।

নিমন্ত্রণ পেলে বাংলাদেশে নৃত্য পরিবেশন করার আগ্রহ সবসময়ই রয়েছে বলে জানান তিনি। ভারতীয় নৃত্য, রবীন্দ্র নৃত্য সর্ম্পকেও বেশ অভিজ্ঞ তিনি।

ভিডিও লিংক: https://m.youtube.com/watch?list=PLMNP3yvy3ud8yq029BVPNMp7JVvFcWjXN¶ms=OAFIAVgY&v=eU2qVR31WeI&mode=NORMAL

বাংলাদেশ সময়: ১০১৫, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৫
এমএন/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মালয়েশিয়া এর সর্বশেষ

welcome-ad