ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

লাইফস্টাইল

সৌন্দর্যসেবা : নারীদের সফল পেশা

মার্জিয়া রহমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৩ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০১১
সৌন্দর্যসেবা : নারীদের সফল পেশা

ছোট্ট টেবিলটিতে মন দিয়ে পড়ছিল এক কিশোরী। সামনে তার স্কুলের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা।

হঠাৎ পার্লারের দরজা ঠেলে কেউ ঢুকলেই সে পুরোদস্তুর পেশাদারদের মতো আন্তরিক হাসি নিয়ে বলে, ‘কী করাবেন আপু?’

রিনা এখন মূর্ছনা হারবাল বিউটি পার্লারের একনিষ্ঠ কর্মী। উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান এএসডি বিনামূল্যে তার থাকা-খাওয়া ও পড়ালেখার খরচের পাশাপাশি স্বনির্ভরতার জন্য দিয়েছে সৌন্দর্যসেবার প্রশিণ। তাই ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী ১৪ বছরের রিনা নিজের উপার্জিত অর্থ দিয়ে গ্রামে থাকা তার পরিবারকে সাহায্য করতে পারছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহর ও জনপদে গড়ে ওঠা এমন বহু সৌন্দর্যসেবা কেন্দ্রে রিনার মতো হাজার হাজার নারী আত্মনির্ভরশীলতার ভিত্তি রচনা করছে।

১৯৭৭ সালে করাচি থেকে প্রশিণপ্রাপ্ত বিউটিশিয়ান জেরিনা আজগর দেশের প্রথম নারী হিসেবে বিউটি পার্লার প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হয় এ দেশের নারীদের উদ্যোক্তা ও কর্মী হিসেবে আত্মনিয়োগের এক নতুন পথ। যেখানে বছর চল্লিশেক আগেও রূপচর্চা করতে মেয়েদের বাড়ির বাইরে যাওয়ার কথা চিন্তাই করা করা যেত না, সেখানে আজকের নারীর ব্যস্ত জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে বিউটি পার্লার। লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন ‘ক্যানভাস’-এর সাংবাদিক আহসান পাভেলের মতে, মূলত নব্বইয়ের দশকে স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর বিস্তারের পর থেকেই এই ব্যবসার বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।

আইব্রোর প্লাক বা চুল কাটার মতো নিয়মিত সেবার পাশাপাশি ত্বক ও চুলের যতœ, সৌন্দর্যবর্ধন ও রূপসজ্জার নানারকম সুযোগ থাকে পার্লারগুলোতে। শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী বা গৃহিণী- সব ধরনের রূপসচেতন নারীর কাছেই ভালো পার্লারের চাহিদা অনেক। তাই এখন আর গুটিকয়েক নামী-দামী পার্লারের মধ্যে এ ব্যবসা সীমাবদ্ধ নেই। পাড়ার গলি থেকে মফস্বল শহরে ছড়িয়ে পড়েছে পার্লারগুলো। ঈদ, বিভিন্ন উৎসব, বিয়ে ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের সময় পার্লারগুলোতে ভিড় থাকে সবচে বেশি। তাছাড়া সারা বছর ধরেই এই ব্যবসা থেকে মুনাফা লাভের সম্ভাবনা থাকে।

রাজধানীতে পুরুষদের জন্য কিছু সৌন্দর্য সেবাকেন্দ্র চালু হলেও এখন পর্যন্ত এই ব্যবসার প্রধান উদ্যোক্তা, কর্মী ও গ্রাহক নারীরাই। বিনিয়োগের ত্রে হিসেবে বিউটি পার্লারকে বেছে নেওয়ার পেছনে এর সুবিধার কথাই জানান সলিমুল্লাহ রোডের রং-রূপ হেয়ার অ্যান্ড বিউটি পার্লারের স্বত্বাধিকারী সৈয়দা উর্মি চৌধুরী। দু বছর আগে ব্যাংকের চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি এ ব্যবসায় আসেন। এখন তার পার্লারে তিনজন কর্মী কাজ করছেন। পরিচিতি বাড়ার সাথে সাথে লাভের মুখ দেখায় পার্লারটিকে আরও উন্নত করতে চান তিনি।

নারীর কর্মসংস্থানের জন্য সৌন্দর্যসেবা একটি ইতিবাচক ত্রে। এ পেশায় আসতে উচ্চশিা জরুরি নয়। এসএসসি পাস করার পর থেকেই পড়ালেখার পাশাপাশি খণ্ডকালীন পেশা হিসেবে এ কাজ বেছে নেওয়া যায়।

দেশের শীর্ষস্থানীয় সৌন্দর্যসেবা প্রতিষ্ঠান ‘পারসোনা’র কর্ণধার কানিজ আলমাস খান বলেন, তার প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে আড়াই হাজার কর্মীর মধ্যে নব্বই শতাংশই নারী। দতা অনুসারে তাদের বেতন ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। সেবা প্রদানের পাশপাশি আন্তর্জাতিক প্রশিণের জন্য আছে পার্সোনা ইন্সটিটিউট অব বিউটি অ্যান্ড লাইফস্টাইল। এখান থেকে  প্রশিণ নিয়ে অনেক নারী এখন দেশের বাইরেও কাজ করছেন।

