ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

লাইফস্টাইল

সোনারগাঁওয়ের মসলিন শিল্প

মিজানুর রহমান মামুন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৩৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩, ২০১০
সোনারগাঁওয়ের মসলিন শিল্প

মসলিন ইতিহাসখ্যাত অসাধারণ বস্ত্রশিল্পের নাম। এর কদর ছিল বিশ্বজুড়ে।

কথিত আছে যে, এক টুকরো মসলিন ছিল ৪০ হাত দীর্ঘ আর প্রস্থে ছিল ২ হাত। এটি এতই সূক্ষ্ম ছিল যে, এক টুকরো মসলিনকে একটি আংটিতে সহজেই পোরা যেত। একটা সময় ছিল যখন এই বস্ত্রটি সোনারগাঁয়ে ব্যাপকভাবে তৈরি হতো। আর বিশ্ববাজারে এর ব্যাপক চাহিদা ছিল।

জেমস টেলর তার ‘ফটোগ্রাফি অব ঢাকা’য় ১৭৪৭ সালের ঢাকাই মসলিনের রফতানি সংক্রান্ত যে হিসাব দেখিয়েছেন তাতে উল্লেখ আছে, তখন সোনারগাঁও থেকে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার মসলিন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রফতানি হতো। অন্যদিকে খ্যাতিমান পর্যটক ইবনে বতুতা সোনারগাঁয়ের যে বর্ণনা করেছেন তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, ‘ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সোনারগাঁও একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী ছিল এবং এই বন্দরনগরীর সাথে চীন, ইন্দোনেশিয়া (জাভা) ও মালয় দ্বীপপুঞ্জের সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল’।

রালফফিচের বর্ণনা থেকে জানা যায়, ‘সে সময়ে সোনারগাঁও থেকে প্রচুর তাঁতবস্ত্র অর্থাৎ পৃথিবীবিখ্যাত মসলিন ভারত, সিংহল, মালাক্কা, সুমাত্রাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো। জেমস টেলরের মতে, তখন মসলিন ক্রয়-বিক্রয়ের প্রসিদ্ধ বাজার ছিল পানাম নামক স্থানটি। পানামনগরের কাছেই অবস্থিত বিশাল আকৃতির খাসনগন দিঘি, যা আজও বিদ্যমান, সে দিঘির স্বচ্ছ পানিতে মসলিনের সুতা ধুয়ে দিঘির চারপাশে মসলিন সুতা টানা দেওয়া হতো। জেমস অ্যাটকিনসন উনিশ শতকের প্রথমদিকে মসলিন সর্ম্পকে লিখেছিলেন, ‘এই প্রদেশে (বাংলার সর্বত্রই) ব্যাপকভাবে মসলিন তৈরি হয়ে থাকে’। তবে ভালো মানের মসলিন তৈরির জন্য যে ধরনের সহায়ক পরিবেশের প্রয়োজন ছিল তার জন্য সোনারগাঁ ছিল উল্লেখযোগ্য। কারণ যেসব অঞ্চল প্রতি বছর গঙ্গার জলে  প্লাবিত হয় সেসব এলাকায়ই শ্রেষ্ঠ জাতের তুলা উৎপন্ন হতো। উন্নত মসলিন তৈরির জন্য উন্নত কার্পাস, স্বচ্ছ পানি, দ কারিগর এবং আর্দ্র জলবায়ুর প্রয়োজন ছিল। সোনারগাঁও অঞ্চল ছিল মসলিন তৈরির এক উপযোগী স্থান। তবে মজার বিষয় হলো, মসলিন মোগল রাজা-রানীদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই অনেক বেশি সমৃদ্ধি লাভ করে। শুধু তাই নয়, সে সময়ের উল্লেখযোগ্য বণিক-পর্যটকদের মন্তব্য থেকে ধারণা করা যায়, এ মসলিনের মতো বিশ্বের কোথাও এত উন্নত, নিখুঁত এবং নিপুণ কারুকাজের বস্ত্রশিল্প ছিল না। বাংলার সুবাদাররা মোগল বাদশাহদের দৃষ্টি কাড়তে তাদের কাছে উপঢৌকন হিসেবে মসলিন শিল্পকেই বেছে নিতেন। জানা যায়, এমনকি সম্রাজ্ঞী নুরজাহান এই মসলিন বস্ত্রের একজন অতি অনুরাগী ছিলেন।

সে সময়ে মসলিনের মানগত দিক বিবেচনা করে বিভিন্ন নামে চিহ্নিত এতে করা হতো, এর মধ্যে শবনম, নয়নসুখ, জামদানি, সরবন্দ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সাধারণত মসলিনের দাম নির্ভর করত এর আয়তন, ওজন, সূক্ষ্মতা ও বুননের ওপর। যে কাপড় দীর্ঘ হতো বেশি, তাতে সুতার সংখ্যা হতো বেশি কিন্তু ওজন হতো কম সেটাই ছিল উৎকৃষ্ট। সবচেয়ে জনপ্রিয় মসলিনের নাম ছিল মলবুস খাস যার অর্থ খাসবস্ত্র। এটি মোগল সম্রাট ও তার পরিবারের জন্য নির্ধারিত ছিল। অন্যদিকে বাংলার সুবাদার বা নবাবের জন্য নির্ধারিত ছিল সরকার-ই-আলা।

সবচে আশ্চর্যের বিষয় হলো, সে সময়ে এক ধরনের মসলিন ছিল, যার নাম ঝুনা, এই কাপড় ছিল খুবই সূক্ষ্ম। ঝুনা কেউ পরিধান করলে মনে হতো না যে তিনি কোনো বস্ত্র পরিধান করেছেন। সে সময়ে ধনী দেশীয়দের অন্তঃপুরের নারীরা ঝুনাবস্ত্র পরিধান করতেন।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বিশ্বখ্যাত মসলিন তৈরিতে যেসব তাঁতি জড়িত ছিলেন, তারা প্রায় সময়ই অর্ধউলঙ্গ ও নিরন্ন অবস্থায় থাকতেন। এক কথায় তাদের অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়, কারণ মসলিনের পুরো মুনাফা লুটত ফড়িয়া এবং বণিকরা। তবে দুঃখের বিষয়, এত সব কিছুর পরও আন্তর্জাতিক বাজার পেয়ে এ নিপুণ কারুকাজের মসলিনের অপমৃত্যু হয়েছিল ইংরেজ শাসকদের হাতে। কথিত আছে, সে সময়ে ইংরেজ শাসকরা তাদের পতনের আগে নিপুণ কারুকাজের মসলিন তৈরিতে জড়িত এমন সব তাঁতিদের হাতের আঙুল কেটে দিয়ে চিরতরে ধ্বংস করে দেয় এই শিল্পকে। ধারণা করা হয়, মসলিন বস্ত্রের হাত ধরেই পরে জামদানি শিল্পের আগমন ঘটে। বর্তমানে অতীতের মসলিন শিল্পের মতো জামদানি শিল্পেরও দেশে-বিদেশে ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে।

জামদানিতেও রয়েছে সোনারগাঁর সুনাম। জামদানি ব্যবসায়ী তাহের জানান, গুণগত মানের দিক দিয়ে অতীতের মসলিনকে ফিরিয়ে আনতে জামদানি কারিগররা প্রতিনিয়ত গবেষণা করে যাচ্ছে। সেজন্য সময় ও অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। তিনি আরও বলেন, সরকার এ শিল্পের প্রতি মনোযোগী হলে জামদানিও মসলিনের অতীতের গৌরব ফিরিয়ে দিতে পারে এবং দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।

বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার সাদিপুর, জামপুর ও কাচপুর ইউনিয়নের  শতাধিক পরিবার জামদানি শিল্প উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। আর উল্লিখিত ইউনিয়নগুলোর কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গঠিত হয়েছে এক-একটি জামদানি পল্লী। এর মধ্যে আছে সাদিপুর ইউনিয়নের চেওড়াপাড়া, কাজিপাড়া, বারগাঁও, আন্দারমানিক, শিঙ্গলাব; জামপুর ইউনিয়নের হাতুরাপাড়া, তালতলা, মুছারচর, এবং কাচপুর ইউনিয়নের বেহাকৈর, কালিয়াবিটা, গাবতলা, সুকেরটেক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এদিকে বাংলাদেশের লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের (সোনারগাঁ জাদুঘর) কারুশিল্প গ্রামের কয়েকটি শনের ঘরে কারিগররা জামদানি তৈরির পাশাপাশি দর্শনার্থী ও পর্যটকদের মাঝে বিক্রয় করে থাকেন।

বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের কিছু অংশে ও রূপগঞ্জ উপজেলার বৃহৎ অংশজুড়ে উৎপাদিত জামদানি শিল্প ও অতীতের মসলিনের মতো ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি করছে দেশে-বিদেশে। তাছাড়া সব বয়সের নারী-পুরুষদের নিখুঁতভাবে জামদানিতে কারুময় কাজ করতে দেখা যায়। জামদানি সুতা মার দেওয়া থেকে শুরু করে তাঁতে বুননের উপযোগী করে গড়ে তোলার কাজটি নারীরাই করে থাকে। এখানে উৎপাদিত এক একটি জামদানির খুচরা মূল্য ৮০০ টাকা থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২২১০, সেপ্টেম্বর ৩, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।