বাংলাদেশের অগ্রণী এই নারী উদ্যোক্তার মতে, পেশাগত দতা ও গ্রাহকদের প্রতি আন্তরিক ব্যবহারই এই পেশায় সাফল্যের পূর্বশর্ত।

বড় পার্লারগুলোর পাশাপাশি যে কোনো ছোট বা মাঝারি পার্লারেও প্রশিণ নেওয়ার ব্যবস্থা থাকে। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানভেদে ৫ হাজার থেকে ৬০ হাজার বা তারও বেশি ফি প্রদান করতে হয়। তবে যারা এই অর্থ ব্যয় করতে সম নন তাদের জন্য নানা রকম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অর্থসাহায্য বা বিনামূল্যে প্রশিণের ব্যবস্থা করে থাকে। যেমনÑ এসএমই ফাউন্ডেশন ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সত্যিকারের আগ্রহী নারীদের বিনামূল্যে প্রশিণের সুযোগ দেয়। তারা গত বছর অক্টোবর মাসে বগুড়া, নীলফামারী, রাঙামাটি, জয়পুরহাট ও ঢাকার ২৭ জন নারীকে পার্সোনার সহযোগিতায় বিনামূল্যে প্রশিণ প্রদান করে। এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ফারজানা জানান, প্রকল্প শেষে তাদের সবাই এখন ভালো কাজ করছেন।  

অভিজ্ঞ উদ্যোক্তাদের মতে, যারা উদ্যোক্তা হিসাবে এই ব্যবসায় আসতে চান তাদের জন্য অর্থের পাশাপাশি বিউটিফিকেশন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। যেহেতু শহরগুলোতে এখন অনেক পার্লার আছে, তাই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সেবার মান নিয়ন্ত্রণ জরুরি। কেননা ভালো সেবা ও ভালো পণ্যের অভাব থাকলে কোন গ্রাহকই সেই পার্লারে যাবার ঝুঁকি নেবেন না।

ঘরোয়াভাবে বিভিন্ন সেবা দেওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে এ ব্যবসা শুরু করার ক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের লাইসেন্স বা স্থানভেদে পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। এছাড়া কর প্রদানের জন্য প্রয়োজন হয় ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বরের। এরপর আসে পার্লারের অবস্থানের কথা। বিশেষ করে ঢাকায় বাড়িভাড়ার চুক্তি অনেক ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন স্থানে ছোট বা মাঝারি পার্লারগুলো ঘুরে দেখা যায়, প্রত্যেককেই ন্যূনতম ১ লাখ টাকা অগ্রিম পরিশোধ করতে হয়েছে। মাসিক ভাড়া স্থান ও আকারভেদে বারো থেকে আঠারো হাজার টাকা। এর সাথে ডেকোরেশন, উপকরণ ও প্রসাধনীসামগ্রীসহ ন্যূনতম দেড় থেকে দুই লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে এ ব্যবসা শুরু করা যায়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
 
ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের মতো বড় শহরসহ বিভিন্ন অঞ্চলের অধিকাংশ পার্লারে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আদিবাসী নারী কাজ করেন। এদের মধ্যে গারো বা মান্দীদের সংখ্যা সবচে বেশি। মোহাম্মদপুরে শাহী’স বিউটি পার্লারের ১০ জন কর্মীই মান্দী নারী। টিক্কাপাড়ার স্বপ্নচূড়া বিউটি পার্লারের বিউটিশিয়ান মালার বাড়ি সিলেটে। ৫ বছর ধরে তিনি ঢাকায় বিভিন্ন পার্লারে কাজ করছেন। তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা উপার্জিত অর্থ জমিয়ে সিলেটে ফিরে গিয়ে একটি পার্লার খোলার। তিনি জানান, ঢাকার তুলনায় অনেক কম খরচে তিনি নিজ এলাকায় ব্যবসা শুরু করতে পারবেন।

দেশজুড়ে এই লাভজনক ব্যবসাটি বিস্তৃত হলেও এখন পর্যন্ত বিউটি পার্লারগুলোর কোনো সমন্বিত সংগঠন নেই। ফলে এর উদ্যোক্তা ও কর্মীরা তাদের নিজস্ব সমস্যা বা প্রয়োজনগুলোর কথা তুলে ধরতে পারছেন না। এছাড়া পার্লারগুলোর মান নিয়ন্ত্রণের জন্যও কোনো কর্তৃপ নেই। অথচ নিম্নমানের ও মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য ব্যবহার ও উপকরণের ভুল ব্যবহারের ফলে ত্বক ও স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা জানান।

এ বিষয়ে কানিজ আলমাস খান পার্লারগুলোর জন্য একটি কেন্দ্রীয় সংগঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। এমনকি দেশের সর্বমোট পার্লার ও সংশ্লিষ্ট জনবলের সঠিক সংখ্যাও কারো জানা নেই। নারীকেন্দ্রিক এ খাতটির দিকে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর যথাযথ মনোযোগের মাধ্যমে একে আরও লাভজনক করা যায়। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে মফস্বল অঞ্চলগুলোতে এ খাতের বিস্তৃতির মাধ্যমে অনেক নারী অর্থনৈতিক মুক্তি লাভ করতে পারেন বলে মনে করেন এ পেশায় জড়িতরা।

বাংলাদেশ সময় ১৪১৫, মার্চ ১৯, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।